শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

রমযানের পর: আমাদের জীবনে আসুক ভোরের আলো

 আপডেট: ২১:৩০, ৭ মে ২০২২

রমযানের পর: আমাদের জীবনে আসুক ভোরের আলো

মাহে রমযান বিদায় নিয়েছে। দিবসের সিয়াম আর রাতের কিয়ামের এক পবিত্র চাঞ্চল্যে ঘেরা ছিল মাসটি। শেষরাত থেকেই ছিল ঘরে ঘরে সেহরির আয়োজন। পরিবারের ছোট-বড় সকলে একসাথে রাতের স্নিগ্ধ পরিবেশে  বরকতের দস্তরখানে অংশগ্রহণ। দিবা শেষে ইফতারের আনন্দ। এরপর রাতের তারাবীতে দল বেঁধে অংশগ্রহণ। গোটা মাসটিই ছিল এক আশ্চর্য সজীবতা ও সক্রিয়তায় প্রাণবন্ত। দেখতে দেখতে রহমত ও মাগফিরাতের মাসটি বিদায় নিয়ে গেল। আর আমরাও যেন ফিরে এলাম আমাদের ইতিপূর্বেকার গতানুগতিকতার মধ্যে।

রমযান বিদায় নিয়ে গেলেও মুমিনের জন্য রয়েছে নফল সিয়ামের বিধান, আছে রাতের কিয়াম তথা নফল ও তাহাজ্জুদের সুন্নাহ। কাজেই ফরয সওমের মাধ্যমে সিয়ামের যে অনুশীলন মাসভর হয়েছে তা মাসনূন ও নফল সওমের মধ্য দিয়ে জারি রাখার সুযোগ রয়েছে। একটি হাদীস শরীফে তো রমযানের রোযার সাথে প্রতি মাসের তিনটি রোযাকে যুক্ত করে উল্লেখিত হয়েছে রোযার বিশেষ এক কাঠামো- সওমুদ দাহ্র।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

صَوْمُ شَهْرِ الصّبْرِ، وَثَلَاثَةِ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، صَوْمُ الدّهْرِ.

সবরের মাস (রমযানের রোযা) ও প্রতি মাসে তিন দিন (রোযা রাখা) সারা বছরের রোযা বলে গণ্য। -মুসনাদে আহমাদ ২/২৬৩, হাদীস ৭৫৭৭; সুনানে নাসায়ী ৪/২১৮, হাদীস ২৪০৮

রমযানের এক মাস রোযা রাখা তো ফরয। এর সাথে প্রতি মাসে  তিন দিন নফল রোযার দ্বারা সারা মাসের রোযার সওয়াব আর এভাবে বছরব্যাপী রোযাদার থাকার মর্যাদা হাসিল হতে পারে।

আর রোযার শিক্ষা তো চিরন্তন। রোযা মানুষকে সংযমী হতে শেখায়। আল্লাহ তাআলা যা কিছুকে নিষিদ্ধ করেছেন তা থেকে বেঁচে থাকতে শেখায়। এই শিক্ষা আল্লাহ্র রাসূলের হাদীস শরীফে স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে এসেছে। রোযাদার মিথ্যা কথা বলবে না, অন্যায় কাজ করবে না। রোযাদার অশালীন কথা বা কাজে লিপ্ত হবে না। ঝগড়া-বিবাদ, হৈ চৈ করবে না, গীবত, শেকায়েত করবে না, হালাল জীবিকার দ্বারা জীবন নির্বাহ করবে, হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকবে- এই সবই রোযার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই শিক্ষা সবসময়ের। কাজেই এক মাসের  কষ্টকর সওমের মধ্য দিয়ে যে শিক্ষাকে আমরা স্মরণ করেছি, পালনের চেষ্টা করেছি, তা বছরব্যাপী স্মরণ রাখতে হবে এবং জীবনভর পালন করে যেতে হবে। কাঁটা-ঝোপ বেষ্টিত পথে সতর্ক পথিক যেভাবে তার কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে চলে সেভাবেই অন্যায় ও গর্হিত কার্যকলাপের হাতছানি থেকে বেঁচে জীবন-যাপন করতে পারলেই আমাদের জীবনে রোযার শিক্ষা সার্থক ও ভাস্বর হয়ে উঠবে।

