সম্মান ও ভালোবাসা প্রাপ্তির চার উপায়
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় চাওয়া কী? এটা নিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়; তাহলে দেখা যাবে কেউ চায় ভালোবাসা? কেউ চায় পরিচিতি, কেউ চায় প্রভাব প্রতিপত্তি আবার কেউ আবার চায় মানুষের প্রশংসা। যদিও মানুষের দেওয়া ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসা শর্তসাপেক্ষ ও পরিবর্তনশীল। আজ যে কারো হূদয়ে জায়গা করে নেয়, কালই সে তার হূদয় থেকে মুছে যেতে পারে। কিন্তু একটি ভালোবাসা আছে, যা স্থায়ী, পবিত্র ও সর্বাঙ্গীন। সেটি হচ্ছে মহান আল্লাহর ভালোবাসা। আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার জন্য আসমান ও জমিন; উভয় জায়গাতেই সম্মানের দরজা খুলে যায়।
এই গভীর সত্যটি অত্যন্ত সুন্দর ও হূদয়স্পর্শী ভাষায় আমাদের সামনে তুলে ধরে মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালবাসেন তখন তিনি জিবরাঈল (আ.)-কে ডেকে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুক বান্দাহকে ভালোবাসেন, কাজেই তুমিও তাকে ভালোবাস। তখন জিবরাঈল (আ.)-ও তাকে ভালবাসেন এবং জিবরাঈল (আ.) আকাশের অধিবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাহকে ভালোবাসেন। কাজেই তোমরা তাকে ভালোবাস। তখন আকাশের অধিবাসী তাকে ভালোবাসতে থাকে। অতঃপর পৃথিবীতেও তাকে সম্মানিত করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। (বুখারি, হাদিস : ৩২০৯)
এই হাদিস আমাদের শেখায়; প্রকৃত মর্যাদা মানুষের বানানো মঞ্চে নয়, বরং আল্লাহর দরবারে নির্ধারিত হয়। মানুষের হূদয় আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। তিনি চাইলে অচেনা একজন মানুষকে সমাজে সম্মানিত করে দেন, আবার চাইলে নামী-দামি ব্যক্তিকেও মানুষের দৃষ্টিতে তুচ্ছ করে দেন। পবিত্র কোরআনেও এ বাস্তবতার ঘোষণায় বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে এবং সত্কর্ম করে, পরম দয়ালু আল্লাহ তাদের জন্য মানুষের হূদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৯৬)
এ আয়াত ও হাদিস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, মানুষের হূদয়ে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করা কোনো সামাজিক কৌশল নয়; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখে, আল্লাহ তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও ঠিক করে দেন। এই হাদিস থেকে আমাদের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আমলযোগ্য শিক্ষা বেরিয়ে আসে।
প্রথমত, আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের পথ হলো ঈমান ও তাকওয়া। বাহ্যিক প্রদর্শন, লোক দেখানো ইবাদত বা মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা আল্লাহর ভালোবাসা এনে দিতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৬)
দ্বিতীয়ত, নেক আমলের ধারাবাহিকতা। আল্লাহ সেই বান্দাকে ভালোবাসেন, যে গোপনে ও প্রকাশ্যে তাঁর আনুগত্যে অবিচল থাকে। সর্বাবস্থায় তার আমল এমমাত্র আল্লাহর জন্য হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো তা, যা নিয়মিত করা হয়; যদিও তা অল্প হয়।’ (বুখারি, হাদিস: ৬৪৬৫)
তৃতীয়ত, মানুষের প্রশংসার পেছনে না ছোটা। এই হাদিস আমাদের শেখায়; নিজেকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার দায়িত্ব আমাদের নয়; এটি আল্লাহর কাজ। আমাদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া। মানুষ খুশি হলো কি না; তা গৌণব্যাপার।; আল্লাহ খুশি হলেন কি না; সেটাই মুখ্য বিষয়।
চতুর্থত, চরিত্র ও আচরণের গুরুত্ব। আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার চরিত্রে নম্রতা, সততা, সহানুভূতি ও ইনসাফ ফুটে ওঠে। সে মানুষকে কষ্ট দেয় না, অহংকার করে না, বরং নিজের ভালোকে আড়াল করে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে।
সমাজে অনেককেই অভিযোগ করি যে, ভালো মানুষ মূল্যায়ন পায় না, ন্যায়বান ব্যক্তি অবহেলিত হয়। কিন্তু এই হাদিস আমাদের আশ্বস্ত করে যে, দুনিয়ায় মূল্যায়ন প্রাপ্তি দেরি হলেও; আল্লাহর কাছে কোনো ভালো আমল হারিয়ে যায় না। আল্লাহ উপযুক্ত সময়ে বান্দাকে সম্মানিত করেন। কখনো মানুষের জীবদ্দশায়, কখনো মৃত্যুর পরও।আমরদের উচিত মানুষের ভালোবাসার পরিবর্তে আল্লাহর ভালোবাসা চাওয়া। কারণ মানুষের ভালোবাসা একদিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা বান্দাকে দুনিয়া ও আখিরাত; উভয় জগতে সফল করে তুলবে।
আসুন, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানাই। লোকচক্ষুর আড়ালেও যেন আমাদের আমল বিশুদ্ধ থাকে। তাতে হয়তো আমরা জানব না, কবে আমাদের নাম আসমানে উচ্চারিত হলো; কিন্তু আল্লাহ জানবেন। আর সেটাই একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান।