শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৭ ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্য

 প্রকাশিত: ১৮:১২, ১৪ জুন ২০২২

মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্য

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। 

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুহার কমানো সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৪১, এখন তা দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। অর্থাৎ, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ। 

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ১৯৭২ সালে এক হাজার শিশু জন্ম নেয়ার পর ১৪১টি শিশু মারা যেতো বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। আর এখন মারা যায় ২১টি শিশু। পাকিস্তানে এখন শিশু মৃত্যুর হার ৫৫। বাংলাদেশেরচেয়ে অনেকবেশি। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছরে পাকিস্তানে শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশেরচেয়ে কম ছিলো। সংখ্যাটি ছিলো ১৩৯। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে দেশের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্য মিলেছে।

শূন্য থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমডিজি অ্যাওয়ার্ড-২০১০ অর্জন করেছেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মা ও শিশু মৃত্যুহার কমানোর কৌশলপত্রের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে প্রতি লাখ সন্তান প্রসবে মাতৃ মৃত্যুহার ছিলো ২৫৯ জন। সম্প্রতি সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬৫ জনে।  গত ১০ বছরে মাতৃ মৃত্যুহার কমেছে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে প্রায় ৯৪ জন। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। শূন্য থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে ইতোমধ্যে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) স্বীকৃতি দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ৫০ জনের নিচে নামিয়ে আনা।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এসডিজি অনুযায়ী, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যথেকে এক মাস বয়সি শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১২ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে, শূন্যথেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩৮ জন। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০৩৫ সালের মধ্যে জীবিত জন্মানো শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ২০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শিশুপুষ্টির সূচকে দেশ উন্নতি করেছে।

মা ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসেরক্ষেত্রে সবচেয়ে ভূমিকা রয়েছে দেশের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা তৈরি, জরুরি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং পরামর্শ প্রদান।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকেই মাতৃস্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিশুপুষ্টি এসব বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিয়েছিল। দেশের সংবিধানে, বিভিন্ন সময়ে নেয়া পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যনীতি এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচিতে এসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বার্ষিক গ্লোবাল চাইল্ড হুড রিপোর্ট ২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালে গত দুই দশকে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়েবেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেখানে ভুটানের শিশু মৃত্যুহার কমেছে ৬০ শতাংশ,নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতের ৫৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে ৬৩ শতাংশ।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকার মাতৃ ও শিশু মৃত্যুরোধে সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। আর এই কারণেই দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু উভয়ই কমেছে। ২০১৭ সালে গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭৬ জন থাকলেও বর্তমানে তা ১৭২ জন। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মৃত্যুহার ২০ জন থাকলেও বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১৮ দশমিক ৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমাদের ২০৩০ সালের মধ্যে প্রিম্যাচুউরড এ শিশু মৃত্যুহারের লক্ষ্যমাত্রা ১২ দেয়া আছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবাই সঠিকভাবে সঠিক কাজটি করলে এই অপরিণত শিশু মৃত্যুহারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয়) মতিউর রহমান বাসসকে জানান, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মা ও শিশু মৃত্যুর হার আরও কমিয়ে আনতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সারাদেশে ৩৩৬৪ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পরিবার পরিকল্পনা সেবা পাশাপশি মা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২১৮৯ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সপ্তহে ৭ দিন ২৪ ঘন্টা নিরাপদ প্রসবসেবা চালু রয়েছে। ইতোমধ্যে ১১৫৩ টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কর্ণার এর মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। 

এছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পুরাতন ৯৬ টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে ৭০ টি কেন্দ্রে জরুরী প্রসূতিসেবা প্রদান করা হচ্ছে। নবনির্মিত ১৫৯ টি মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রে নিরাপদ প্রসবসেবাসহ অন্যান্য সেবাদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।

তিনি বলেন, মাতৃমৃত্যু হার কমাতে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে জরুরি প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করায়। এ লক্ষ্যে ৫৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই ৫৯টি জেলা হাসপাতালে এরই মধ্যে ১৪টি জেলার ২০টি উপজেলায় ৩৪টি হাসপাতালকে নারীবান্ধব করা হচ্ছে। এছাড়াও সুখি পরিবার কলসেন্টার ‘১৬৭৬৭’  মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

মন্তব্য করুন: