রোববার ১৯ অক্টোবর ২০২৫, কার্তিক ৪ ১৪৩২, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

ব্রেকিং

ইসির চাপিয়ে দেওয়া প্রতীক নেবে না এনসিপি: হাসনাত আব্দুল্লাহ বাড়ি ভাড়া ৫ শতাংশ প্রত্যাখ্যান, শিক্ষকদের আন্দোলন চলবে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রাম্পবিরোধী ‘নো কিংস’ বিক্ষোভে মানুষের ঢল আত্মসমর্পণের পর ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতা মোশাররফ কারাগারে শাহজালালে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি গঠন ব্রাজিলে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অন্তত ১৭ গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে এক পরিবারের ১১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা ইসরায়েলের পর্যটকরা নভেম্বর থেকে সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন: পরিবেশ উপদেষ্টা আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা নিয়ে আপিল শুনানি ২৮ অক্টোবর অনশনের মধ্যেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া আরেকটু বাড়ল

জাতীয়

বিমানবন্দরে কার্গো কমপ্লেক্সে আগুন: সবই পুড়ল অবহেলায়? ক্ষতিপূরণের কী হবে?

 প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১৯ অক্টোবর ২০২৫

বিমানবন্দরে কার্গো কমপ্লেক্সে আগুন: সবই পুড়ল অবহেলায়? ক্ষতিপূরণের কী হবে?

ছোট্ট একটু আগুন, রূপ নিল ভয়াবহতায়; সাত ঘণ্টা ধরে জ্বলার পর নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হল ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। তবে এর আগেই দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের গুদামে রাখা পণ্যের বেশির ভাগই পুড়ল।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এমন স্থাপনায় শনিবার দুপুরের দিকে শুরু হওয়া আগুন এত সময় ধরে জ্বলার পরও নিয়ন্ত্রণ আনতে না পারা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন এসব পণ্য আমদানির কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অথচ বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাধ্যবাধকতার অংশ হিসেবে প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপন মহড়া হয়। ডামি উড়োজাহাজ তৈরি করে সেটিতে আগুন লাগানোর পর ছুটে আসেন বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটের অত্যাধুনিক ‘এয়ারপোর্ট ক্রাশ টেন্ডারগুলো’।

ওই সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও ছোটাছুটি করে আগুন নিভিয়ে বেশ বাহবা কুড়ান। কিন্তু বাস্তবে যেদিন বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুনের শিখা বাড়তে বাড়তে লেলিহান হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকল তখন ফায়ার সার্ভিসের সেই তৎপরতা দেখা যায়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

আর মাত্র ছয় দিন আগে ১২ অক্টোবর দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রক ও পরিচালনাকারী সংস্থা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি) শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো শাখার অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূল্যায়ন করে শতভাগ নম্বর দিয়েছে। সংস্থাটির তরফে এটিকে বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখানো হয়।

এর এক সপ্তাহ না গড়াতেই ভয়াবহ এ আগুন ওই সাফল্যের সঙ্গে বিমানবন্দরের ভাবমূর্তিতেও ধস নামিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই ‘ঢাকা বিমানবন্দরে আগুনের কারণে ফ্লাইট বিপর্যয়ের’ খবরটি দিয়েছে।

দেশের প্রধান বিমানবন্দরটির আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের আগুনের সূত্রপাতের পর যথেষ্ট সময় হাতে থাকার পরেও তা নেভানো যায়নি বলে অভিযোগ এখানকার ওয়্যারহাউজ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আগুন অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে রাসায়নিক থাকতে পারে এরকম সন্দেহ থেকে পানি ছেটাতে ফায়ার সার্ভিসের রক্ষণশীল আচরণের কারণে আগুন পুরো কমপ্লেক্সে ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

কার্গো কমপ্লেক্সে আমদানি-রপ্তানির কাজে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করা ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্টরা প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে দাবি করছেন, ব্যবসায়ীদের অন্তত কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে সেটা নিয়েও তারা দুশ্চিন্তায় পড়ার কথা বলেছেন। সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কেউ কিছু বলছে না বলে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন।

আগুন নিয়ে সূত্রপাতের বিষয়ে বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগুন লেগেছে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে।

আর ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, তারা আগুনের খবর পেয়েছে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে। তাদের প্রথম গাড়িটি সেখানে পৌঁছে ২টা ৫০ মিনিটে।

দুই সরকারি ভাষ্যের সময়ের ব্যবধানে দেখা যায় আগুন লাগার অন্তত ৩৫ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের প্রথম গাড়িটি সেখানে পৌঁছে।

যদিও ফায়ার সার্ভিসের আগেই বিমানবন্দরে মোতায়েন করা বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। তবে তারাও ‘দেরি করেছে’ বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।

বেবিচকের অধীনে বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক মোতায়েন করা ফায়ার ইউনিটে রয়েছে অত্যাধুনিক একাধিক অগ্নিনির্বাপন গাড়ি। রোজেনবাওয়ার প্যানথার সিরিজের অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট ক্রাশ টেন্ডারগুলোতে রয়েছে উচ্চশক্তিসম্পন্ন পাম্প, যেগুলো দিয়ে অনেক দূর থেকে অগ্নিকাণ্ডস্থলে পানি বা ফোম ছিটানো যায়। এই গাড়িগুলোতে পানি ও ফোম উভয়েরই ব্যবস্থা রয়েছে।

তবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের দাবি, বেবিচকের ইউনিট তেমন কিছুই করতে পারেনি। আগুন লাগার প্রাথমিক পর্যায়ে সেখানে কর্মরত যেসব কর্মী সেটি নেভাতে গিয়েছিল তাদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।

এ ওয়ান নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ ও লজিস্টিক কোম্পানির পরিচালক ইমরান হোসাইন বলেন, “ভাই আগুনটা লাগছে কুরিয়ারের গুদাম থেকে। ওখানে ২৫ থেকে ৩০টি কুরিয়ার সার্ভিসকে কিউবিকলের মতো খোপ খোপ করে জায়গা দেওয়া হয়েছে, যেটাকে আমরা বলি ‘খাঁচা’। এরকম একটি ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার ডিএইচএলের খাঁচা থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাতের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু লোকজন যখন নেভাতে যায় তখন তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

“কুরিয়ারে অনেক দামি পণ্য থাকে, হয়তো এসব পণ্য চুরি যেতে পারে সে কারণে লোকজনকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তারা নিজেরাই আগুন নেভাতে চেষ্টা করছিল। আবার কাউকে কাউকে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে এখানে বিস্ফোরক ও কেমিকেল আছে।”

এ বিষয়ে ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের সাকিব নামে একজন কর্মী বলেন, বিমানবন্দরে আগুন বা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তাদের কোনো তথ্য বা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে কাস্টমার কেয়ার সেন্টার অবগত নয়।

আমদানি কার্গো ওয়্যারহাউজ বা গুদামটি আকারে বেশ বড় হলঘরের মত। এখানে সংস্থাগুলোকে ছোট ছোট খোপ আকারে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া আছে। এর মধ্যেই পণ্যের ধরণ অনুযায়ী পৃথক গুদামও আছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর পশ্চিম কোণে অবস্থিত গুদামটি দৈর্ঘ্যে ৪০০ গজ (১২০০ ফুট) ও প্রস্থেও ৪০০ গজ বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। সেই হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৪ লাখ বর্গফুট জায়গা জুড়ে গুদামটির অবস্থান।

বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে সরকারি এয়ারলাইন বিমান বাংলাদেশ। তাদের কর্মীরা আগুন লাগার সময় ওই গুদামে মালামাল আনা-নেওয়ার কাজ করছিলেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় কার্গো কমপ্লেক্সের বাইরে। এদের মধ্যে একজন বলছেন, বেলা ২টার পর সেখানে অ্যালার্ম বেজেছে। এরপরই তারা বের হয়ে আসেন।

আরেকজন বলেন, “আমাদের কিছু লোকজন যখন আগুন নেভাতে কুরিয়ার গুদামে গেছে তখন তাদের বলা হয়েছে এখানে বিস্ফোরক, অস্ত্র-গোলাবারুদ থাকতে পারে। আপনারা সরে যান। তখন আমরা সরে যাই।”

নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করে এই কর্মীর ভাষ্য, “তবে ভাই পুরো কার্গো গুদামে অনেক ক্যামেরা লাগানো আছে। গুদামে একটা সুই পড়ে থাকলেও সেই ক্যামেরায় দেখা যায়। সেই ক্যামেরায় দেখলেই পাওয়া যাবে আগুন কখন-কীভাবে লাগলো।”

তবে সেখানে থাকা কয়েকজন বলেন, স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারলাইনের গুদাম থেকে আগুন শুরু হয়ে সেটি ডিএইচএল কুরিয়ারের খাঁচায় গিয়ে লাগে। পরে সেখান থেকে বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম ‘ডেঞ্জারাস গুডস‘এ ছড়ায়।

তবে সবারই ভাষ্য, ফায়ার সার্ভিস কাজ শুরু করার আগেই আগুন অনেকখানি ছড়িয়ে পড়ে।

শাহজালাল বিমানবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, “২টার দিকে আগুনটা লাগে। সেখানে তখনও অনেক শ্রমিক, আনসারসহ লোকজন ছিল। কিন্তু আগুন লাগার পর নেভাতে এগিয়ে যাওয়া লোকজনকে আনসারসহ অন্যান্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয় এই গুদামে গোলাবারুদসহ কেমিকেল রয়েছে, বিস্ফোরণ হইতে পারে। সবাই সরে যান।"

তার অভিযোগ, “আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর গেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিল না।"

ফায়ার সার্ভিসকে প্রথমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি এরকম অভিযোগ সম্পর্কে বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আপনি বললেন, আমরা খতিয়ে দেখব। তবে এরকম হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।”

ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এখানে ঢুকতে বাধা পেয়েছিল কি না জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, “আমি এরকম কিছু শুনিনি। তবে এটা একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এখানে ঢুকতে হলে একটু বুঝে-শুনেই ঢুকতে হয়।”

তিনি বলেন, “আমরা ১৪টা ৩০ (আড়াইটায়) এ খবর পেয়েছি তারপর আমরা মুভ করেছি।”

আগুন নিয়ন্ত্রণে বেশি সময় লাগার কারণ হিসেবে ‘বাতাসের বাধার’ কথা তুলে ধরেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।

শনিবার দুপুর ২টার দিকে লাগা আগুন সাত ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আনার পর আগুনের ঘটনাস্থলে কাছে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটে বিফ্রিংয়ে আসেন তিনি।

আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আসলে আগুন নেভাতে এসে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বাতাস। যেহেতু এটা খোলা জায়গা, প্রচুর বাতাস ছিল। ফলে অক্সিজেনের একটা প্রাপ্তি সবসময় ছিল, যেটা আগুনকে জ্বালাতে সহায়তা করে। যে কারণে আপনারা অনেক উপর পর্যন্ত ধোঁয়া দেখতে পেয়েছেন।”

আগুনের সূত্রপাত কীভাবে- এমন প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, “আগুনের সূত্রপাতটা আমরা এখনো… এটা আসলে আগুন নেভানোর পরে বলা যাবে, তদন্ত সাপেক্ষে। এখন আমরা এটা বলতে পারছি না।

ফায়ার সার্ভিস সেখানে আসার আগে বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট কাজ করেছিল বলে জানিয়ে ফায়ারের মহাপরিচালক বলেন, “আমরা যখন আসি, তখন আমাদের এখানে অ্যাভিয়েশনের যে ফায়ার ফাইটিং ভেহিক্যাল ছিল, সেগুলোও কাজ করছিল। এখন পর্যন্ত আমাদের ৩৭টা ইউনিট কাজ করেছে। এবং এর মধ্যে এখন পর্যন্ত আমাদের জানামতে কোনো নিহত নাই।”

কার্গো কমপ্লেক্সে রাসায়নিক থাকা বিষয়ক এক প্রশ্নে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, “আমাদের কাছে কিছু তথ্য ছিল আমদানি করা কেমিকেল রয়েছে। সেজন্য আমাদের অতিরিক্ত সাবধানি হতে হয়েছে।”

ফায়ার সার্ভিসের দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ডেঞ্জারাস গুডসের’ গুদামে পোশাক ও ওষুধ শিল্পের অতি দাহ্য রাসায়নিকের পাশাপাশি কিছু উচ্চ দাহ্য জ্বালানি রয়েছে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসকে। যে কারণে কিছু জায়গায় পানির বদলে শুধু ফোম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত দেন কর্মকর্তারা।

ক্ষয়ক্ষতি কত, দেবে কে?

শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো কমপ্লেক্সের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকে। যে কারণে সেখানে সিঅ্যান্ডএফ কোম্পানিগুলোর কর্মীদের সেখানে ভিড় থাকে না। কুরিয়ারের কাজ চলে আধাবেলা। তবে কার্গো লোডিং আনলোডিংয়ের কাজ চলে সারাক্ষণই।

আগুন লাগার খবর পেয়ে দুপুরের পর থেকেই সিঅ্যান্ডএফ কোম্পানিগুলোর লোকজন সেখানে ভিড় করতে শুরু করেন। কার কত টাকার মালামাল পুড়েছে তা নিয়ে হিসাব করতে দেখা যায় অনেককে।

ফাস্ট অ্যান্ড সেইফ লজিস্টিকস নামে একটি কোম্পানির কর্মকর্তা আব্দুল মোমিন মণ্ডল বলছিলেন, বিমানবন্দরে আমদানি করা পণ্যের এ গুদামে তাদের চামড়া, ফ্যাব্রিকস (কাপড়), সুতা, লেইস ও ইলাস্টিক পণ ছিল- যেগুলো সাভার ও চট্টগ্রামের কয়েকটি কোম্পানির হয়ে তাদের ছাড়ানোর কথা ছিল। এগুলোর সবই পুড়েছে বলে তারা শুনেছেন।

এই কর্মকর্তার ভাষ্য, “যখন আগুন লাগছে বলে আমরা শুনছি তখনো এখানে অনেক লোক ছিল। কিন্তু লোকজনকে আগুন নেভাতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, ফায়ার সার্ভিসও আসছে অনেক দেরি করেই।”

বিমানবন্দরের আমদানি পণ্যের কার্গো কমপ্লেক্সের উল্টো দিক ৮ নম্বর গেটের কাছে গাড়ি পার্কিংয়ের কাছে অনেক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও লজিস্টিকস কোম্পানির লোকজন নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষছিলেন।

এদের একজন ‘এ ওয়ান গ্রুপ ‘র পরিচালক ইমরান হোসাইন বলছিলেন, তার তিনটি চালানে কয়েক কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য, খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য ছিল। দুটি চালান পুড়েছে আর একটি চালান কী অবস্থায় আছে সেই খবর তিনি নিতে পাননি। ওই চালান নিয়ে আসা কার্গো এয়ারক্রাফটটি শনিবার দুপুরেই শাহজালালে নেমেছিল।

আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ইমরান বলছিলেন, উড়োজাহাজ থেকে মালটা নামিয়ে এখানে নিয়ে আসে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার বিমানের শ্রমিকরা। এরপর সেটা কাস্টমস হাউজের একটা স্ক্যানার মেশিনে স্ক্যানিংয়ের পর গুদামে রাখা হয়। পণ্য অনুযায়ী কর পরিশোধের কাগজপত্র জমা দিয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা সেগুলো কাস্টমসের কাছ থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন।

তিনি বলেন, শুক্র ও শনিবার দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এই দুইদিনের জমা থাকা মালামাল জমে যায় গুদামে। বেশির ভাগ সময়ই ছুটির দিনগুলোতে গুদামে আর মাল রাখার জায়গা থাকে না, সেগুলো খোলা আকাশের নিচেই থাকে।

