হাড়কাঁপানো শীতে স্থবির লালমনিরহাটের জীবনযাত্রা
টানা কয়েক দিনের ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে জেলার জনজীবন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে সড়কে যানবাহন ধীরগতিতে চলাচল করছে। নেহাত প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না।
শীতের প্রকোপে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন শিশু, নারী ও বয়স্করা। গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের ও দুস্থ মানুষ বিশেষ করে দিনমজুর, ছিন্নমূল ও চর এলাকার বাসিন্দারা পর্যাপ্ত শীতের কাপড় না থাকায় চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। শীতার্তরা খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে বাধ্য হচ্ছেন।
পার্শ্ববর্তী নদী ও হিমালয়ের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলে শীতের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। আকাশে সূর্যের দেখা না পাওয়ায় ঠান্ডার তীব্রতা আরও বেড়েছে।
এ অবস্থায় কৃষক ও শ্রমিকরাও বিপাকে পড়েছেন। মাঠে থাকা ভুট্টা, সরিষা, গম, আলু ও আমনের বীজতলায় কাজ করতে পারছেন না। ঘন কুয়াশার কারণে দীর্ঘ সময় ক্ষেতে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে সর্দি, কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টসহ শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র জানান, আজ এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কুলাঘাট ইউনিয়নের বাড়ি বনমালী এলাকায় তীব্র শীতে শীতার্ত দুস্থ মানুষের দুর্ভোগ চরমে। ৭৮ বছর বয়সি সোনাভান বেগম বাসসকে বলেন, পুরোনো একটি কম্বল আছে। তাতে শীত মানে না। তিনি এখনও কোনো সহায়তা পাননি। আর্থিক অক্ষমতার কারণে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন।
একই এলাকার ৬৮ বছর বয়সি বাছরন বিবি জানান, একটি চাদর ও পাতলা কাঁথাই তার ভরসা। প্রচণ্ড ঠান্ডায় ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। বেশিদিন এই অবস্থায় থাকলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে জেলার খেটে খাওয়া শ্রমিক ও দিনমজুররা কনকনে ঠান্ডার মধ্যেই জীবিকার তাগিদে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শীতের দাপটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে।
আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের হোটেল শ্রমিক আকবর মিয়া বাসসকে বলেন, পেটের তাগিদে কাজ করি। তাই রাত-দিন কষ্ট সহ্য করেই কাজ করতে হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের অটো রিকশাচালক তাহের আলী বলেন, কাজ না করলে সংসার চলবে না। তাই শীতের মধ্যেই রিকশা চালাই।
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের কৃষিশ্রমিক আজিজুল হক বলেন, প্রচণ্ড ঠান্ডায় হাত-পা বরফের মতো হয়ে গেলেও জীবিকার তাগিদে মাঠে কাজ করতে হচ্ছে।
জেলা সদরের কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস আলী ও বড়বাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হুদা লিমন বাসসকে জানান, তাদের ইউনিয়নে পাঁচ হাজারের বেশি শীতার্ত মানুষ থাকলেও সরকারি বরাদ্দের কম্বল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে শীতবস্ত্রের সুষ্ঠু বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনায় চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
তারা বলেন, বিগত বছরগুলোতে বেসরকারিভাবে কিছু সহায়তা পাওয়া গেলেও চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সহায়তা মেলেনি। শীতার্ত মানুষের দুর্ভোগ কমাতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি কম্বল বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান তারা।
জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সামিরা হোসেন চৌধুরী বাসসকে জানান, তীব্র শীতে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে এবং শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বহু শিশু হাসপাতালে আসছে। সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া বেশি দেখা যাচ্ছে। কিছু শিশুর শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও খিঁচুনিও রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে কয়েক দিনের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখা এবং শিশুদের গরম পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. সাইখুল আরিফিন বাসসকে বলেন, শীত ও ঠান্ডার মধ্যে আপাতত ফসল নিরাপদ রয়েছে এবং কৃষকদের ক্ষতি রোধে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বাসসকে জানান, জেলায় ইতোমধ্যে কিছু কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। শীতার্ত মানুষের চাহিদা বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত ৫০ হাজার কম্বলের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এ খাতে প্রায় ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কম্বল কেনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। শীঘ্রই দুর্গম এলাকাগুলোতে কম্বল বিতরণ করা হবে।