খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত! দেশজুড়ে উৎকণ্ঠা |
খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার প্রস্তুতি চূড়ান্ত, উৎকণ্ঠায় দেশবাসী
আওয়ামী যুগে নির্যাতিত বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সনকে গত ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার ফুসফুসে সংক্রমণে অবস্থার অবনতি হলে ২৭ নভেম্বর থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে চিকিৎসকরা তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিবিড়ভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। গত সাতদিনেও তাঁর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। রয়েছেন সংকটাপন্ন অবস্থায়। দেশ-বিদেশের চিকিৎসকরা আপোসহীন এই নেত্রীকে সারিয়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো ভালো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের কোটি কোটি মানুষ তাঁর সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন। উদগ্রীব-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। বেগম খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করার পর মঙ্গলবার থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
বুধবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর আগে তিন বাহিনীর প্রধানসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সকল ব্যক্তি দেখে এসেছেন। এদিকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রিচার্ড বিল বুধবার ঢাকায় এসেছেন। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস হাসপাতালের চিকিৎসক, চীন এবং লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের অধীন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নিতে সকল ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা দেখে আসার পর খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা অল্প সময়ের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডনে নিতে সবুজ সঙ্কেত দেবেন। তাঁর আলোকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ যাবতীয় সকল প্রস্তুতির জন্য পরিবার ও দলকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে।
দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তাঁর ফিরে আসা কেবল ইচ্ছার বিষয় নয়- মায়ের চিকিৎসা, পারিবারিক অবস্থান ও নিরাপত্তাসহ বহু দিক বিবেচনা করতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে মায়ের চিকিৎসা নিশ্চিত করাই সন্তানের প্রধান দায়িত্ব। বিশেষ করে যদি খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারেক রহমানের ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত আরও সময় লাগতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও প্রশাসনিক বা আইনি বাধা তেমন নেই । পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাঁর পাস ইস্যু করতেও এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না- তবুও পরিবার ও দলীয় বাস্তবতা জটিল সমীকরণ রয়েছে।
ইতোমধ্যে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিতে ভিসা প্রক্রিয়া, মেডিক্যাল অনুমোদন, বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রাথমিক সব ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন। চিকিৎসার স্বার্থে পরিবার ও দল মনে করছে, এই মুহূর্তে বিদেশে নেওয়াই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ। দলীয় নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লড়াই ও সীমাহীন যন্ত্রণায় ক্লান্ত হলেও কখনো ভেঙে পড়েননি, হাল ছাড়েননি সাবেক সেনা প্রধানের স্ত্রী খালেদা জিয়া। লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন অবিচল। অসীম সাহসের বাতিঘর হয়ে সমস্ত যন্ত্রণাকে পদদলিত করে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন বাংলাদেশের সমন্বিত প্রতিচ্ছবি হয়ে।
যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকরা ঢাকায় ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রিচার্ড বিল ঢাকায় এসেছেন। বুধবার সকালে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। যুক্তরাজ্য থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় নেমে হোটেল থেকে দুপুরে এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। এভারকেয়ার হাসপাতাল সূত্র জানায়, মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে চীনের ১০ সদস্যের একটি চিকিৎসক টিমও কাজ করছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক জাহিদ জানানÑ বিএনপি চেয়ারপার্সনের চিকিৎসা দিতে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, চীন, কাতার, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ইন্ডিয়াসহ আমাদের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধান এই চিকিৎসার বিষয়ে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ডে অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী, অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক এ কিউ এম মহসিন, অধ্যাপক শামসুল আরেফিন, অধ্যাপক জিয়াউল হক, অধ্যাপক মাসুম কামাল, অধ্যাপক এজেড এম সালেহ, অধ্যাপক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুল ইসলাম এবং ডাক্তার জাফর ইকবাল, বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রফেসর হাবিবুর রহমান, প্রফেসর রফিকউদ্দিন আহমেদ এবং প্রফেসর জন হ্যামিল্টন, প্রফেসর হামিদ রব, যুক্তরাজ্য থেকে প্রফেসর জন পেট্রিক, প্রফেসর জেনিফার ক্রস এবং ডাক্তার জুবাইদা রহমানসহ আমেরিকা, ইউকে এবং বাংলাদেশের চিকিৎসকরা কাজ করছেন।
খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার ব্যাপারে ডাক্তার জাহিদ আরও বলেছিলেন, “বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখার পরবর্তীতে উনাকে (খালেদা জিয়া) যদি ট্রান্সফারেবল হয়, আমাদের যদি ট্রান্সফার করার প্রয়োজন পড়ে- মেডিক্যাল বোর্ড মনে করে, তখনই সেই যথাযথ সময়ে উনাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে।”
এভারকেয়ারে নামবে হেলিকপ্টার ॥ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেখানে চিকিৎসাধীন, সেই এভারকেয়ার হাসপাতালের কাছে দুটি মাঠে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার পরীক্ষামূলকভাবে ওঠানামা করবে জানিয়ে এ বিষয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বুধবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, “বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) নিরাপত্তা প্রটোকল অনুযায়ী আজ ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখ ১২০০-১৬০০ ঘটিকার মধ্যে এভারকেয়ার হাসপাতালের নিকটস্থ দুটি উন্মুক্ত মাঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার পরীক্ষামূলক অবতরণ ও উড্ডয়ন পরিচালনা করবে।’’ এ বিষয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।
এভারকেয়ার হাসপাতালে চরমোনাই পীর ॥ রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম (শায়খ চরমোনাই)। বুধবার বিকেলে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে আসেন। এরপর হাসপাতালের অভ্যন্তরে গিয়ে তিনি খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সর্বশেষ অবস্থা ও শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে খোঁজ নেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান এবং যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ।
খালেদা জিয়ার অবস্থার জন্য হাসিনা দায়ী ॥ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার জন্য দায়ী করেছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপি খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া মাহফিলে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান অসুস্থতার জন্য দায়ী শেখ হাসিনা। যিনি নিজের মাটি, দেশ, জনগণ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কখনো আপোস করেননি, তাঁর প্রতি জনগণের ভালোবাসা থাকবেই। সেটিই এখন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ারপার্সনকে মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি করেছিল। দেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়ায় গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া আবারও জনগণের মাঝে ফিরে আসবেন। সারাজীবন দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার কারণেই বেগম জিয়া জনগণের ভালোবাসা পেয়েছেন। শুধু বিএনপি বা এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নয়, পুরো জাতিই আজ তার সুস্থতার জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করছেন।
আওয়ামী সরকারের প্রতিহিংসার শিকার খালেদা জিয়া ॥ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া কোটি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। বুধবার এক দোয়া অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হিসেবে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ থাকবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে মিথ্যা মামলায় হাজির হয়ে কারাবরণ করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। খালেদা জিয়া রাজপ্রাসাদে থেকে রাজনীতি করেননি। তিনি স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জনগণের অধিকার আদায় করেছেন। আর তাই জাতিও তার জন্য উদগ্রীব-উৎকণ্ঠায় আছে।
তারেক রহমানের ফেরা না ফেরা নিয়ে নানা কৌতূহল ॥ রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মায়ের এই কঠিন পরিস্থিতিতে কাছে নেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন এ নিয়ে দলের নেতাকর্মী ছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এক কথায় তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় গোটা দেশ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার সত্যটা অনেক গভীরে। মায়ের জন্য সন্তানের হৃদয়ভাঙা অপেক্ষা, আছে নিরাপত্তার বিষয়।তবে সব কিছু ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদের এই কা-ারি যে দেশে ফিরছেন, তা নিশ্চিত। বিএনপির নেতাদের কেউ বলছেন, দেশে ফেরার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু তা জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের আগে হওয়ার সম্ভাবনা কম। এমনও হতে পারে তিনি মহান বিজয় দিবস পালন করবেন দেশের মাটিতে। আবার কারও মতে, নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হলেই দেশে ফিরবেন। তবে ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। শীঘ্রই যে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে, তা দলটির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, ‘তারেক রহমান শীঘ্রই দেশে ফিরবেন।’ এই ঘোষণার পরই দেশে ফেরার নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।