‘নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে হবে স্বাধীনতার মূল্য কত’
ভোরের আলো ফোটার আগেই শীতের কুয়াশা মোড়ানো স্তব্ধতা ভেঙে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাড়ছিল মানুষের আনাগোনা।
বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্তির প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর শহীদদের স্মরণে তারা ফুল হাতে এসেছেন, সময়ের সঙ্গে বাড়ছিল এই ভিড়।
রাষ্ট্রকর্তাদের জন্য রাত থেকেই বলবৎ থাকা নিরাপত্তার ঘেরাটোপ শিথিল হওয়ার অপেক্ষা ফুরাতেই ভিড় গিয়ে মিলেছে স্মৃতিসৌধে, মুখরিত হয়ে ওঠেছে পুরো প্রাঙ্গণ।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার পর থেকে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের স্রোত নেমেছে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। হাতে জাতীয় পতাকা ও ফুল আর পরনে লাল-সবুজ পোশাকের আধিক্য পুরো এলাকাজুড়ে এক ভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় এই দিনের উদযাপন যেন এক বিন্দুতে গিয়ে মিলেছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ মধ্য দিয়ে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী, শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই লড়াইয়ে চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৬ ডিসেম্বর।
সেদিন ঢাকার রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।
বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকীতে ভোরের আলো ফুটতেই রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্মৃতিসৌধে নীরবতা পালন করা হয়, বেজে ওঠে বিউগলে করুণ সুর। এই সময় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে উপস্থিত সকলের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কূটনৈতিকসহ ভিআইপিদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নিরাপত্তা শিথিল হতেই সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মোক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়।
শহীদ শ্রদ্ধা নিবেদনে অনেকে এসেছেন একা, আবার কেউ এসেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। কেউবা শিশু সন্তানকে হাত ধরে এনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিজয়ের তাৎপর্য বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
ছোট ছোট শিশুর হাতে জাতীয় পতাকা আর মুখে আঁকা পতাকার ছবি, স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণকে করে তোলেছে আরও প্রাণবন্ত।
নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, শ্রমজীবী মানুষ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা দল বেঁধে নিজস্ব ব্যানার নিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে শহীদ বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
স্মৃতিসৌধে আসা সাভারের বাসিন্দা সোহেল রহমান বলেন, “এই জায়গাটায় দাঁড়ালে ১৯৭১ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যারা জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারাটা আজকের দিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যানারে একদল মানুষ এসেছেন শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রথম ভাগে। শফিক আহমেদ নামে একজন এসেছেন নিজের ৫ বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে। তিনি সন্তানকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে ফুল দেবেন বলে ভোরবেলায় বাসা থেকে বের হন।
শফিক বলেন, “নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বইয়ে শুধু পড়ালেই হবে না। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা ও আয়োজনগুলোতে সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে হবে স্বাধীনতার মূল্য কত বড়।”
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে মানুষের এই ভিড় ক্রমেই আরও বাড়ছে। অনেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে স্মৃতিসৌধের চারপাশে ঘুরে দেখছেন।
এদিকে বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের মোতায়েনের পাশাপাশি সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে।
নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাত থেকেই আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশিচৌকি স্থাপনসহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় যানবাহন। দর্শনার্থীদের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে স্বেচ্ছাসেবক দল সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে দায়িত্ব পালন করছেন চার হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য।
স্মৃতিসৌধকেন্দ্রিক বিজয় দিবসের নানান এই আয়োজনের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। অনেক সংগঠনের পক্ষ থেকে লোকজন ব্যান্ডপার্টিসহ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসছেন। এলাকাজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানান গান বাজছে। লাল-সবুজের রঙে সাজানো ব্যানার-ফেস্টুনে পুরো এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠেছে।
শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্তম্ভ কেন্দ্রিক মানুষের উচ্ছ্বাস, চোখে-মুখে গর্বের স্পষ্ট ঝিলিক বিজয়ের দিনে জাতীয় স্মৃতিসৌধ যেন হয়ে ওঠেছে আবেগ, কৃতজ্ঞতা আর ইতিহাসের এক জীবন্ত মিলনস্থল।