ক্যাম্পাস বন্ধের পর আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ

ঢাকা, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর প্রতিবেদক মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘঠিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় আফসোস হলো—২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দিতে না পারা।’
আসিফ বলেন, ‘যদি সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে প্রথম কাজটি করতাম একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক রূপরেখা ও ঘোষণাপত্র তৈরি ও প্রকাশ। আমরা ভেবেছিলাম আন্দোলনটি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধে যেতে হতে পারে। তবে সত্যি বলতে—ঘোষণাপত্র দিতে না পারাটা আজও আমার কাছে বড় আক্ষেপ।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ১৯৯৮ সালের ১৪ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নের আকুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন এবং মাতা রোকসানা বেগম। তিনি নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
রাজনীতিতে তার সক্রিয় যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এরপর ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রথম সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় তিনি ও তার নেতৃত্বাধীন পুরো কমিটি পদত্যাগ করেন। একই বছর, ৪ অক্টোবর গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। বর্তমানে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, কঠোর নজরদারি এবং জীবননাশের হুমকির মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় দেখান। আন্দোলনের গতিপথ রক্ষায় তিনি ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে নেওয়ার মতো ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
গুম, নির্যাতন, নজরদারি এবং বহু সহযোদ্ধার মৃত্যু সত্ত্বেও তিনি মানুষের মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যান। নীচে তার একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো—
বাসস : আপনার রাজনীতিতে আসার গল্পটা কেমন? কেন আসলেন? কীভাবে আসলেন?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ২০১৮ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এসে যে জিনিসটা আমাকে প্রথম ধাক্কা দেয়, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়াবহ বাস্তবতা। গেস্টরুমে নির্যাতন, ছাত্রলীগের একচ্ছত্র সন্ত্রাস—সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ভয়ংকর বিষয় হলো, এসব নিয়ে কেউ কথা বলত না, সাহসও করত না।
ক্যাম্পাসে হাঁটতে গেলে হঠাৎ দেখা যেত—কলাভবনের সামনে বা টিএসসিতে একজনকে ১০-১২ জন মিলে মারছে, আর বাকিরা চেয়ে চেয়ে দেখছে। কেউ প্রশ্ন করে না, কেউ জানতেও চায় না। সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনতাম, আগের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। নামাজ পড়লে, প্যান্ট টাকনু উপরে রাখলে শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর করা হতো। এভাবে একটা অব্যক্ত ভয়ের পরিবেশে আমরা ক্যাম্পাসে আসি। এই বাস্তবতা মেনেই চলতে হতো।
যাহোক এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালের শুরুর দিকেই। তখন ব্যক্তিগতভাবে, বন্ধ-ুবান্ধবের ছোট একটি সার্কেল নিয়ে আমি আন্দোলনে যুক্ত হই।
এই যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবার বুঝতে পারি—প্রতিবাদ করাও সম্ভব, কণ্ঠস্বর তোলা যায়। এরপর থেকে আমরা শুধু কোটা ইস্যু না, ক্যাম্পাসের গেস্টরুমে নির্যাতন, ছাত্রলীগের দখলদারি, জাতীয় ইস্যু—যেমন আবরার ফাহাদের শাহাদাত, এনআরসি, গুম-খুন, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছি। আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম—১০, ১৫, কখনো ২০ জন। কিন্তু কোনো আন্দোলনেই অনুপস্থিত থাকিনি।
