বুধবার ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, অগ্রাহায়ণ ১৮ ১৪৩২, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

ব্রেকিং

খালেদা জিয়া-তারেককে নিয়ে এভারকেয়ারের সামনে গুজবের ছড়াছড়ি তারেক এখনও ট্রাভেল পাস চাননি, জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ১২ কেজি এলপিজির দাম বাড়ল ৩৮ টাকা ৮ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট টঙ্গীতে দোয়া-মোনাজাতে শেষ হলো পাঁচ দিনের ‘জোড় ইজতেমা’ খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় এভারকেয়ারে এসএসএফ খালেদা জিয়ার ‘ভিভিআইপি মর্যাদা’ কার্যকরের নির্দেশ সরকারের চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন খালেদা জিয়া, গুজবে কান দেবেন না: ডা. জাহিদ ভোটের প্রস্তুতিতে ‘সন্তুষ্ট’ ইইউ, পর্যবেক্ষণে থাকবে বড় দল: রাষ্ট্রদূত মিলার প্রগতি সরণি আটকে মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ শ্রীলঙ্কায় বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪১০ জন ইউক্রেন চুক্তি নিয়ে ‘খুবই আশাবাদী’ হোয়াইট হাউস ট্রাম্পের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি চমৎকার : চিকিৎসক দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই আমাদের পরিবারের প্রেরণার উৎস: তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান: সালাহউদ্দিন হিলি দিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ মাদুরোর ‘অনেক অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন’ ট্রাম্প বন্যা কেড়ে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ না করতে ইসরাইলকে সতর্ক করলেন ট্রাম্প

অর্থনীতি

পাহাড়ে ‘শ্রম বিনিময়’ প্রথায় গোলায় উঠছে ধান

 প্রকাশিত: ১১:১৩, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

পাহাড়ে ‘শ্রম বিনিময়’ প্রথায় গোলায় উঠছে ধান

পাহাড়ে স্বেচ্ছাশ্রমের বিনিময়ে একে অপরের ধান কাটা, মাড়াই শেষে কৃষকের গোলায় তুলে দেওয়ার সামাজিক রীতি দীর্ঘদিনের। এতে একদিকে কৃষকের খরচ যেমন বাঁচে, ঠিক তেমনি সময়ও বাঁচে।

যদিও ‘শ্রম বিনিময়’ প্রথায় যারা কাজ করেন তাদের কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না; তবে সবার জন্য ভোজের আয়োজন করেন কৃষক। তিনি নিজেও অন্যদের জন্য এভাবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকেন।

পাহাড়ের নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা এই শ্রম বিনিময় প্রথাকে ‘লাক্চা’ বলে থাকেন। অন্য কাজের ক্ষেত্রেও এই শ্রম বিনিময় প্রথা থাকলেও পাহাড়ে প্রত্যেকটি জাতি-গোষ্ঠীর করা সমতল জমিতে ধান চাষ ও জুমচাষের ক্ষেত্রে এর প্রচলন সবচেয়ে বেশি।

এখন আমন ধান সংগ্রহের কাজ চলছে পাহাড়ের সবখানে। তাতে কোনো কৃষককে মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক নিতে হচ্ছে না। পালাক্রমে সবারই ধান কাটা, মাড়াই ও ফসল তোলার কাজ চলে ‘শ্রম বিনিময়’ প্রথার মাধ্যমে।

সম্প্রতি বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের তুংখ্যং পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, এক কৃষক পরিবারের এক কানি (৪০ শতক) ধানি জমি একদিনেই কাটা, মাড়াই ও গোলায় তোলার কাজ শেষ করা হয়। এখানকার কাজে মোট ১৪ জন পাড়াবাসী বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়েছেন।

ধান কাটার পর মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ট্রাক্টর। ট্রাক্টরে এক পাশে বিশেষ কায়দায় পাখা লাগিয়ে বাতাস দিয়ে ধান পরিষ্কার করা হয়। এতে আরো বেশি দ্রুত সম্পন্ন হয় ধান মাড়াইয়ের কাজ।

স্থানীয়রা বলছেন, এতে একদিকে যেমন ‘শ্রম বিনিময়’ প্রথার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে, অন্যদিকে সামাজিক মূল্যবোধের চর্চাও হচ্ছে।

জমির মালিক মংহ্নাই মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এক কানি ধানি জমির ধান কাটতে সাত-আট দিন সময় লাগত। পাড়াবাসী বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করায় এক দিনেই শেষ হয়। তিনজন শ্রমিক আট দিনের জন্য নিতে গেলে সাড়ে চৌদ্দ হাজার খরচ হত। এখন একদিনেই কাটা, মাড়াই ও ধান ঘরে তোলার কাজ শেষ। বাকি সময়টাতে ঘরে অন্য কাজ করার সুযোগও পাব।”

“তবে এখানে এসে যারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন, কোনো এক সময় আমাদের পরিবারের কাউকে তার ওখানে গিয়ে এভাবে বিনাশ্রম দিতে হবে। যারা ধানি জমি চাষ করে অথবা জুমচাষ করে প্রত্যেককে পর্যায়ক্রমে বিনাশ্রম পরিশোধ করতে হবে।

“মারমা ভাষায় আমরা এটাকে ‘লাক্চা’ বলে থাকি। আমার এখানে আজ ১৪ জন এসেছেন। পর্যায়ক্রমে সবার কাছে বিনাশ্রম পরিশোধ করতে হবে- এটা বাধ্যতামূলক। র্দীঘদিন ধরে আমরা এই ‘লাক্চা’ (শ্রম বিনিময়) প্রথার চর্চা করে আসছি।”

