বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে আসবে : ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী

ঢাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তাসমূহের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ অন্যান্য এলডিসিভুক্ত দেশকে এসব সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ কমিয়ে আনার পক্ষে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীতে ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ এবং কাঠামোগত রূপান্তর’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সাপোর্ট টু সাস্টেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রকল্প (এসএসজিপি) এই সেমিনারের আয়োজন করে। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী।
ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ক্রমশ পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আগামীতে এলডিসি হিসেবে প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধাসমূহ কমে আসবে। এমতাবস্থায় এই ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধাসমূহের অবর্তমানে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সে বিষয়ে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতকে শিল্পকারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি এবং তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করার আহ্বান জানান। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা হলে তাঁদের উৎপাদন সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
ড. চৌধুরী অপেক্ষাকৃত সুলভ ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পসমূহের আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
সেমিনারে ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান, বাণিজ্য সহজিকরণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ, উন্নয়ন সংস্থা, বেসরকারি খাত তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বল্পোন্নত দেশসমূহের কাঠামোগত রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে যে সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন তাঁর একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সম্প্রতি প্রণীত স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজিতে প্রদান করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজির কর্মপরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সেমিনারের মূল বিষয়বস্তুর উপর একটি উপস্থাপনা প্রদান করেন অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনী ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. জুলফান তাজুদিন।
ড. তাজুদিন তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেক দেশসমূহে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার অভাব এবং ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে এসব দেশের কাঠামোগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে তিনি বাংলাদেশসহ এই সব দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। একই সাথে তিনি জনগণের ক্ষমতায়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ের যথোপযুক্তভাবে মোকাবেলা করার আহ্বান জানান।
কর্মশালায় প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক সচিব ও এসএসজিপি প্রকল্পের প্রকল্প উপদেষ্টা আবদুল বাকি, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. কাজী ইকবাল।
প্যানেল আলোচকবৃন্দ তাদের বক্তব্যে অভিমত ব্যক্ত করেন যে বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। সেই লক্ষ্যে দরকারি কাঠামোগত রূপান্তর ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের উপর তারা গুরুত্ব আরোপ করেন।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর সভাপতি মাহমুদুল হাসান খান এবং লেদারগুডস এন্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারাস এন্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)-এর প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের বক্তৃতায় এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সময়সীমা আরও তিন বছর বৃদ্ধির আহ্বান জানান। এই প্রেক্ষাপটে তারা জ্বালানি নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদুল হাসান খান বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যারই সমাধান হবে।
সেমিনারে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ইআরডি’র অতিরিক্ত সচিব ও এসএসজিপি প্রকল্পের পরিচালক এ. এইচ. এম. জাহাঙ্গীর।
উল্লেখ্য, পাঁচ বছর প্রস্তুতিকালীন সময় শেষে বাংলাদেশ নভেম্বর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে। এই উত্তরণ প্রক্রিয়া টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার ক্ষেত্রে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর অত্যাবশ্যক। শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এই কাঠামোগত রূপান্তর সাধন সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
এমতাবস্থায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর নিশ্চিতকরণের জন্য কি ধরনের নীতি পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন তা নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার লক্ষ্যে আজকের সেমিনারটি আয়োজন করা হয়।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাসমূহের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাত ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন।