শনিবার ০৪ অক্টোবর ২০২৫, আশ্বিন ১৯ ১৪৩২, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

পর্যটন

মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি: বাংলার শোষণ আর সংগ্রামের ঐতিহাসিক নিদর্শন

 প্রকাশিত: ১৮:২৬, ৪ অক্টোবর ২০২৫

মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি: বাংলার শোষণ আর সংগ্রামের ঐতিহাসিক নিদর্শন

মেহেরপুর,৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস):বাংলার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ব্রিটিশ শাসন আমলের অনেক স্মৃতি আজও রয়ে গেছে। তবে তেমন এক স্মৃতিচিহ্ন হলো মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি, যা বাংলার মানুষের রক্তে ও শ্রমে গড়ে ওঠা এক গৌরবোজ্জ্বল, কিন্তু শোষণ ও অত্যাচারের ইতিহাস। এই কুঠিবাড়িটি শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ভবন নয়, বরং বাংলার মানুষের সংগ্রাম, বঞ্চনা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার এক জীবন্ত সাক্ষ্য। 

দেশের একমাত্র মেহেরপুরের এই আমঝুপি নীলকুঠিটি এখনও টিকে আছে। মূলভবনের পাশে স্মৃতিহিসেবে এখনও প্রতিবছর নীলগাছের চারা গজায়। বৃটিশ শাসনের পর কুঠিবাড়ির দায়িত্ব বর্তেছিল মেদিনীপুর কোম্পানীর ওপর। জমিদারী উচ্ছেদ হবার পর কুঠিবাড়ির দায়িত্ব আসে জেলা প্রশাসনের ওপর। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ। বর্তমানে উপজেলা প্রশাসনের ওপর। মূল ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৫ সালে কুঠিবাড়িটিকে পর্যটন মন্ত্রনালয় দায়িত্ব নেয়। মূল কুঠিবাড়িটিকে দেখভালের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ৫ জন আনসার সদস্য ও ৫ জন কেয়ার টেকার নিয়োগ দেয়। কুঠিবাড়িটিতে বাউন্ডারি ওয়াল না থাকার কারণে এখানে ওখানে গবাদিপশুর মল মূত্রে পর্যটকদের বিপাকে পড়তে হয়।  ফলে পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। 

ব্রিটিশ শাসনের বেদনার ইতিহাস:

১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা বাংলার গ্রাম-শহর গ্রাস করতে শুরু করে। মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠির নির্মাণ হয় ইংরেজদের শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। সিম্পসেন, ফার্গুসেনসহ ইংরেজ শাসকেরা এই কুঠিবাড়িতে বসবাস করে বাংলার সাধারণ মানুষের শোষণ চালিয়ে গিয়েছিলেন। অত্যাচার, শোষণ এবং শাসনের নির্মমতা এখানেই ধরা পড়ে। কুঠিবাড়ির নায়েব বাড়ি ও এতিমখানা ছিল তখনকার সময়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র, যা আজ ধ্বংসের শিকার।

ব্রিটিশদের পতনের পর শাসন গ্রহণ করেছিল মেদিনীপুরের জমিদাররা। তবে ১৯৫১ সালের ১৭ ডিসেম্বর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এই দায়িত্ব আসে জেলা প্রশাসনের হাতে।

পরে জেলা পরিষদ ও অবশেষে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে কুঠিবাড়ির দেখভাল করা হয়।

পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি ও পুননির্মাণ:

১৯৭৮ সালের ১৩ মে খুলনা বিভাগের আমঝুপি অধিবেশনে এই ঐতিহাসিক নীলকুঠিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই সরকারী উদ্যোগে প্রায় ১৮ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নিয়ে ‘রি-মডেলিং’ কাজ করা হয়। বর্তমানেও প্রধান ভবনটি দৃষ্টিনন্দন রূপ ধারণ করেছে। তবে, নির্মাণের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পেছনে রয়েছে ইতিহাসের কলঙ্কজনক সত্যও। কুঠিবাড়ির দেয়ালে খোদাই করা আছে নবাব সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মীর জাফর ও লর্ড ক্লাইভের গোপন বৈঠক হওয়ার মিথ্যা কাহিনী।

এটি ইতিহাস বিকৃতির এক দৃষ্টান্ত, যা আজও স্মরণ করিয়ে দেয় ক্ষমতার ছায়ায় ইতিহাস কিভাবে বিকৃত হয়।

আমঝুপি নীলকুঠির নির্মাণকাল ধরে নেওয়া হয় ১৮০০ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীল ব্যবসা চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল। বেনিয়ারা এই কুঠিকে ব্যবহার করত নীলচাষ তদারকি ও উৎপাদনের ঘাঁটি হিসেবে। বাংলার শেষ নবাবের পতন ১৭৫৭ সালে। শেষ নবাবের পতনের ৫০ বছর পর স্থাপিত কুঠিবাড়িতে সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে গোপন বৈঠক ইতিহাসবিদদের লজ্জিত করে।

দেশের একমাত্র এই নীলকুঠিটি এখনও টিকে আছে। মূলভবনের পাশে স্মৃতিহিসেবে এখনও প্রতিবছর নীলগাছের চারা গজায়। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবক্ষয় ও বিলুপ্তির পথে নিদর্শন:

আমঝুপি নীলকুঠি আজও কাজলা নদীর তীর ঘেঁষে পাখির ডাক আর ছায়ায় ঘেরা। তবে এর আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। ঘোড়ার ঘর, রেকর্ড বিল্ডিং, পেট্রোল হাউজ ধ্বংসের দিকে। 

গাছপালা মরে যাচ্ছে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

যদিও মূল ভবনটি রি-মডেলিংয়ের ফলে সুন্দর হয়েছে, তবুও গোটা এলাকার সংরক্ষণে এখনো বড় ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন। ভ্রমণপিপাসু মানুষ আজও এখানে আসেন, উপজেলা প্রশাসন ২০ টাকা করে প্রবেশ ফি নেয় দর্শনার্থীদের কাছ থেকে।

মেহেরপুরের অন্যান্য কুঠিবাড়ির অবস্থা:

আমঝুপি নীলকুঠির মতো মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভাটপাড়া কুঠিবাড়ির অবস্থা করুণ। পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি ধ্বংসের পথে। জানালা-দরজা চুরি হয়ে গেছে, অনেক জায়গায় ইট খুলে নিয়ে যাচ্ছে। ১৮৫৯ সালে নির্মিত এই কুঠিবাড়ি প্রায় ২৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন ঝুঁকির মুখে।

অন্যদিকে, মেহেরপুরের তেতুলবাড়িয়া, ভবানীপুর, বামুন্দি, রতনপুর, গাংনীসহ অন্যান্য গ্রামের নীলকুঠি ধ্বংস হয়ে গেছে। এগুলো শুধু স্থাপনা নয়, বাংলার ইতিহাসের প্রাণ। সেগুলো সংরক্ষণে সক্রিয় পদক্ষেপ না হলে ইতিহাস হারিয়ে যাবে নিঃশব্দে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়িত:¡

আমঝুপি নীলকুঠি ও মেহেরপুরের অন্যান্য নীলকুঠি শুধু একটি পুরনো ভবন নয়, এগুলো বাংলার শোষণ, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসের বহনকারী। সুতরাং এগুলোকে সংরক্ষণ করে আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরা সময়ের দাবি। 

মেহেরপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যের লেখক তোজাম্মেল আযম বাসসকে বলেন,  সরকারি উদ্যোগ, স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি এবং জনসচেতনতা মিলে সম্ভব এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। নইলে একসময় শুধু বই-ঐতিহাসিক দলিলেই থেকে যাবে এই স্মৃতিগুলো, জীবন্ত হয়ে না উঠতে পারবে আর কখনও। আমঝুপি নীলকুঠির মতো ইতিহাসকে রক্ষা করা মানেই দেশের ঐতিহ্যকে রক্ষা করা, যেখানে লুকিয়ে আছে বাংলার মানুষের সংগ্রামের রক্তচক্ষু, সেখানেই নিহিত থাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা ও অহংকার। এই ইতিহাস লেখক রুঠিবাড়ির  ভবনের ওয়ালে নবাব সিরাজ  উদ দৌলার বিরদ্ধে যে এপিটাপ লেখা হয়েছে সেই মিথ্যা ইতিহাস সরাবারও দাবি করেছেন।

মেহেরপুর সদর উপজেলা প্রশাসন খায়রুল ইসলাম বাসস‘কে বলেন, বাউন্ডারি ওয়ালসহ অন্যান্য সমস্যা চিহ্নিত করে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। শিঘ্রই কার্যক্রম শুরু হবে।