এই খোলা জায়গায় থাকা মালামালগুলোও বাঁচানো যায়নি বলে আক্ষেপ করছিলেন ইমরান।

শাহজালাল বিমানবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলছিলেন, “এখানে মালামালের দায়িত্ব তো গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার বিমানের। তাদের ওপরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাদেরই এটা নিরাপত্তা দিয়ে রাখার কথা। এজন্য তারা পণ্যপ্রতি আমাদের থেকে চার্জ নেয়। এখন ব্যবসায়ীদের এই শত শত কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?”

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ইমরান হোসাইন বলেন, “আমার প্রত্যেকটা মালের জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার বিমান আর শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ পৃথক চার্জ নেয়। এখন মালের ক্ষতিপূরণ দেবে কে- সে বিষয়ে তারা আমাদের কিছুই বলছে না।

“আমার যে বীমা করা আছে তা ৬০০০ ডলার পর্যন্ত কভার করার কথা কিন্তু এখানে ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি টাকার। এখানে আমার এমনও মাল আছে যেগুলোর ট্যাক্স আমি বৃহস্পতিবার পরিশোধ করেছি, কিন্তু সন্ধ্যা ৭টা বেজে যাওয়ায় কাস্টমস মাল দেয়নি। এখনতো মালও গেল, ট্যাক্সের টাকাও গেল। বসে বসে শুধু হিসাব করতাছি কত লস গেল।”

ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলছেন, “বিমানের কার্গো পরিচালককে আমি বলেছি, যে ম্যানিফেস্টের রেফারেন্সে পরিমাণগত ও মূল্যগতসহ সাত-আটটা মোটা দাগের ক্যাটাগরিতে একটা স্টেটমেন্ট তৈরি করতে বলেছি। হয়ত ঘণ্টাখানেক বাদে সেটা হাতে আসবে।”

তদন্তে সরকারি উদ্যোগ

এ ঘটনা তদন্তে বিমান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) পৃথক দুটি কমিটি গঠন করেছে।

আইআরডি গঠিত কমিটিকে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

আর বিমানের কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের কারণ, দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ ও ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ করতে বলা হয়েছে।

নাশকতা না দুর্ঘটনা

বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা এমন প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মাঝেও। বিএনপির তরফেও পূর্ব পরিকল্পিত কি না তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরপর তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এমন প্রশ্ন উঠেছে।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।

বিবৃতিতে বলা হয় “দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার তা গভীরভাবে অবগত। আমরা সকল নাগরিককে আশ্বস্ত করতে চাই— নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে।

“নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।”

বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই–যদি এসব অগ্নিকাণ্ড নাশকতা হিসেবে প্রমাণিত হয়, এবং এর উদ্দেশ্য হয় জনমনে আতঙ্ক বা বিভাজন সৃষ্টি করা, তবে তারা সফল হবে কেবল তখনই, যখন আমরা ভয়কে আমাদের বিবেচনা ও দৃঢ়তার ওপর প্রাধান্য দিতে দেব। বাংলাদেশ অতীতেও বহু কঠিন সময় অতিক্রম করেছে। আমরা ঐক্য, সংযম ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে যেকোনো হুমকির মোকাবিলা করব। আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

তবে বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিমানবন্দরে ঘটনাস্থলে কিছু সাংবাদিকের মুখোমুখি হন উপদেষ্টা। বলেন, “আপনার এত দ্রুত এই প্রশ্ন করাটা কী ঠিক। এটা একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে নাশকতা না এটা দুর্ঘটনা… এটা কী আপনি চান যে আমি একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে দেব এখন? এটা কী একটা সঠিক প্রশ্ন?

“এই সময়ে আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে এয়ারপোর্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করা ও ক্ষতি নিরূপণ করা।”

‘নাশকতা কি না’ আরেক সাংবাদিকের একই প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “এখন এই প্রশ্নের কোনো যৌক্তিকতা নাই।”