আমি কেন সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করব: আদালতে শওকত মাহমুদ
সরকার ‘উৎখাতের ষড়যন্ত্রে’ জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও জনতা পার্টি বাংলাদেশের মহাসচিব শওকত মাহমুদ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আদালতে রিমান্ড শুনানিতে।
তিনি বলেছেন, “এই সরকার আমাদের কাঙ্ক্ষিত সরকার। এই সরকার আসার পর আমার বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা প্রত্যাহার করেছে। আমি কেন এই সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনা করব। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র অবিশ্বাস্য।”
ঢাকার মহানগর হাকিম ফাহমিনা খন্দকার আন্না বৃহস্পতিবার তাকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন।
শুনানি চলাকালে কথা বলার অনুমতি চান শওকত মাহমুদ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তখন আপত্তি জানান। তবে বিচারক তাকে কথা বলার অনুমতি দেন।
শওকত মাহমুদ এসময় বলেন, “আমি গত ৩৫ বছর থেকে সাংবাদিকতা করি। প্রেস ক্লাবের ছয় বার সাধারণ সম্পাদক এবং পাঁচ বার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। গত ১৫ বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করেছি। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেড় বছর জেলে ছিলাম। সেসময় আমার বিরুদ্ধে ৭০টি মামলা হয়। খালেদা জিয়া যত মামলার আসামি, আমিও তত মামলার আসামি।”
সরকার ‘উৎখাতের ষড়যন্ত্রে’ জড়িত থাকার অভিযোগে যে মামলায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন শওকত মাহমুদ।
আদালতে এনায়েত করিম চৌধুরীর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “সন্ত্রাসী কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিমের নাম এসেছে। তার ফোন চেক করুক, তার সাথে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা। আমার ফোন পাঁচ দিন যাচাই করছে। এমন তথ্য নেই আমি সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত।
“আমি বিএনপির রাজনীতি করেছি। বিগত সরকারের আমলে আন্দোলনের প্রক্রিয়া নিয়ে দলের (বিএনপি) সঙ্গে মতানৈক্য ঘটে। তাই আমার সদস্যপদ বাতিল করা হয়। সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহু মানুষের সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়েছে, ভালো সম্পর্ক হয়েছে। সব সাংবাদিকদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা আছে। পরিচিত কারো অপকর্মের দায় আমার ওপর বর্তায় না।”
আদালতে নিজের অসুস্থতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার ছয়টা বাইপাস সার্জারি হয়েছে। জেলে অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্রথমে আমাকে জেলখানার হাসপাতালে নেওয়া হলেও পরে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমি বর্তমানে চিকিৎসাবিহীন আছি।
“এখন বিচার বিভাগ স্বাধীন। আপনি (বিচারক) সুচিন্তিতভাবে বিচার করবেন। আপনি যে আদেশ দিবেন, মাথা পেত নেব।”
শওকত মাহমুদকে রোববার গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন ডিবি পুলিশের রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক আখতার মোর্শেদ।
মামলার মূল নথি না থাকায় সেদিন রিমান্ডের বিষয়ে শুনানি হয়নি। রিমান্ড আবেদনের শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ঠিক করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার সেই শুনানি শেষে তার রিমান্ড আদেশ দেয় আদালত।
চারটি কারণ দেখিয়ে শওকত মাহমুদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিলেন ডিবি পুলিশের রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক আখতার মোর্শেদ।
আবেদনে বলা হয়, শওকত মাহমুদসহ আরো অজ্ঞাত আসামিরা এনায়েত করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন সময়ে দেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জন-নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করছে। বর্তমান সরকারকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এবং উচ্চ পদস্থ লোকজন ও ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে গোপনে সভা-সমাবেশ, পরামর্শ করেছে।
আবেদনে আরো বলা হয়, অন্যান্য আসামির সঙ্গে যোগসাজশ করে শওকত মাহমুদ একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চান। এজন্য তিনি কোন কোন দল বা সংগঠনের সঙ্গে গোপনে ‘শলাপরামর্শ করছেন’, সেসব তথ্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর কাইয়ুম হোসেন নয়ন ও হারুনুর রশিদ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, “এই সরকারকে উৎখাত করতে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে ষড়যন্ত্র করেন এক মার্কিন নাগরিকসহ এই আসামি। এর পেছনে ভারতের ‘র’সহ একাধিক দেশের গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে। তারা এই সরকারকে ফেলে (উৎখাত) দিয়ে তাদের মনমত সরকার গঠন করার পরিকল্পনা করে।
“তবে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস পদক্ষেপে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এই পরিকল্পনার সঙ্গে আসামি শওকত মাহমুদসহ অন্য আর কারা জড়িত সেজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।”
আরেক আইনজীবী হারুনুর রশীদ বলেন, “তারা এই সরকারকে ফেলে দিয়ে আবার ফ্যাসিস্টকে ফেরত আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বিএনপিতে ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন। দলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ায় তাকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়, সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
“এখন একটি পার্টি আছে। সেখানে থেকে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করছে। তাকে পুলিশ হেফাজতে নিলে আরও তথ্য উদঘাটন হবে।”
আসামিপক্ষে আইনজীবী শফিউজ্জামান রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানিতে বলেন, “শওকত মাহমুদ গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছেন। প্রতিদিন তারপ পাঁচটি করে ইনসুলিন নিতে হয়। এখন যদি তাকে রিমান্ডে পাঠানো হয় তাহলে পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন নাকি তার চিকিৎসা করবেন।
“যে মামলায় তাকে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে সেখানে ঘুরেফিরে এক মার্কিন নাগরিকের নাম আসে। এ মামলার ঘটনার সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র যোগসাজশ নেই।”
শুনানি শেষে শওকত মাহমুদকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন বিচারক।
গত ২০ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১০টার দিকে মিন্টো রোড এলাকা থেকে এনায়েতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাডো গাড়িতে করে ‘সন্দেহজনকভাবে’ ঘুরছিলেন তিনি। পুলিশের সন্দেহ হলে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঘোরাঘুরির কারণ জানতে চাইলে এনায়েত কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তখন পুলিশ তাকে হেফাজতে নিয়ে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে রমনা মডেল থানায় মামলা করে।
এনায়েত করিম চৌধুরী ১৯৮৮ সালে আমেরিকায় যান এবং ২০০৪ সালে আমেরিকান পাসপোর্ট পান। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করার জন্য অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে ৬ সেপ্টেম্বর তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে বাংলাদেশে আসেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
এনায়েতকে গ্রেপ্তারের পর এ মামলায় জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি অংশের মহাসচিব কাজী মো. মামুনূর রশীদসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ২৫ এপ্রিল ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’র আত্মপ্রকাশ ঘটে, যার চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
এর আগে ২০২৩ সালের ২১ মার্চ শওকত মাহমুদকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানসহ দলের সব পদ থেকে ‘বহিষ্কার’ করা হয়েছিল।