ঢাবিতে সাদিক-ফরহাদের নেতৃত্বে শিবিরের কমিটি হয় জানুয়ারিতে
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান কমিটি চলতি বছরের জানুয়ারিতে করা হয় বলে তথ্য দিয়েছেন সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দেড় মাস পর এই কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির পরিচয় প্রকাশ্যে আসা নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি এ কথা বলেন।
এতদিন কি পরিচয় প্রকাশে নিষেধ ছিল- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ব্যাপারটা ঠিক এমন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থান ছিল না। যেখানে বিশ্বজিৎ হিন্দু হয়েও শিবির সন্দেহে হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, সেখানে আমাদের পরিচয় প্রকাশ করাটা সম্ভব ছিল না।”
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না ছাত্রশিবিরের। শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের হেনস্তার মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাও যে সেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, ধীরে ধীরে তা প্রকাশিত হচ্ছে।
গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগ দেওয়ার পর গণমাধ্যমে প্রথম নিজের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করে বক্তব্য দেন সাদিক কায়েম। বলেন, তিনি ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি।
পরদিন প্রকাশ পায় সেক্রেটারি ফরহাদের পরিচয়, যার নাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একটি কমিটিতে থাকার তথ্যও সামনে আসে। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন।
ফরহাদের নাম রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা অনুষদ ছাত্রলীগ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদে। ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বরের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা অনুষদ ছাত্রলীগের কমিটির একটি তালিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন স্বাক্ষরিত ওই তালিকায় সাতজন যুগ্ম সম্পাদকের ছয় নম্বরে এস এম ফরহাদের নাম রয়েছে।
তবে শিবির নেতা হিসেবে পরিচয় প্রকাশের পর এক বিবৃতিতে ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকার বিষয়টি নাকচ করেছেন তিনি।
ফরহাদ বলেন, "কবি জসীম উদ্দীন হল এবং সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি ও কার্যক্রমের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ছাত্রলীগের কোন পদ-পদবির জন্য কোনো সিভি আমি কখনও কাউকে দিইনি। কখনও আমি নিজেকে ছাত্রলীগ হিসেবে কোনো মাধ্যমেও পরিচয়ও দিইনি।
“হল বা ডিপার্টমেন্টের কমিটিতে কাকে রাখা হবে সেটা সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত। সেখানে আমাকে কেন জড়ানো হচ্ছে যেখানে আমি তাদের কার্যক্রমের সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নই। বরং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে অতীতের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আমি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছি। আমাকে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়টিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের স্পিরিট নষ্ট করার একটি অপচেষ্টা বলে আমি মনে করি।"
এ তালিকার বিষয়টি ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। সরকার পতনের পর থেকে তারা সবাই আত্মগোপনে আছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি কবে হবে জানতে চাইলে ফরহাদ বলেন, "আমরা আশা করি দ্রুত পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করব। এখনও কোনো তারিখ ঠিক করিনি। "
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ফরহাদের ভূমিকা আগের দিনই সামনে এনেছেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল কাদের।
তিনি রোববার এক ফেইসবুক পোস্টে ১৬ জুলাই সংঘাতে মৃত্যু শুরু হওয়ার পর থেকে আন্দোলন যেভাবে এগিয়েছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরেন। প্রকাশ করেন, ১৮ ও ১৯ জুলাই গুলিতে অনেক মানুষের প্রাণহানির পর যে ৯ দফা দেওয়া হয়েছিল, সেটি প্রণয়ন করার আলোচনা হয়েছিল ফরহাদের সঙ্গে, নেওয়া হয় তার পরামর্শ।
এই নয় দফা দাবির পথ ধরেই আসে সরকার পতনের এক দফা। ৩ অগাস্ট এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার পর ৫ অগাস্ট সরকার পতন ঘটে। ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে দেশ ছাড়েন টানা ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েমও কোটা ও সরকার পতন আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশ নিতেন। এই আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে দেখা গেছে তাকে।
গত ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্য নেতাদের সঙ্গে সাদিক কায়েমও যোগ দেন। অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানসহ একাধিক উপদেষ্টার পাশেও দেখা গেছে তাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খানের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার পাশেও দেখা গেছে সাদিককে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির: কী ভাবছে ছাত্রদল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির কখনও প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারেনি। বিএনপি শাসনামলেও ছাত্রদলের বাধার মুখে পড়েছে তারা।
এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্রদল কী অবস্থান নেবে, এই প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বাংলাদেশে ৭১ পরবর্তী ৩টি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যা হওয়ার হয়েছে। এখন চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কে রাজনীতি করবে, কে করবে না সেটা সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার আমরা কেউ না।"
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে রাজনীতি করতে না দেওয়ার বিষয়ে সংগঠনের অবস্থানের কথা জানান এই ছাত্রদল নেতা। বলেন, "চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত ‘গণহত্যার’ সাথে ছাত্রলীগ সরাসরি জড়িত। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ শিক্ষার্থীরা দেবে না।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কার্যকর ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের মিথস্ক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম পরিবেশ পরিষদে ১৯৯০ সালে শিবির ও জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে না দেওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল।
শিবিরের বিষয়ে অবস্থান জানতে চাইলে আরেক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, "শিবির জামায়াতের ছাত্র শাখা। আমরা যদি জামায়াতের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখি, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু এখনও তারা নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি। তারা যদি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে জনগণের নিকট তাদের ভুল স্বীকার করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি শিবিরের রাজনীতিকে ক্যাম্পাসে স্বাগত জানায়, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।"