শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৬ ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

আল্লাহর ডাকে লাব্বাইক বলুন

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 প্রকাশিত: ০৯:০৯, ৭ জানুয়ারি ২০২২

আল্লাহর ডাকে লাব্বাইক বলুন

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ.

তাকওয়ার অর্থ হল, অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা নিয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহর সামনে একদিন দাঁড়াতে হবে এবং সকল কর্মকাণ্ডের হিসাব দিতে হবে- এই ভয়ে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহর হুকুম মোতাবেক জীবনকে পরিচালিত করা। শুধু ভয় করার নাম তাকওয়া নয়। ভয়ের সাথে সাথে ভয়ের আছারাত ও ফলাফলও জীবনে প্রকাশ পেতে হবে।

তো এখানে আল্লাহ তাআলা প্রথমে তাকওয়া অর্জনের কথা বলেছেন। তারপর বলেছেন, প্রত্যেক মানুষ যেন অবশ্যই ভেবে দেখে আগামীকালের জন্যে সে কী জমা করেছে। এই দুনিয়ার জীবনটা হল আজকের দিন। আর আগামীকাল হল, মৃত্যুর পর। কিয়ামতের ভয়াবহতা এত বেশী হবে যে, দুনিয়ার জীবনটাকে মনে হবে এক সকাল বা এক বিকাল, বা তার চেয়েও কম।

এক আরব কবি বলেন-  

أذان المرأ حين الطفل يأتي + وتأ خير الصلاة إلى الممات

دليل أن محياه يسير + كما بين الأذان و الصلاة

দুনিয়ার জীবন হল আযান ও ইকামতের পর নামায শুরু হতে যে সময়টুকু  তার সমান। দেখ, জন্মের পরপরই তো তোমার জীবনের আযান-একামত হয়ে গেল। এখন নামাজ হওয়া বাকী।  সেই নামাজ হবে তোমার মৃত্যুর পর। এই আযান ও  নামাজের মাঝের সময়টুকু তোমার জীবন।

তো এই আয়াতে বলা হয়েছে, আখেরাতের জীবনের জন্যে কী পাঠিয়েছি তা যেন চিন্তা করি। একে ‘মুহাসাবা’ বলে।  ইসলাম বিভিন্ন আমল ফরয করেছে। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয কাজ হল, এই ‘মুহাসাবা’। আমার কী করা দরকার ছিল, আমি কী করেছি? আমার কী করার কথা ছিল না, কিন্তু কতটুকু বেঁচে থেকেছি? নিজের কাছ থেকে নিজে এই হিসাব নেওয়া। যদি নেক কাজ করে

 

থাকি তাহলে আল্লাহর শোকর আদায় করা। আর যদি গুনাহের কাজ হয়ে থাকে তাহলে  ইস্তেগফার করা। গুনাহের কাজ থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসার চেষ্টা করা। যদি অনেক গুনাহের কাজ হয় এবং সবগুলো একসাথে পরিত্যাগ করা সম্ভব না হয় তাহলে কিছু কিছু করে পর্যায়ক্রমে গুনাহের কাজ থেকে বেরিয়ে আসা। এভাবে ঈমানী হালত এবং আমলী হালতের খোঁজ-খবর নেওয়া। এই খোঁজ-খবর নেওয়াটা ফরজ।

ঈমানী হালত এবং আমলী হালতের খোঁজ-খবর না নেওয়া অনেক বড় গুনাহ। এটা হল নিজের অবস্থার খোঁজ-খবর নেওয়া। যদি আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া ফরয হয়ে থাকে তাহলে নিজের খোঁজ-খবর নেওয়া তো আরো  বড় ফরয।

এখানে প্রথমে বলা হয়েছে, গুনাহ থেকে বাঁচতে। বাহ্যত গুনাহ থেকে বাঁচা কোনো ইবাদত নয়।  কিন্তু আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সবচেয়ে বড় ইবাদত।

 اتق المحارم تكن أعبد الناس 

তুমি হারাম থেকে বাঁচ, তুমি হবে সবচেয়ে বড় ইবাদতগুজার। -জামে তিরমিযী, হাদীস নং ২৩০৫)

আমাদের কাছে নেক কাজের কোনো আকৃতি নেই। নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত ইত্যাদি কোনো নেক কাজেরই কোনো আকৃতি আমাদের সামনে নেই। কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রতিটি নেক কাজেরই একটি আকৃতি আছে। কিয়ামতের ময়দানে মানুষ সে আকৃতিসহ তাদের কৃতকর্মগুলো দেখতে পাবে। ছোট বড় সবকিছুই দেখতে পাবে।  কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেছেন-

وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا

 ‘এবং উপস্থিত করা হবে আমলনামা এবং ওতে যা আছে তার কারণে অপরাধিদের দেখবে আতংকগ্রস্ত এবং ওরা বলবে, হায়, দুর্ভোগ আমাদের! এ কেমন গ্রন্থ! এ তো দেখছি ছোটবড় কিছুই বাদ রাখেনি। সব লিখে রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার রব কারো প্রতি যুলুম করেন না।’ -সূরা কাহফ ১৮:৪৯

তো মানুষ যে আমল করে সব আল্লাহর কাছে জমা হতে থাকে। গুনাহ থেকে বাঁচা, আল্লাহকে ভয় করা এগুলো সবচেয়ে বড় নেক কাজ। সুতরাং এগুলোও আল্লাহর কাছে জমা হতে থাকে। আল্লাহর কাছে প্রত্যেকের জন্যে একটি একাউন্ট খোলা আছে। এই একাউন্টে যা জমা হয়, তা বাড়তে থাকে। পৃথিবীতে যে নেক কাজ হয় তা কখনো বিফলে যায় না, বরং আল্লাহ তা সযত্নে তুলে রাখেন। 

আমার এ সকল কথা বলার উদ্দেশ্য, একটি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সম্ভবত যারা হজ্বে গিয়েছিলেন, তারা সকলেই ফিরে এসেছেন। এখন আবার আরেক হজ্বের সময় হতে দীর্ঘ সময় বাকী। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়কে কেউ যেন দীর্ঘ মনে না করি। যাদের উপর হজ্ব ফরয হয়েছে, আমরা যেন আজ থেকেই আগামী হজ্বের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কারণ হজ্বের জন্যে অনেক প্রস্তুতি দরকার হয়। অনেক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার  প্রয়োজন হয়। এ সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে করতেই সময় চলে যাবে।

আমরা আমাদের দুনিয়াবী কাজে তো অনেক আগ থেকেই প্রস্তুতি শুরু করি। আমাদের এক উস্তায একবার এক ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলেন তাকে  একটি দ্বীনী কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে। ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘এখন সময় নেই। আমি খুব ব্যসত্ম। ছয় মাস পরে আমার মেয়ের বিয়ে। আপনি পরে দেখা করেন।’ তো ভদ্রলোক মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ছয় মাস আগ থেকেই। সুতরাং আল্লাহর ঘরের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যদি প্রস্তুতি নেওয়া হয় দশ মাস আগ থেকে তাহলে কি খুব আগেভাগে প্রস্তুতি নেওয়া হয়! মনে রাখবেন, হজ্ব না করা যেমন  গুনাহ তেমনি হজ্ব করতে  দেরী করাও গুনাহ। হজ্ব করতে দেরী করার অর্থ, যেন আল্লাহ আপনাকে ডাকছেন, বান্দা ! আমি তোমাকে ধনসম্পদ দিয়েছি, শক্তি-সামর্থ্য দিয়েছি। তুমি আমার ঘরটা একবার এসে দেখে যাও।

বান্দা জবাব দিল, ‘সরি আল্লাহ! আমার এখন সময় নেই।’ আল্লাহর সাথে এর  চেয়ে বেআদবী আর কী হতে পারে!

কত মানুষ আল্লাহর ঘর দেখার জন্য কত কান্নাকাটি করে! আর আল্লাহ তোমাকে সামর্থ্য দিলেন, শক্তি দিলেন, আর তুমি কিনা বল, আল্লাহ, আমার সময় নেই!

আমি উপরের কথাগুলো মূলত এ দিকে সকলের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে বলেছি। আপনারা আপনাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের কাছেও এ বার্তা পৌঁছে দেবেন। আল্লাহ তাআলা আমল করার তাওফীক দান করুন।

(২০ শে মুহাররম ১৪৩৬ হি. শুক্রবার কৃত জুমা-পূর্ব  বয়ান থেকে)  

মন্তব্য করুন: