তফসিল ঘোষণা: সংসদ নির্বাচন ও গণভোট ১২ ফেব্রুয়ারি
আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণের দিন রেখে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ১২ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত, তা বাছাই হবে ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২০ জানুয়ারি। তার তিন সপ্তাহ পর হবে ভোটগ্রহণ।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ২১ জানুয়ারি প্রতীক বরাদ্দ হবে। সেক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমার জন্য ১৮ দিন সময় দেওয়া হয়েছে এবং প্রচারের জন্য ২০ দিন সময় রয়েছে।
ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার শেষ করতে হয়। অর্থাৎ, ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ভোটের প্রচার চালানোর সুযোগ থাকবে।
জুলাই অভ্যত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র দুই বছরের মাথায় এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সিইসি নাসির উদ্দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তফসিল ঘোষণা করেন।
ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “ভোট আপনার শুধু নাগরিক অধিকারেই নয় বরং পবিত্র আমানত ও দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সচেতনভাবে আপনারা পালন করবেন এ আমার বিশ্বাস।
“যে কোনো ভয়ভীতি, প্রলোভন, প্রবঞ্চনা এবং সীমাবদ্ধতার ঊর্ধে উঠে নিঃসংকোচে আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন। আপনাদের নিরাপদ ও উৎসবমুখর অংশগ্রহণকল্পে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও বাহিনী কাজ করবে।”
তিনি বলেন, “ধর্ম, গোত্র, গোষ্ঠী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে এই আনন্দ আয়োজনে অংশগ্রহণ করুন। পরিবারের প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও সন্তান সম্ভবা মাস সহ সকলকে নিয়ে ভোট দিতে আসুন। আমি আশা করি আপনাদের সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোটের অনুষ্ঠান উৎসবে রূপ নেবে।”
- সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট হবে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে, ব্যালট পেপারে।
- ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলবে।
- একজন ভোটার দুটি ব্যালটে ভোট দেবেন। সংসদের ভোটের ব্যালট হবে সাদাকালো; গণভোটেরটি রঙিন।
- সংসদের ব্যালটে বরাবরের মতই প্রার্থীদের নাম আর নির্বাচনি প্রতীক থাকবে। নির্ধারিত চৌকো সিল দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে।
- গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে–জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তাবয়নে ভোটার সম্মতি দিচ্ছেন কি না। উত্তর দেওয়ার জন্য ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ দুটো ঘর থাকবে। যারা সম্মতি জানাচ্ছেন তারা ‘হ্যাঁ’ লেখা বাক্সে সিল দেবেন এবং যারা এর পক্ষে নন তারা ‘না’ ভোট দেবেন।
- ভোট দেওয়ার পর সংসদ এবং গণভোটের ব্যালট আলাদা দুটো বাক্সে ফেলতে হবে।
- একই দিন সংসদ ও গণভোট হওয়ায় এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে।
ত্রয়োদশের পথে
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছিল শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ।
দ্বাদশ সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের … জানুয়ারি, সেই সংসদের মেয়াদ সালের .. জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু জুলাই মাসে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় পরিণত হলে পাল্টে যায় সবকিছু। সেই অভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, শেখ হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে।
তিন দিনের মাথায়, ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। নভেম্বরে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় নতুন নির্বাচন কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ঘোষণা দেন, তার সরকারের কাজ হবে তিনটি। জুলাই হত্যার বিচার, রাষ্ট্রের সংস্কার এবং নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচন কবে হবে, তা বলা হচ্ছিল না। এ নিয়ে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বাড়ছিল। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছিল তারা।
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে। কিন্তু ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে দুই পক্ষই আগের অবস্থান থেকে সরে আসে। যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে।
সে অনুযায়ী প্রস্ততি এগিয়ে নিতে থাকে নির্বাচন কমিশন। তৈরি করা হয় রোডম্যাপ। এদিকে সরকারও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলতে থাকে শেখ হাসিনার বিচার। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে জাতীয় একমত্য কমিশন।
সেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি পথ খুঁজতে গিয়ে গণভোটের বিষয়টি আসে। সেটা কবে হবে–জাতীয় নির্বাচনের আগে না একসঙ্গে–তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বাহাস চলে।
প্রধান উপদেষ্টা গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা দেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে হবে।
এ ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে গণভোটের প্রস্তুতিও শেষ করে। ২৯ নভেম্বর ‘মক ভোটিং’ করে অভিজ্ঞতা নিয়ে ভোটগ্রহণের সময় ও বুথের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
অপতথ্য, আচরণবিধি
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন কারণে এবারের নির্বাচন জাতির ইতিহাসে ‘অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ’।
“প্রথমত, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত সংস্কার প্রশ্নে সিদ্ধান্তের নির্বাচন এটি। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে, যা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য এই নির্বাচন হচ্ছে সক্ষমতা প্রমাণ করে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের অনন্য সুযোগ।
“তৃতীয়ত, দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের পর দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার ধারা প্রবর্তনের দাবি রাখে এই নির্বাচন। চতুর্থত, প্রায় অকার্যকর পোস্টাল ভোট ব্যবস্থাকে পরিমার্জন করে এই নির্বাচনে একটি কার্যকরী রূপ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অন্যতম চালিকাশক্তি আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা তথা প্রবাসী বাংলাদেশী ভোটারদের প্রথমবারের মতো ভোটের আওতায় আনা হচ্ছে।
“একইভাবে প্রথমবারের মত ভোটের আওতায় আসছেন আইনি হেফাজতে থাকা ভোটারগণ। এছাড়াও নিজ নির্বাচনী এলাকার বাইরে কর্মরত সরকারি কর্মচারী এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে এবার ভোট দেবেন।”
ভোটের মৌসুমে অপতথ্যের বিস্তার নিয়ে সতর্ক করে সিইসি বলেন, “বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অসত্য তথ্য ও অপতত্ত্বের বিস্তার দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিপক্ষ দল ও প্রার্থীকে হেয় করার পাশাপাশি নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা আমাদের ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ন করে এবং নির্বাচনকে কলুষিত করে।
“দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ অসত্য এবং অসৎ উদ্দেশ্যে প্রচারিত কোনো তথ্যে কান দিবেন না, গ্রহণ করবেন না। মনে রাখবেন অসত্য তথ্য শেয়ার করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক প্রার্থী এবং দলগুলোকে আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, “আসুন আমরা আচরণবিধি মেনে একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসব মুখর নিরবাচন নিশ্চিত করি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে ভোটারদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনই হোক আপনাদের লক্ষ্য নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী।”
নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে যাওয়া কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছতা নিরপেক্ষতা এবং দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর কমিশনের অংশ হিসেবে আপনারা নির্ভয়ে সততা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। মনে রাখবেন, এ ব্যাপারে কোন শিথিলতা বা গাফিলতি সহ্য করা হবে না।”