মাহে রমযানে কুরআনের সাথেও আমাদের কিছু সম্পর্ক হয়েছিল। নিজে কিছু তিলাওয়াত করা, তারাবীতে হাফেজ ছাহেবানের তিলাওয়াত  শোনা, কুরআন শিক্ষার মজলিসে অংশগ্রহণ করা, কুরআনের ব্যাখ্যা ও তাফসীর শোনা, এভাবে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল তা বছরব্যাপী থাকা কাম্য। এই পবিত্র  মাসে যাদের কুরআন শিক্ষার মজলিসে বসে কিছু শেখার সৌভাগ্য হয়েছে, শেখার প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি জেগেছে তাদের কর্তব্য শেখাটা পূর্ণ করা। আমরা যদি সত্যি সত্যি কুরআন শিখতে চাই তাহলে আল্লাহ তাআলা শেখার ব্যবস্থা করে দিবেন। মুমিনকে তো প্রথমে সচেতন হতে হবে, এরপর সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলার নুসরত হবে।

কুরআন তিলাওয়াত অনেক বড় নেক আমল। আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ যিকির। কাজেই বছরব্যাপী কুরআন তিলাওয়াতের ধারা জারি রাখা চাই। কুরআন তিলাওয়াত যেন হয় আমাদের প্রতিদিনের এক বিশেষ আমল। দৈনিক খবরের কাগজ পড়া বা সংবাদ শোনার চেয়েও কি কুরআন-পাঠ বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? এধরনের কাজেও যখন আমাদের সময় ব্যয় হতে পারে তখন কুরআন-পাঠের জন্য কেন সময় বের করা যাবে না?

রমযান মাসে ফরয নামাযেরও বেশ পাবন্দি ছিল। মসজিদগুলোতে মুসল্লীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এলাকার বালিগ পুরুষেরা মসজিদে জামাতের সাথে নামায পড়বেন- এ তো মুসলিম জনপদের স্বাভাবিক অবস্থা। কাজেই ঘন বসতিতে মসজিদগুলো পরিপূর্ণ থাকাটাই তো সাধারণ দৃশ্য। কাজেই আমাদের কর্তব্য, রমযানের পরেও মসজিদের জামাতের পাবন্দির বিষয়ে যত্নবান থাকা। মাহে রমযানের অসীলায় যে অভ্যাস হয়েছে তা ধরে  রাখা। তাহলে আমাদের জীবন হবে নিরবচ্ছিন্ন আলোয় উদ্ভাসিত। নতুবা দীর্ঘ লোডশেডিংয়ের মতো আমাদের জীবনও হয়ে পড়বে অন্ধকারাচ্ছন্ন।

রমযানে গরীব-দুঃখীর প্রতি আমাদের মন ছিল দয়ার্দ্র। যাকাত-সদকা আদায়ের জন্য অনেকেই রমযান মাসকে বেছে নিয়েছিলেন। এরপর ঈদুল ফিতরে ছিল সদকায়ে ফিতর আদায়ের বিধান। গরীব-দুঃখীর প্রতি সহমর্মিতা ও সম্পদের হকগুলো আদায় করাও শুধু রমযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি বছরব্যাপী ও জীবনব্যাপী এক বিধান। সম্পদের প্রদেয়গুলো সম্পর্কে- তা অপরিহার্য প্রদেয় হোক, বা ঐচ্ছিক প্রদেয়- বিস্তারিত জেনে  আদায় করতে থাকা মুমিনের অতি বড় গুণ, মুত্তাকী বান্দার অতি বড় বৈশিষ্ট্য। এই কর্তব্য সম্পর্কে যেন আমরা সচেতন থাকি। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, ও দুস্থ-অসহায়ের খোঁজ-খবর নেয়া এবং দ্বীনের নুসরাতের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করা বিত্তশালীদের সাধারণ কর্তব্য।

এককথায় মাহে রমযানে আমাদের হৃদয় ও কর্মে পুণ্যের যে দোলা লেগেছিল তা যেন মাস শেষে থেমে না যায়। আমাদের জীবন ও কর্মের দিগন্তে সুবহে সাদিকের যে রশ্মি দেখা দিয়েছিল তা যেন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে না যায়। জীবনের গোটা আকাশ যেন আলোকিত হয়ে ওঠে। আমাদের দ্বীনী জীবনে যেন ভোর আসে।

মন্তব্য করুন: