টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হয়েছে তাবলীগ জামাতের ৫ দিনের জোড় ইজতেমা।
টঙ্গীর তুরাগ তীরে ৫ দিনের জোড় ইজতেমা শুরু: লাখো মুসল্লির ঢল, নিরাপত্তায় কঠোর নজরদারি
গাজীপুর প্রতিনিধি ❘
টঙ্গীর তুরাগ তীরে আজ শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) ভোরে বাদ ফজর আনুষ্ঠানিক আনবায়ান এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে তাবলীগ জামাতের ৫ দিনের জোড় ইজতেমা। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ বৈশ্বিক ইজতেমার প্রস্তুতি হিসেবে প্রতিবছর এই জোড় ইজতেমা আয়োজন করা হয়। এবারের জোড়েও দেশ-বিদেশ থেকে চিল্লায় থাকা মুরব্বি ও সাথীরা ব্যাপক সংখ্যায় উপস্থিত হয়েছেন।
ইজতেমা মাঠজুড়ে সকাল থেকেই ভেসে আসে পশ্চাৎপটের মধুর কালাম, দোয়া ও শ্রবণযোগ্য তাকরীর। মাঠে প্রবেশের প্রতিটি গেটেই মুসল্লিদের ভিড় বাড়তে শুরু করে ফজর নামাজের আগে থেকেই।
জোড় ইজতেমার তাৎপর্য
জোড় ইজতেমা আসলে মূল ইজতেমার প্রস্তুতিমূলক ইবাদত-সাম্মেলন। এতে—
সারা দেশের এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চিল্লা করে আসা সাথীরা একত্রিত হন,
দাওয়াত-তাবলীগের কাজের অগ্রগতি ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়,
বার্ষিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়,
আসন্ন বিশ্ব ইজতেমার বিন্যাস, মাঠ পরিকল্পনা, দায়িত্ব বণ্টন, খেদমত, ব্যবস্থাপনা—সবকিছু এখানে নির্ধারিত হয়।
তাবলিগ জামাতের শুরায়ি নেজাম-এর দেশের মুরব্বিরা আজকের প্রথম বয়ানে মুসল্লিদের উদ্দেশে দাওয়াতের গুরুত্ব, আমল বাড়ানো এবং দাওয়াতি কাজ বিস্তারের ওপর জোর দেন।
দেশ-বিদেশের মুসল্লিদের স্রোত
জোড় ইজতেমায় কেবল দেশের মুসল্লিরাই নন, বরং ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের সাথীরাও অংশ নেন।
তাদের অনেকেই চিল্লা সম্পন্ন করে এই জোড় উপলক্ষে বাংলাদেশে আসেন, যাতে মুরব্বিদের ইলম, তাজকিয়া ও দিকনির্দেশনা থেকে উপকৃত হতে পারেন।
বিদেশি অতিথিদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড তাঁবু, বিশেষ খাবার ব্যবস্থা ও দোভাষী সেবা রাখা হয়েছে।
মাঠজুড়ে ব্যস্ততা: ওয়াশরুম, রান্না, পানি সরবরাহে স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতা
ইজতেমা মাঠে হাজারো স্বেচ্ছাসেবক গত কয়েকদিন ধরে কাজ করছেন।
দেখা গেছে—
প্রতিটি খিত্তায় নতুন তাঁবু টানানো,
মাইকিং সিস্টেম স্থাপন,
বিশুদ্ধ পানির লাইন পরীক্ষণ,
অস্থায়ী শাওয়ার ও টয়লেট স্থাপন,
রান্না-ঘর স্থাপন,
আগত মুসল্লিদের গাইড করা,
হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য সাহায্য কেন্দ্র।
টঙ্গী ও আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দারাও ব্যস্ত—কেউ রিকশা-ভ্যান করছেন, কেউ ইজতেমা মাঠে কাঠ, কয়লা, রুটি, সবজি ও নানান ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করছেন।
কঠোর নিরাপত্তা
টঙ্গী তুরাগ তীরজুড়ে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পুলিশ, র্যাব, আনসার ও গোয়েন্দা সদস্যরা মাঠের প্রতিটি কর্নারে মোতায়েন।
রয়েছে সিসিটিভি নজরদারি, কন্ট্রোলরুম, মোবাইল টহল।
মাঠের ভেতরে স্বেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা দলও কাজ করছে।
