মঙ্গলবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, পৌষ ৯ ১৪৩২, ০৩ রজব ১৪৪৭

ইসলাম

সন্দেহে নষ্ট হয় সংসার ও সমাজ

 প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫

সন্দেহে নষ্ট হয় সংসার ও সমাজ

সমাজব্যবস্থা শুধু আইন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না; সমাজের প্রকৃত ভিত গড়ে ওঠে পারস্পরিক আস্থা, সৌহার্দ্য ও নৈতিক আচরণের ওপর ভর করে। কিন্তু একটি সমাজে যখন সন্দেহ স্বাভাবিক মানসিকতায় রূপ নেয়, যখন মানুষ একে অপরের প্রতিটি আচরণের পেছনে, প্রতিটি কথা বা কাজের পেছনে দোষ খুঁজতে শুরু করে; তখন ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে শুরু করে সম্পর্কের ভিত্তি, শিথিল হতে থাকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। বর্তমান সমাজে ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে এই নীরব সংকট।

ইসলাম মানুষের এই অন্তর্গত বিপর্যয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে।

কারণ সমাজ ভাঙে আগে অন্তর ভাঙার মাধ্যমে। তাই ইসলাম শুধু বাহ্যিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং কু-ধারণা, হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার মতো অন্তরের রোগ বা নৈতিক ব্যাধিগুলো নির্মূলেরও কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি মৌলিক ও যুগান্তকারী হাদিস আমাদের সামনে সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা হিসেবে উপস্থিত রয়েছে।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে চলো।

কারণ অনুমান বড় মিথ্যা ব্যাপার। আর কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, গোয়েন্দাগিরি কোরো না, পরস্পরকে ধোঁকা দিয়ো না, আর পরস্পরকে হিংসা কোরো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ কোরো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ কোরো না, বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৬৬)

এই হাদিসটি শুধু ব্যক্তিগত নৈতিকতার উপদেশ নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নীতিমালা। এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) একে একে এমন সব আচরণ নিষিদ্ধ করেছেন, যেগুলো সমাজকে খুব নীরবে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়।

এটি শুরু হয় খারাপ ধারণা দিয়ে। মানুষ যখন প্রমাণ ছাড়াই অন্যের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, তখন সে বাস্তব সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ কারণেই মহানবী (সা.) খারাপ ধারণাকে ‘সবচেয়ে বড় মিথ্যা’ আখ্যায়িত করেছেন।

খারাপ ধারণার অনিবার্য পরিণতি হলো দোষান্বেষণ। তখন মানুষ গোপন বিষয় জানার চেষ্টা করে, ব্যক্তিগত পরিসরে অনধিকার চর্চা শুরু করে।

আজকের ডিজিটাল যুগে এই প্রবণতা খুবই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গুজব ও অতিরঞ্জিত তথ্যের মাধ্যমে মানুষের সম্মান ও চরিত্র ধ্বংস করা যেন মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সামান্যতম ভিন্ন মতের দেখা পেলেই সেসব নিয়ে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা ডিজিটাল ক্ষেত্রগুলোতে ধারণাপ্রসূত মন্তব্য ও মিথ্যাচার প্রচার করে একে অপরকে ঘায়েল করেত লেগে যায়। অথচ ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়েছে যে অন্যের গোপন দোষ অনুসন্ধান করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তা সমাজে অবিশ্বাস ও শত্রুতার বীজ বপন করে।

এই হাদিসে হিংসা ও শত্রুতার কথাও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। হিংসা শুধু ব্যক্তিকেই মানসিকভাবে অসুস্থ করে না; এটি সমাজে অশান্তি, বিভাজন ও স্থায়ী অবিশ্বাসেরও জন্ম দেয়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসের শেষ বাক্যে নির্দেশনা দিয়ে আমাদের সামনে একটি উচ্চতর সামাজিক আদর্শ তুলে ধরেছেন : ‘তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাও।’

মহানবী (সা.)-এর এই ভ্রাতৃত্বের আদেশ কোনো আবেগী স্লোগান নয়; এটি একটি দায়িত্বশীল আচরণের আদেশ। এতে রয়েছে পারস্পরিক সম্মান, সদ্ভাব, সহনশীলতা ও কল্যাণকামিতার মতো সমাজ হিতকর আবহ।

আমাদের সমাজে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক বিভাজন ও পারস্পরিক অবিশ্বাস যদি ক্রমেই বাড়তে থাকে, তবে তার একটি বড় কারণ এই নববী নীতিমালার অবহেলা। কেননা আমরা অন্যের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত, কিন্তু নিজের অন্তর সংশোধনে উদাসীন। আমরা সন্দেহকে সতর্কতা আর গুজবকে সত্য মনে করতে শুরু করেছি।

এই কঠিনতর বাস্তবতায় সবার প্রয়োজন গভীর আত্মসমালোচনা ও নৈতিক প্রত্যাবর্তনে মনোযোগী হওয়া। আমাদের উচিত এই হাদিসকে প্রাত্যহিক জীবনের সর্বত্র পথ প্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করা। ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ; যদি আমরা সর্বস্তরে খারাপ ধারণা পরিহার করি, দোষ অনুসন্ধান বন্ধ করি এবং ভ্রাতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিই, তবেই সমাজ আবার আস্থার আলোয় আলোকিত হতে পারে।

ইসলাম যে সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখায়, তা সন্দেহের ওপর নয়, ভ্রাতৃত্বের ওপর; প্রতিযোগিতার ওপর নয়, সহমর্মিতার ওপর; বিদ্বেষের ওপর নয়, আখলাকের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর সেই সমাজ গঠনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ শুরু হয় মানুষের অন্তর থেকে। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে নববী আদর্শের আলোকে জীবনাতিপাত করার তাওফিক দান করুন।