স্মার্ট ডিভাইস-আসক্তিতে বিপদগামী হচ্ছে শিশু-কিশোররা

ঢাকা, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : নাম গাজী আয়ান। বয়স এগার। দিন-রাত মিলিয়ে সে পড়াশোনা করে মাত্র এক-দু’ঘণ্টা। বাকি পুরো সময় কাটায় মোবাইল ফোনে। এ বয়সেই মোবাইল আসক্তি গ্রাস করেছে তাকে।
শিশুটির মা তামান্নারা তানিয়া জানান, ইদানীং ছেলের পড়াশোনায় কোনো মনোযোগ নেই। মোবাইল নিয়েই কাটে তার সারাক্ষণ। ছোট ভাই আয়াজের সাথেও খেলাধুলা করে না। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এই মোবাইল তিলে তিলে আমার সন্তানদের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন তিনি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
ঢাকার লালমাটিয়া এলাকার ভুক্তভোগী আরেক মা রোকসানা আখতার জানান, তার মেয়ে রাইসা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। মেয়েকে নিয়ে সপ্তাহে প্রায় পাঁচ দিন চার-পাঁচ ঘণ্টা কোচিং সেন্টারে বসে থাকতে হয়। এ সময় ১২ বছর বয়সী ছেলে রায়হানকে একা বাসায় রেখে যেতে হয়। নিরাপত্তার জন্য বাধ্য হয়ে মোবাইল ফোন তার কাছে রেখে যান।
বর্তমানে তার এমন অবস্থা হয়েছে, মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। পড়াশোনা করে না, কারও সাথে কথা বলে না, সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে মোবাইল দেখে। মোবাইল রাখতে বললেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে পুরো বাসা মাথায় তোলে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না, অস্বাভাবিক আচরণ করে।
এই চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ শিশু-কিশোরদের মধ্যেই দেখা যায়। দিনের বড় অংশই কাটে ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের আসক্তিতে। শিশু গাজী আয়ান বা রায়হানের মতো পরিস্থিতি এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারের। তামান্নারা তানিয়ার মতো আক্ষেপ এখন প্রায় সব মায়ের।
আজকাল একান্নবর্তী পরিবার প্রায় নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ মানুষ ছোট ফ্ল্যাটে অণু-পরিবারে থাকেন। মা-বাবা সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত, বাচ্চার জন্য সময় নেই। সব বাসাতেই একই চিত্র। কিছুদিন আগেও শিশুদের হাতে প্রযুক্তিগত ডিভাইস নিয়ে অভিভাবকদের তেমন দুশ্চিন্তা ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে এর নেতিবাচক প্রভাব ভাবিয়ে তুলছে মা-বাবাদের।
অভিভাবকরা জানান, রাতের ঘুমের সময়, খাবারের সময়, হাঁটার সময় সব ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের মোবাইল চাই। মোবাইল ছাড়া দিন চলে না তাদের। এতে ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে, মানসিক বিকাশও মোবাইল ঘিরেই ঘটছে। বাবা-মার সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
অভিভাবকদের মতে, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা ও খেলার মাঠ না থাকায় রাজধানীতে ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি প্রকট আকার ধারণ করছে। মূলত পরিবারের বড়দের, বিশেষ করে বাবা-মায়ের ব্যবহৃত স্মার্টফোন থেকেই শিশুদের স্ক্রিন আসক্তির শুরু। কার্টুন, অ্যানিমেশন ও ইউটিউবের মাধ্যমে শুরু হয়ে পরে তারা আসক্ত হচ্ছে ফেসবুকিং ও অনলাইন গেমসে। এভাবেই প্রায় সব শিশু স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত থাকে ডিজিটাল গেমসে।
মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. নিকোলাস কারদারাস এ ধরনের আসক্তিকে ‘ডিজিটাল মাদক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কয়েক বছর হলো আমাদের সমাজেও এই ডিজিটাল মাদকের সর্বগ্রাসী থাবা পড়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এসব ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষতিকর দিক প্রমাণিত।
ভারতের চার্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোনের অধিক ব্যবহার চোখের রেটিনা, কর্নিয়া ও অন্যান্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুদের অনিদ্রা, আগ্রাসী মনোভাব, বন্ধুহীনতা, আত্মবিশ্বাসহীনতার অন্যতম কারণ এই স্ক্রিন আসক্তি।
গবেষকরা বলেন, শিশুকে অন্তত দুই ঘণ্টা বাইরে খেলতে দিলে ধীরে ধীরে তার স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তি কমে যাবে। অর্থাৎ শিশুকে ঘরে বন্দি না রেখে বাইরের পরিবেশে মেশার সুযোগ দিতে হবে, খেলাধুলায় যুক্ত করতে হবে, বয়স অনুযায়ী গল্প ও সৃজনশীল বই পড়ায় উৎসাহিত করতে হবে।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৬০ লাখ শিশু-কিশোর ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তির কারণে নানা জটিলতায় ভুগছে। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ আই হাসপাতালের শিশু বিভাগে কনসালট্যান্ট ডা. কাজী সাব্বির আনোয়ার বলেন, ছোট শিশুদের জন্য এ ক্ষতি আরও বেশি। রাস্তায় কিংবা স্কুলে অনেক শিশুর চোখে সমস্যা দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কারণ ডিজিটাল আসক্তি। ফলে অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব হলো এই আসক্তির ভয়াবহতা উপলব্ধি করা।
তিনি আরও বলেন, যারা স্মার্টফোনে সেঁটে থাকে তারা অন্য কোনো কাজে দীর্ঘসময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, সহজে অধৈর্য হয়ে পড়ে, বন্ধু-বান্ধব কম হয়। এতে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে রাগপ্রবণ হয়ে ওঠে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসক নেহাল করিম বলেন, “ডিজিটাল জগৎ নিয়ে পরে থাকলে শিশুদের চোখ ও মস্তিষ্কের বড় ক্ষতি হবে।” অতিমাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিশুর মেধার বড় অংশ নষ্ট হচ্ছে। একটানা ৪০-৪৫ মিনিটের বেশি ডিভাইস ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়।
মেডিকেল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ.বি.এম. আবদুল্লাহ বলেন, ইলেক্ট্রোলাইটিক রেডিয়েশন স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, ‘যতটুকু সম্ভব বাচ্চাদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে। ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়ে গেলে তাদের শারীরিক অনুশীলন কমে যায়, তারা মোটা হয়ে যায়, ওজন বাড়তে থাকে। এতে বয়স হলে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। একইসঙ্গে চোখ ও মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।’
তার মতে, শিশুদের হাতে স্মার্টফোন যত কম দেওয়া যায় ততই ভালো। বড়রা ব্যবহার করলেও শিশুদের থেকে দূরে রাখতে হবে। বড়দের তুলনায় শিশুদের সহনশীলতা অনেক কম হওয়ায় ক্ষতিটা তাদের জন্য অনেক বেশি।