সোমবার ২৪ নভেম্বর ২০২৫, অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩২, ০৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

ব্রেকিং

হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা সমাপ্ত রুশ হামলায় ইউক্রেনে নিহত ৪, আহত ১৭ ট্রাম্প একজন ফ্যাসিস্ট: মামদানি পাকিস্তান সীমান্ত পুলিশ সদর দপ্তরে আত্মঘাতী হামলায় নিহত ৩ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে ফের চিঠি দেওয়া হয়েছে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হাসিনা, জয় ও পুতুলের দুর্নীতির তিন মামলার রায় ২৭ নভেম্বর ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৭৭৮ রিটার্ন জমার সময় বাড়ল একমাস ভূমিকম্প: ঢাবির বিভিন্ন হলের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পরিদর্শন শুরু ভূমিকম্প: গ্যাস অনুসন্ধান ৪৮ ঘণ্টা বন্ধ ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে গাজায় ‘হামাসের ৫ শীর্ষ সন্ত্রাসী’ নিহত: নেতানিয়াহুর কার্যালয় নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার শঙ্কা নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সিলেট সীমান্তে ‘ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে’ এক বাংলাদেশি নিহত পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নেমেছে ১২ ডিগ্রির ঘরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বৈঠক ভূমিকম্প: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৫ দিন বন্ধ ঘোষণা যুদ্ধবিরতির মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলি ড্রোন ও বিমান হামলায় নিহত ২০

রাজনীতি

শতবর্ষের শিক্ষার আলোকবর্তিকা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ

 প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

শতবর্ষের শিক্ষার আলোকবর্তিকা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ

কুমিল্লা, ২৪ নভেম্বর (বাসস): বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ একটি অনন্য নাম। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ, জ্ঞানচর্চা এবং সমাজ গঠন শেখানোর এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রয়েছে। 

 

আজ ২৪ নভেম্বর। কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ১২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কলেজের প্রতিটি উদ্যোগ, আয়োজন, স্থাপনা ও শিক্ষার মানে প্রতিষ্ঠানের গৌরবময় ইতিহাসের ছাপ চোখে পড়ে।

 

কুমিল্লা অঞ্চলের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায় ১৮৯৯ সালে যুক্তরাজ্যের সেসময়কার রাণী মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নামে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তার এই অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার তাকে রায় বাহাদুর উপাধি দেয়।  

 

কুমিল্লা অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। যা ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রাথমিক অবস্থায় এখানে সীমিত বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হতো। শিক্ষক সংখ্যা কম এবং অবকাঠামোও ছিল সীমিত। তবে শিক্ষার প্রতি আস্থা ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানপিপাসা কলেজকে সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

 

প্রতিষ্ঠার প্রথম দিনে থেকেই কলেজের লক্ষ্য ছিল কেবল পাঠ্য বিষয় শেখানো নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক মূল্যবোধ, নেতৃত্বগুণ এবং সমাজ সচেতনতা বিকাশ। এটি পরবর্তীতে একটি প্রতিষ্ঠিত আদর্শে পরিণত হয়।

 

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলেজটি নিজস্ব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। স্বাধীনতার পর মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য তিন ধারাতেই অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষা চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কলেজের বহু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেন। তাদের অবদান আজও কুমিল্লার শিক্ষা ও ইতিহাসের অংশ হিসেবে সমাদৃত।

 

বর্তমানে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ একটি বিস্তৃত ক্যাম্পাস। যেখানে রয়েছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, গবেষণার সুযোগ এবং বহু বিষয়ের অনার্স-মাস্টার্স প্রোগ্রাম। শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠ্যপুস্তক নয়, গবেষণা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক, নাটক, ক্রীড়া এবং সামাজিক উদ্যোগেও অংশ নেয়।

 

কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল বাশার ভুঁইয়া বাসসকে বলেন,‘আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এখানে ছাত্রছাত্রীরা শুধু জ্ঞান অর্জন করে না, তারা মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। আমাদের লক্ষ্য তাদের মেধা, নৈতিকতা ও মানবিকতা বিকাশ করা। যাতে তারা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

 

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমাদের কলেজের শক্তি হলো : এর বহুমাত্রিক ঐতিহ্য, শৃঙ্খলা, বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ এবং জ্ঞানপিপাসা। শিক্ষার্থীরা শুধু পাশ করার জন্য পড়ে না, তারা শেখে কীভাবে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে হয়। বর্তমান প্রজন্ম ডিজিটাল শিক্ষার সাথে পরিচিত। আমরা চেষ্টা করি ঐতিহ্যকে আধুনিক শিক্ষার সাথে মেলাতে যাতে শিক্ষার্থীরা দুই দিকেই সমৃদ্ধ হয়।’

 

অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী শিক্ষক মু. আবু জাফর বলেন, ‘আমাদের লাইব্রেরিতে অনেক দুর্লভ গ্রন্থ আছে। পুরোনো ইতিহাস, দুর্লভ গবেষণা এবং মূল্যবান দলিল শিক্ষার্থীদের ইতিহাস সচেতন হতে সহায়তা করছে। এই কলেজ শুধু পড়াশোনাই নয়, এটি শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়।’

 

প্রাক্তন শিক্ষার্থী মাহবুব আলম বলেন, ‘এই কলেজ আমার চিন্তা, দৃষ্টি ও জীবন দর্শনকে বদলে দিয়েছে। এখানেই প্রথম নেতৃত্ব, সংগঠন এবং স্বাধীন চিন্তা করার সুযোগ পেয়েছি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল সম্মানজনক। এখানকার শিক্ষকদের কাছ থেকে যে মূল্যবোধ পেয়েছি, তা আজও জীবনের পথচলায় আমার সাথে আছে।’

 

সাবেক ভিপি আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম বাসসকে বলেন,‘এই কলেজ শুধু পাঠ্যক্রম নয়, গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রও। আমরা এখানে বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। বিতর্ক, নাটক, সাহিত্য বা ছাত্র রাজনীতি সব শিখেছি এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এই প্রতিষ্ঠান মানুষ তৈরি করে। আমি বিশ্বাস করি আগামী দিনের নেতা, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও উদ্যোক্তা এখান থেকেই তৈরি হবে।’

 

কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী মৌমিতা পরান নিশি বলেন, ‘ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে পড়তে পারা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের। আমরা জানি আমাদের আগে যারা ছিলেন, তারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন। এই ঐতিহ্য আমাদের দায়িত্ববোধ ও উদ্যম বাড়িয়ে দেয়।’

 

শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণে ইতিহাস আছে। শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, কলেজ মাঠ সবই যেন অতীত ঐতিহ্যের কথা বলে। এখানে পড়াশোনা শুধু জ্ঞান নয়, এটি মানুষের মানসিক ও সামাজিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।’

 

কলেজের গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রেরণার স্থান। এখানে রয়েছে, দুর্লভ ও প্রাচীন গ্রন্থ, গবেষণামূলক বই, ঐতিহাসিক দলিল, বিভিন্ন বিষয়ের রেফারেন্স বই, এটি শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক মনোভাব, ইতিহাস সচেতনতা ও জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছে। লাইব্রেরির এই সমৃদ্ধি কলেজের শিক্ষার মানকে বহুগুণে উন্নত করেছে।

 

অধ্যক্ষ মো. আবুল বাশার বলেন, ‘আমরা চাই এই প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রই নয়, বরং দেশের সমাজ ও মানবসম্পদ গঠনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হোক। শিক্ষার্থীরা এখান থেকে শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান নয়, মানবিক মূল্যবোধ, নেতৃত্বগুণ ও সমাজ সচেতনতা গ্রহণ করবে।’

 

শতাব্দীর ইতিহাস, প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের অর্জন এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সব মিলিয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ আজও দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এটি কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং মানব গঠনের এক মহাকাব্যিক শিক্ষালয়।