শ্রম দিতে আসা লোকজনদের যার যার সাম্যর্থ অনুযায়ী খাওয়ানোর নিয়ম আছে জানিয়ে মালিক মহ্নাই মারমা বলেন, “সারাদিন এখানে যারা শ্রম দিয়েছেন তাদেরকে রাতে ভাত খাওয়ানো হবে। দুপুরেও খাওয়ানো হয়েছে।

“যাদের পানি (ঐতিহ্যবাহী মদ) পানের অভ্যাস আছে তাদের আনন্দ-মজা করার জন্য এগুলো আপ্যায়ন করা হবে। অনেকেই খাওয়ার অভ্যাস নাই। তারা হয়ত খাবে না।”

মাড়াই শেষে বস্তায় ভরে সবাই মিলে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে ধান। এক কানি বা ৪০ শতক জমি থেকে মোট ৯০-৯৫ হাঁড়ি ধান পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা সুইসিংউ মারমা বলেন, ধান চাষের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। জমি প্রস্তুত করে চারা রোপণ করা, আগাছা পরিস্কার করা, ধান কাটা, মাড়াইয়ের করা এবং সর্বশেষ ধান ঘরে তোলা। এই সব প্রতিটি ধাপেই একে অপরকে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে।

“আজকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুরো একবেলা ধান কাটা হয়েছে। দুপুর পর্যন্ত ধান শুকানোর সুযোগ দিয়েছি। দুপুরের পর একনাগাড়ে মাড়াইয়ের কাজ চলে। এরপর ধান থেকে খড় বাছাই করা, পরিষ্কার করা এবং ধান বস্তা ভরতে বেশি সময় লাগেনি।”

স্বেচ্ছাশ্রমের সুবিধার দিক তুলে ধরে সুইসিংউ মারমা বলেন, এতে একজন চাষির অনেক খরচ বেঁচে যায়। এরপর এক বা দুই দিনেই ধান কাটা, মাড়াই এবং ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়ে যায়। সব চাষির সামর্থ্য একই রকম হয় না। যার কারণে অস্বচ্ছল চাষিরা অল্প খরচে ধান ঘরে তোলার সুযোগ পায়।

“এ ছাড়া স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া আমাদের প্রথা-রীতির মত হয়ে গেছে। একজন ধান কাটতে, মাড়াই করতে দেখলে পাড়ার যে কেউ গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে সহযোগিতা করে আসতে পারে।”

স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা এক নারী সদস্য চিংক্যোয়াই মারমা বলেন, “আগে থেকেই পাহাড়ে এই ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের প্রথা চলে আসছে। সবাই মিলে মাঠে এক সঙ্গে কাজ করছে। সবাই মিলে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করছে। সবকিছু করে পুরো এক দিনেই ধান ঘরে তোলা যায়- এগুলো একদিকে আমাদের প্রথা ও ঐতিহ্যগত দিক। আরেকদিকে ভাল লাগাও কাজ করে।”

এদিন তুখ্যং পাড়ায় ধানক্ষেতের মাঠে পাশাপাশি আরো দুই চাষির শ্রম বিনিময় প্রথায় আমন ধান সংগ্রহের কাজ চলছে। তবে সেখানে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা লোকজন কম। একেকটাতে সাত-আটজন করে রয়েছে। তখন বিকাল হয়ে আসায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ে কাজ শেষ। ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বস্তায় ভরানো হচ্ছে ধান।

স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা লোকজন জানান, আগের দিনে গরু দিয়ে মাড়াইয়ের কাজ চলত। সপ্তাহ-দশ দিন লেগে যেত। লোকবলও বেশি লাগত। পরিবারে সকল সদস্যদের শুধু ধান মাড়াইয়ের কাজে লেগে থাকত হত। ধান চাষের মেশিন ট্রাক্টর চলে আসায় অনেক সহজ হয়েছে। ধান কাটতে যত সময় লাগে, মাড়াই করতেও এত সময় লাগে না এখন। এই দুই চাষির পক্ষ থেকেও স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা লোকজনদের জন্য রাতে খাওয়া-দাওয়া আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তারা।

পাহাড়ে এই ‘শ্রম বিনিময়’ প্রথাকে প্রতিবেশিসুলভ আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক এম এম শাহ নেওয়াজ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে চাষাবাদের ক্ষেত্রে জুমের ফসল কর্তন বা অন্য ফসল সংগ্রহের সময় প্রতিবেশি কৃষকরা একটা নির্দিষ্ট কৃষি জমিতে স্বেচ্ছায় বিনাপারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে থাকে। তার একটা সুবিধার দিক হল ফসল কর্তন বা সংগ্রহের উপযোগি হলে দ্রুত ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘরে তোলা সম্ভব। ওই কৃষকও পরবর্তীতে তার ফসল কর্তনের সময় তাকে সহযোগিতা করে।

‘‘এভাবে পর্যায়ক্রমে পরস্পরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবাই ফসল ঘরে তুলতে পারে। তার মাধ্যমে প্রতিবেশিসুলভ আন্তরিকতাও প্রকাশ ঘটে। একসময় সমতলের কৃষির ক্ষেত্রেও এটা প্রচলন ছিল। এখন আর নেই। পাহাড়ে এখনও প্রচলন রয়েছে। এভাবে কৃষকরা একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করা এটা সারাদেশে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’’

এদিকে কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বান্দরবান জেলায় আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭৫০ হেক্টর এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ৪৯৯ মেট্রিকটন। তার মধ্যে এই অর্থবছরে আমন ধানের আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ২৪১ হেক্টর জমিতে। আমন ধানের কর্তন এখনও চলমান।