নদীর তীরেও নৌ-পুলিশ টহল দিচ্ছে।
পুলিশ জানিয়েছে, মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা বা জটলা দেখা গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় সড়কে চাপ, তবে নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক
ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর চৌরাস্তা, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, কামারপাড়া—এসব এলাকায় গাড়ির চাপ কিছুটা বেড়েছে। তবে ট্রাফিক বিভাগ বলেছে, বিশেষ ট্রাফিক প্ল্যানের কারণে রাস্তায় বড় কোনো জ্যাম হয়নি।
স্ট্যান্ডার্ড তিনটি “ডাইভারশন পয়েন্ট” রাখা হয়েছে:
১। মিলগেট
২। ব্যাংকটাউন
৩। স্টেশন রোড
প্রয়োজনে এসব পথে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
ইসলামী ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর পরিবেশ
মাঠজুড়ে বিরাট তাঁবু, সারি সারি দাওয়াতি জামাত, দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত, রোনাজারি—সব মিলিয়ে সাধারণত শান্ত ও গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
ফজর, যোহর, আসর ও মাগরিবের পর নিয়মিত তাকরীর ও দাওয়াতি বয়ান দেওয়া হচ্ছে।
সাথীদের শিক্ষাদান, আমল, তাজকিয়া, আখলাক—এসব বিষয়ই মূল আলোচনা।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
মাঠে রয়েছে—
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
অ্যাম্বুলেন্স
অস্থায়ী চিকিৎসক দল
হিট বা অ্যালার্জি সমস্যা প্রতিরোধে পানি ও স্যালাইন বিতরণ
স্থানীয় হাসপাতালগুলোতেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে জরুরি শয্যা।
জোড় ইজতেমা কখন শেষ হবে?
জোড় ইজতেমা চলবে ৫ দিন, অর্থাৎ:
শুরু: ২৮ নভেম্বর ২০২৫
শেষ: ২ ডিসেম্বর ২০২৫
শেষ হবে: আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে
আখেরি মোনাজাতে লাখো মুসল্লির স্রোত দেখা যায়, যেখানে দেশ, জাতি, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ, শান্তি ও মানবতার জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়।
বিশ্লেষণ: সমাজ, ধর্ম ও অর্থনীতিতে প্রভাব
জোড় ইজতেমা শুধুই একটি ধর্মীয় আয়োজন নয়।
এটি—
স্থানীয় অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে,
পরিবহন খাতে সাময়িক বাড়তি আয় এনে দেয়,
দোকানপাট, খাবার-হোটেল, রিকশা-অটোচালকদের লগ্নি বাড়ায়,
গ্রামীণ ও শহুরে দাওয়াতি কাঠামো শক্তিশালী হয়,
মুসল্লিদের মধ্যে শৃঙ্খলা, সহনশীলতা ও আধ্যাত্মিক বন্ধন তৈরি করে।
এছাড়া পরিবেশগত দিক থেকেও কাজ জরুরি—
ইজতেমা শেষে মাঠ পরিষ্কার, বর্জ্য অপসারণ, নদীর পাড়ের পরিবেশ রক্ষা—এসব নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক থাকার কথা জানিয়েছে।
সর্বশেষ কথা
টঙ্গীর তুরাগ তীরে আয়োজিত জোড় ইজতেমা ধর্মীয় ঐক্য, ত্যাগ, শিক্ষা ও মানবিকতার বার্তা বহন করে। প্রতিবছর এই আয়োজন লাখো মানুষের হৃদয়ে আধ্যাত্মিক আলো ছড়ায়।
পরবর্তী বড় ইজতেমার আগমনী বার্তা হিসেবেই এই ৫ দিনের জোড় গুরুত্ব বহন করে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তেই প্রবাহিত হয় দাওয়াত, দোয়া ও ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব।