মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, পৌষ ৯ ১৪৩২, ০৩ রজব ১৪৪৭

ইসলাম

মাতৃভূমিকে যেভাবে ভালোবাসা উচিত

 প্রকাশিত: ১০:০০, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫

মাতৃভূমিকে যেভাবে ভালোবাসা উচিত

জন্মভুমি কেবল মাটি নয়—এটি আমাদের স্মৃতি, পরিচয়, সংস্কৃতি ও আত্মার প্রতিফলন। প্রতিটি গাছ, নদী, আকাশের নীলিমা, স্মৃতির প্রতিটি কোবকিছুই হূদয়ে অম্লান ছাপ রাখে। একজন মানুষের জীবনে জন্মভূমি তার নৈতিকতা, ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধকে গড়ে তোলে। তাইতো পবিত্র মক্কা শরিফ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম! আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়! যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত, তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৬) 

কেননা জন্মভূমি ত্যাগ করা মানে শুধুমাত্র শারীরিক বিচ্ছেদ নয়, হূদয়েরও এক গভীর ক্ষত। আর আল্লাহর নীতি হলো, যেখানেই ক্ষত তৈরি হয়, সেখানে প্রতিদান দিয়ে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়। পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের পথে নিজের বাড়ি বা শহর ত্যাগ করে হিজরত করে, আর পথের মধ্যেই মৃত্যু তার কাছে আসে, আল্লাহ তার পুরো নেক কাজের পুরস্কার নিশ্চিতভাবে প্রদান করবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১০০)

হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ বিন আদি বিন হারাম (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে খাজওয়ারা নামক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেখানে তিনি বলেছেন, আল্লাহর শপথ! (হে মক্কা) আল্লাহর জমিনে তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ...যদি তোমার কাছ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া না হতো, তবে আমি তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতাম না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৫)

এ আবেগময় বেদনাকাতর অভিব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অন্য হাদিসে আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি খায়বর অভিযানে খাদেম হিসেবে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে গেলাম। অভিযান শেষে রাসুল (সা.) যখন ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি বলেন, ‘এই পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও একে ভালোবাসি।’ (বুখারি, হাদিস : ২৮৮৯) 

হিজরত করে মদিনায় গমন করার পর রাসুল (সা.) প্রায়ই মক্কায় ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘যিনি তোমার জন্য কোরআনকে (জীবন) বিধান বানিয়েছেন, তিনি তোমাকে অবশ্যই তোমার জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৮৫)রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরাও নিজ দেশকে খুবই ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় আবু বকর (রা.) ও বেলাল (রা.) জ্বরাক্রান্ত হলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাঁদের মনে স্বদেশভূমি মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠল। তাঁরা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। তাঁদের এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসা মদিনার প্রতি আমাদের অন্তরে দান করুন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩৭২)

অতএব স্বদেশ কেবল ভূমি নয়। এটি আমাদের পরিচয়, সংস্কৃতি, ইতিহাস, স্মৃতি ও আত্মার প্রতিফলন। যখন কেউ তার জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, সেখানে সংঘাত, ধ্বংসযজ্ঞ বা দূষণ ছড়ায়—তখন সেই মাটির প্রতি শ্রদ্ধা ভঙ্গ হয়। বাতাস, জল এবং মাটি দূষিত হয় মানুষের অশ্রদ্ধার দ্বারা। এ জন্য প্রতিটি মানুষের হূদয়ে স্বদেশের মর্যাদা ও ভালোবাসা লালন করা অপরিহার্য। আরবিতে প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদ আছে ‘মাটির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করো, কারণ মাটি হলো তোমাদের পূর্বপুরুষদের পরিচয়, আর তোমাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি।’
তাইতো আল্লাহ তাআলা  মুসা (আ.)-এর জাতি ও দেশ সম্পর্কে বলেন, ‘স্মরণ করো, যখন মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল—হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছিলেন এবং তোমাদের রাজত্বের অধিকারী করেছিলেন। আর বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি প্রদান করেননি, তা তোমাদের দিয়েছেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেইস্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪) 

স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪)

উদ্ধৃত আয়াতগুলোতে ‘কাওমিহি’ বা ‘স্বজাতি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা দেশ, দেশের মানুষ, দেশের ভাষা ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এমনকি অন্যায়ভাবে কাউকে নিজ দেশ ও মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করা ইসলামের চোখে খুব গর্হিত অপরাধ। তাই মক্কার কাফির কর্তৃক স্বদেশভূমি মক্কা থেকে রাসুল (সা.)-কে বিতাড়নের চেষ্টাকে কোরআনে ষড়যন্ত্র ও অন্যায় হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দি করার জন্য, হত্যা অথবা নির্বাসিত করার জন্য। তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেন; আর আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৩০)