ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি: ইসলামী সমাজের ভিত্তি

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিকতা, আদর্শ এবং মানবিক গুণাবলীর চর্চা করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা। সহযোগিতা একটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের একটি মৌলিক উপাদান, কারণ এটি সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখে। সহযোগিতা কোনো সফল সমাজের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। মানুষ একা সফল হতে পারে না বা তার ওপর অর্পিত সমস্ত দায়িত্ব এককভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। অন্য কারো সাহায্য নিতে হয়। সহযোগিতা হলো বিশ্বজগতের ভারসাম্য বজায় রাখার একটি প্রধান রূপ, যা শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল জীবের মধ্যেও ঘটে। এই গুণাবলী শুধু ব্যক্তি জীবনে নয়, বরং সমগ্র সমাজে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব এবং সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের প্রতি দয়া, সহানুভূতি এবং একে অপরকে সাহায্য করার ব্যাপারে বারবার উৎসাহিত করেছেন।
সহমর্মিতা ও সহযোগিতার গুরুত্ব
সহমর্মিতা ও সহযোগিতা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত করে এবং সমাজে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলে। এটি টেকসই সমাজের জন্য একটি দৃঢ় এবং শক্তিশালী ভিত্তি উপস্থাপন করে। এটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামি আদর্শের প্রতিফলন। সহমর্মিতা মানুষকে অন্যের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করতে শেখায় এবং সহযোগিতা সেই দুঃখ দূর করতে সাহায্য করে। এ দুটি গুণ ইসলামের মূল নীতিগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
কোরআনে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা
কোরআন মাজিদে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার গুরুত্ব বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
"وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ"
‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গুনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে, ভালো কাজ এবং আল্লাহভীতি অর্জনের ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। অপরদিকে, অন্যায় ও পাপ কাজে সহযোগিতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ আরো বলেন,
"إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ وَالْبَغْيِ ۚ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ"
‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
এই আয়াতে ন্যায়পরায়ণতা ও সৎকর্মে সহযোগিতার গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। এটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলে।
হাদিসের আলোকে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার উজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ."
তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না ঈমান আনবে আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বাতলে দেব না যা করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসার সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৪) এই হাদিসে মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও একে অপরের প্রতি সহানুভূতির গুরুত্ব স্পষ্ট।
অন্য হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " مَنْ لاَ يَرْحَمُ لاَ يُرْحَمُ ".
যে দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯৭)
এ হাদিস আমাদের অন্যের প্রতি দয়া প্রদর্শনের গুরুত্ব বোঝায়। একজন প্রকৃত মুমিন সর্বদা মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে।
সাহাবায়ে কেরামের সহমর্মিতা
সাহাবায়ে কেরাম সাহায্য ও সহমর্মিতায় অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) যখন মদীনায় এলেন তখন মুহাজিরগণ তাঁর কাছে এসে বললেন,
" يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا رَأَيْنَا قَوْمًا أَبْذَلَ مِنْ كَثِيرٍ، وَلاَ أَحْسَنَ مُوَاسَاةً مِنْ قَلِيلٍ مِنْ قَوْمٍ نَزَلْنَا بَيْنَ أَظْهُرِهِمْ، لَقَدْ كَفَوْنَا الْمَئُونَةَ، وَأَشْرَكُونَا فِي الْمَهْنَإِ، حَتَّى لَقَدْ خِفْنَا أَنْ يَذْهَبُوا بِالأَجْرِ كُلِّهِ. فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: " لاَ، مَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِمْ وَدَعَوْتُمُ اللَّهَ لَهُمْ ."
ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা যে জাতির কাছে এসেছি তাদের মত প্রাচুর্যের অবস্থায় এবং অপ্রাচুর্যের অবস্থায় (আল্লাহর পথে) এত ব্যয় করতে এবং এত উত্তম সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে আর কাউকে আমরা দেখিনি। তারা আমাদের সকল প্রয়োজনে যথেষ্ট ছিলেন এবং তাদের শ্রমলব্ধ সম্পদে আমাদের অংশীদার বানিয়েছেন। এমনকি আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যে সব সাওয়াব তারাই নিয়ে যাবেন। নবী (সা.) বললেন, শোন যতদিন তোমরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবে এবং তাদের প্রশংসা করবে (ততদিন তোমাদেরও সাওয়াব হতে থাকবে)। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৪৮৭)
সহমর্মিতা ও সহযোগিতার প্রভাব
১. সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা
সহমর্মিতা ও সহযোগিতা একটি সমাজে ঐক্য এবং সৌহার্দ্য বজায় রাখে। এটি পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মানের ভিত্তি গড়ে তোলে। সহযোগিতা সমাজের ব্যক্তিদের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়ক হয় এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া, সম্মান এবং সকলের কল্যাণের জন্য একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যখন ব্যক্তিরা সহযোগিতা করে, তখন এটি সামাজিক সম্পর্ককে মজবুত করে, সংঘাত কমায়। সহযোগিতা এমন একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে যেখানে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
২. দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য
সহমর্মিতা মানুষকে দরিদ্র, অসহায় এবং নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"السَّاعِي عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَوِ الْقَائِمِ اللَّيْلَ الصَّائِمِ النَّهَارَ."
যে ব্যক্তি বিধবা ও মিসকিনদের ভরণ-পোষণের চেষ্টা করে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো। অথবা সে ওই ব্যক্তির মতো, যে দিনে রোজা পালন করে ও রাতে (নফল ইবাদতে) দণ্ডায়মান থাকে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০০৬)
৩. পাপ ও অন্যায় দূরীকরণ
সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পাপ ও অন্যায় থেকে মানুষকে দূরে রাখে এবং সমাজে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করে।
৪. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
সহমর্মিতা ও সহযোগিতা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ، وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ."
যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব কোন বিপদ-আপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিনে তার থেকে বিপদ দূরীভূত করবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্ত লোকের জন্য সহজ ব্যবস্থা (দুর্দশা লাঘব) করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দুর্দশা মোচন করবেন। যে ব্যক্তি কোন মূসলমানের ক্রটি গোপন রাখবে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার ক্রটি গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাই এর সাহায্যে নিয়োজিত থাকে আল্লাহ ততক্ষণ তার সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৯)
তাই আমাদের কর্তব্য, পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে দয়া ও সহমর্মিতা চর্চা করা, দরিদ্র, অসহায় এবং অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সৎকর্মে একে অপরকে সহযোগিতা করা এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা। সমাজে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার গুণাবলি অর্জন করার তাওফিক দিন এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের সাহায্য করুন।
মুসলিম বাংলা