প্রথমদিকে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু সেখানে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটা সংকট তৈরি হয়। বিশেষ করে নেতৃত্ব নিয়ে কৌশলগত ও আদর্শিক বিরোধ তৈরি হলে আমি পদত্যাগ করি। এরপর আমরা ‘ছাত্রশক্তি’ গঠন করি। ছাত্রশক্তি গঠনের ১০ মাস পরেই আমরা আবার নতুনভাবে সংগঠিত হই এবং সেখান থেকে ভবিষ্যতের অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব আসতে থাকে।
বাসস : আন্দোলন করতে গিয়ে আপনি কি কখনো ভয় বা হামলার সম্মুখীন হয়েছেন? সেই অভিজ্ঞতাগুলো কেমন ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১৩৬ জন ভর্তি হওয়ার ঘটনা সামনে আসে। আমি নিজে সেই তালিকা তুলে ধরি সামাজিক মাধ্যমে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিল না। এরপর আন্দোলন হয়, প্রশাসন তদন্ত করে প্রায় ৯০ জনকে বহিষ্কার করে। সেই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হই। আমার চোখে আঘাত লাগে, এখনও দাগ আছে। তখনই বুঝি, ভয় একবার কাটলে আর ভয় থাকে না।
এরপর আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবছর তাকে স্মরণ করতাম। মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিই, আবার আহত হই। ২০২২ সালে আবরারের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভায় আবারো হামলা হলে আমি আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হই। পরে সেখান থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় দেড় মাস জেলে ছিলাম। আমার নামে চারটি মামলা ছিল, যার মধ্যে দুইটা আবরার ইস্যুতে, বাকি দুইটা অন্য ঘটনায়। প্রতি মাসে সিএমএম কোর্টে হাজিরা দিতে হতো— এটাই হয়ে গিয়েছিল জীবনের রুটিন। এই সময়টাতে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি— কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। কেউ আইনি সহায়তা দিয়েছে, কেউ আর্থিক। সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অনেক বড় ভাই সহযোগিতা করেছেন।
বাসস : জুলাইয়ের আগেও আপনাকে একাধিকার কারাবরণ করতে হয়েছিলো? কারাগারে অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : আমি যখন প্রথম গ্রেপ্তার হই, তখন আমরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলাম। আবরার স্মরণসভায় ছাত্রলীগ হামলা চালায়, এরপর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের জন্য সহজ কিছু অপেক্ষা করছে না।
কারাগারে যাওয়ার পর প্রথম যে অনুভবটা হয়, তা হলো— নির্জনতা আর বিচ্ছিন্নতা। মনে হচ্ছিল, বাইরের জগৎটা থেমে গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, এখানে থেকেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আমি কারাগারে যাওয়ার পর পরিবার, বন্ধ-ুবান্ধব, সংগঠনের সহযোদ্ধারা চিন্তায় পড়ে যায়। মা-বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন।
কারাগারে ভেতরে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। প্রথমদিকে আমাদের আলাদা করে রাখা হলেও পরে মিলিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে দেখেছি, অনেক কয়েদি আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা জানতে চাইত, ‘তোমরা কোন রাজনীতির সঙ্গে আছো?’, ‘কেন ধরা পড়লে?’—তাদের মধ্যেও একধরনের কৌতূহল ছিল। কেউ কেউ বলত, ‘ভাই, ভালো কাজ কইরা ধরা খাইছো।’
কারাগারে বই পড়ার চেষ্টা করতাম। পরিবার বই পাঠাতো, বন্ধুদের পাঠানো চিঠি পেতাম। সেই চিঠিগুলো ছিল বেঁচে থাকার শক্তি। একজন প্রগতিশীল লেখক আমার নামে কারাগারে কবিতা পাঠিয়েছিলেন, সেটা আমাকে নতুন উদ্দীপনা দেয়।
সবচেয়ে যেটা উপলব্ধি করেছি, সেটা হলো— প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করতে হলে আগে তার সাহস ভাঙতে হয়। জেলে রেখে সেটাই করা হয়। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম— বেরিয়ে আবার আন্দোলনে ফিরব। জেল থেকে বের হওয়ার পরে আমি একদিনও বিশ্রাম নিইনি। পরদিনই মাঠে নেমে পড়ি। কারণ আমি জানতাম, সংগ্রাম এখন আরও গভীর হয়েছে। আমাদের শত্রুরা এখন জানে— আমরা