লন্ডনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তারেকের ‘বিদায়ী ভাষণ’, চাইলেন ঐক্য
দেড় যুগের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফেরার আগে লন্ডনে শেষবারের মত বড় জমায়েতে প্রবাসী বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান; দেশে ‘ষড়যন্ত্র থেমে নেই’ মন্তব্য করে জানালেন ঐক্যের আহ্বান।
তিনি বলেন, “আমি এক বছর আগে আপনাদের বলেছিলাম যে, সামনে কিন্তু আমাদের কঠিন সময়। ষড়যন্ত্র থেমে নেই এবং এই নির্বাচনও কিন্তু খুব সহজ নয়। আপনারা অনেকেই কিন্তু ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারছেন। এক বছর আগে যা বলেছি, সেটা কিন্তু হচ্ছে।
“এখন আমি আবারও বলছি, সামনের সময় কিন্তু খুব সুবিধের নয়। কাজেই সকলকে সজাগ থাকতে হবে, সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”
বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার লন্ডনের সিটি প্যাভিলিয়নে লন্ডন বিএনপির আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নেন তারেক রহমান। ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার আগে বিজয় দিবসের এ অনুষ্ঠান কার্যত তার বিদায় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
হল ভর্তি প্রবাসী বিএনপি কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা কী ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারবেন?” কর্মী-সমর্থকরা সমবেত কণ্ঠে ‘হ্যাঁ’ বলেন।
তারেক বলেন, “ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারলেই আমরা আমাদের এই যে পরিকল্পনার (দেশ গড়ার পরিকল্পনা) কথা বললাম, তা সফল করতে পারব, ঐক্যবদ্ধ থাকলেই আমরা আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারব, ঐক্যবদ্ধ থাকলেই আমরা বাংলাদেশে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।”
যুক্তরাজ্যের উদাহরণ টেনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “এই ব্রিটেনে যে আপনারা আছেন, এই দেশে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা আছে বলেই এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। বাংলাদেশের মানুষ বহু বহু যুগ ধরে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।
“কাজেই, আসুন বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার যদি ফিরিয়ে দিতে হয়, যে কোনো মূল্যে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ না থাকার কোনো বিকল্প নেই আসাদের। ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’। কাজেই এ কথাটি আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে।”
২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারা হেফাজতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেন। পরে উচ্চ আদালতের জামিনে ২০০৮ সালে স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে লন্ডনে আসেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। এরপর তার আর দেশে ফেরা হয়নি।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারেক রহমানের ফেরার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় পেরিয়ে যায় আরো ১৬ মাস। অবশেষে বিএনপির পক্ষ থেকে সম্প্রতি তার দেশে ফেরার তারিখ জানানো হয়।
কানায় কানায় পূর্ণ হলরুমে বক্তব্যের শুরুতেই বিদায়ের বার্তা দিয়ে প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারেক রহমান।
তিনি বলেন, “২৫ তারিখে ইনশাআল্লাহ আপনাদের দোয়ায় আমি দেশে ফিরে যাব। সকলের কাছে দোয়া চেয়ে যাচ্ছি। আপনারা দয়া করে দোয়া করবেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করবেন।
“আপনাদের সামনে যে পরিকল্পনা তুলে ধরেছি, আল্লাহ যাতে আমাকে সেই তৌফিক দেন, দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য সেই কাজগুলো যাতে সম্পূর্ণ করতে পারি।”
‘কেউ এয়ারপোর্টে যাবেন না’
তারেক রহমান বলেন, “আমি একটি বিনীত অনুরোধ করতে চাই। কী সেই বিনীত অনুরোধ? আপনাদের সাথে আমি ১৮ বছর ছিলাম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সাথে দেখা হয়েছে। আপনাদের সাথে বহু স্মৃতি আমার রয়ে গেছে, আপনাদের সাথে বহু দুঃখ কষ্ট আমি শেয়ার করেছি।
“আপনারা বিভিন্ন সময় যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী, বিশেষ করে যারা জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশি রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, আপনারা বহু মানুষ বিভিন্ন সময় আমার, আমার পরিবারের দলের বিপদের সময় আমাকে মানসিকভাবে সাহস দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন, সমর্থন যুগিয়েছেন।
“২৫ তারিখে ইনশাআল্লাহ আপনাদের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে আমি দেশে ফিরে যাব। কিন্তু এখানে উপস্থিত, এই ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে কেউ আপনারা এয়ারপোর্টে সেদিন যাবেন না।”
তারেক বলেন, “এয়ারপোর্টে গেলে একটি হট্টগোল তৈরি হবে। মানুষ জানবে যে এরা সব বাংলাদেশি। এতে দেশের সুনাম নষ্ট হবে, দলের সুনাম নষ্ট হবে।
“যারা সেদিন এয়ারপোর্টে যাবেন না, আমার আজকের এই অনুরোধ যারা রাখবেন, আমি ধরে নেব তারা দল এবং সর্বোপরি দেশের সম্মানের প্রতি মর্যাদা রাখেন। আর মানা করা সত্ত্বেও, অনুরোধ করার পরেও যারা যাবেন, আমি ধরে নিতে পার তারা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য সেখানে গেছেন।”
তারেকের বক্তব্যের শেষে দেড় মিনিটের একটি ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে চব্বিশের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নুতন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা বলা হয়।
তারেক রহমান তার বক্তব্যে বাংলাদেশকে একটি ‘সুখী, কল্যাণকর রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে তার পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেন। সেখানে ফ্যামিলি কার্ড, ফার্মাস কার্ড, স্বাস্থ্য কার্ড, বেকার সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনার কথা বলেন তিনি।
‘প্রবাসীদের প্রতি কতজ্ঞতা’
তারেক বলেন, “প্রবাসীদের কাছে প্রথমেই আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি। আমাদের যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এই আন্দোলনে প্রবাস থেকে বহু প্রবাসী বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এই আন্দোলন সফল করার পেছনে প্রবাসীদের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে।কাজেই প্রবাসীদের অবদানকে কোনোভাবেই আমরা খাটো করে দেখতে পারি না।
“আপনাদের সামনে আমি যে পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেছি, আমাদেরকে আগে কাজ শুরু করতে হবে। আমরা যদি কাজ শুরু করতে না পারি এবং আমরা যদি সকলের দাবি উপস্থাপন করতে থাকি, তাহলে কিন্তু একটা ইনডিসিপ্লিন তৈরি হবে। ফলে আমরা কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না।”
জনগণের সমর্থন নিয়ে বিএনপি বাংলাদেশের আগামী সরকার গঠন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লন্ডন বিএনপির আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ এবং সঞ্চালনায় ছিলেন সদস্য সচিব খসরুজ্জামান খসরু।