ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি: কারা দিচ্ছে, কারা দিচ্ছে না, আর কেন তা গুরুত্বপূর্ণ

প্যারিস থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ফিলিস্তিনের নির্বাসিত নেতৃত্ব ১৯৮৮ সালে দেশটিকে একতরফাভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে।
তবে ফিলিস্তিন যে ভূখণ্ডকে নিজের দাবি করছে, তার মধ্যে পশ্চিম তীর ইসরাইলের দখলে রয়েছে এবং গাজা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের নির্বাসিত নেতৃত্ব দেশটিকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন কোন দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো।
কোন কোন দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে
জাতিসংঘের প্রায় ৮০ শতাংশ সদস্য রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এএফপির হিসেব অনুযায়ী, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তত ১৫১টি দেশ এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
তবে আফ্রিকার তিনটি দেশের কাছ থেকে এএফপি সম্প্রতি এ বিষয়ে কোনো নিশ্চিত তথ্য পায়নি।
সোমবার জাতিসংঘে দেওয়া ঘোষণার মাধ্যমে ছয়টি ইউরোপীয় দেশ— ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, অ্যান্ডোরা ও মোনাকো এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে।
এর আগের দিন যুক্তরাজ্য ও কানাডা প্রথম জি-৭ দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
একই সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালও তাদের পথে হাঁটে।
ইতোমধ্যেই রাশিয়া, প্রায় সব আরব দেশ, প্রায় সব আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান দেশ এবং ভারত ও চীনসহ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাত যখন একতরফাভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন, তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আলজেরিয়া প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
এর পরের কয়েক সপ্তাহ ও মাসে আরও ডজনখানেক দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
এরপর ২০১০ সালের শেষ দিকে এবং ২০১১ সালের শুরুর দিকে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার আরেক দফা ঢেউ ওঠে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে হামলার পর গাজায় ইসরাইলি ব্যাপক হামলা শুরু হলে, আরও ১৯টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
কারা স্বীকৃতি দেয়নি
অন্তত ৩৯টি দেশ এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
এর মধ্যে রয়েছে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণাকেই পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে।
এশিয়ার মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
আফ্রিকার ক্যামেরুন, লাতিন আমেরিকার পানামা ও ওশেনিয়ার বেশিরভাগ দেশও এই তালিকায় রয়েছে।
অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্ত ইউরোপ ছিল এ বিষয়ে সবচেয়ে বিভক্ত মহাদেশ। ২০১০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত শুধু তুরস্ক ও সাবেক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলো ছাড়া কেউ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি।
এমনকি সাবেক পূর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্র এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি।
এক সময় পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ব্যাপারে একমত ছিল। শুধু ২০১৪ সালে সুইডেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
কিন্তু গাজা যুদ্ধ ইউরোপের সেই পরিস্থিতিকে বদলে দিয়েছে।
২০২৪ সালে সুইডেনকে অনুসরণ করে নরওয়ে, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও স্লোভেনিয়া ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
আর সম্প্রতি আরও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এই তালিকায় যুক্ত হলো।
তবে ইতালি ও জার্মানি এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা করেনি।
স্বীকৃতির মানে কী
ফ্রান্সের এইক্স-মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক রোমেন লে বোয়েফ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়াকে আন্তর্জাতিক আইনের ‘সবচেয়ে জটিল প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি এি কে ‘রাজনৈতিক ও আইনি বিষয়ের মাঝামাঝি একটি অবস্থান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ফ্রান্সের এইক্স-মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক রোমেন লে বোয়েফ বলেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে জটিল প্রশ্নগুলোর একটি।’
তিনি আরও বলেন, এটি ‘রাজনৈতিক ও আইনি বিষয়ের মাঝামাঝি একটি অবস্থান।’
বোয়েফ এএফপি’কে বলেন, কোন দেশ কখন ও কীভাবে স্বীকৃতি দেবে— সেটি পুরোপুরি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিবন্ধন অফিসও নেই।
তিনি আরো বলেন, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যেসব ঘোষণাকে স্বীকৃতি হিসেবে ধরে, তা আসলে তাদের নিজস্ব তালিকা। অন্য দেশগুলোও নিজেদের মতো করে জানিয়ে দেয় যে তারা স্বীকৃতি দিয়েছে না-কি দেয়নি। এর জন্য আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না।
তবে একটি বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন বেশ পরিষ্কার-‘স্বীকৃতি মানে এই নয় যে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। আবার স্বীকৃতির অভাব একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে আটকেও রাখে না।’
লে বোফ বলেন, স্বীকৃতির রাজনৈতিক ও প্রতীকী গুরুত্ব অনেক। বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ দেশ বলছে, ফিলিস্তিন একটি রাষ্ট্র হওয়ার জন্য সব শর্তই পূরণ করে।
ব্রিটিশ-ফরাসি আইনজীবী ও অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডস আগস্ট মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের একটি পডকাস্টে বলেন, ‘অনেকের কাছে এটি কেবল প্রতীকী মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতীকী গুরুত্বেই আসল পরিবর্তন ঘটে। কারণ একবার রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে, ফিলিস্তিন ও ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইনের চোখে একই পর্যায়ে চলে আসে।’