ভোটের নিরাপত্তা আর অন্যান্য প্রস্তুতি কতদূর এগোল?

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ‘নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলায় নানামুখী উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন—ইসি।
এর অংশ হিসেবে আগামী ২০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে সংলাপে বসতে যাচ্ছে কমিশন। সেই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিনিধিদের নিয়ে ২২ অক্টোবর মাঠ প্রশাসন সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
ভোট প্রস্তুতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, “দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার সাথে আমরা আলাপ করব।
“…আমাদের যে রোডম্যাপ দিয়েছি বা কর্মপন্থা দিয়েছি, সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে, কিছু বাকি, আছে যা যথাসময়ে সম্পন্ন হবে; মোটামুটি সবগুলো কাজ মোটাদাগে হয়ে গেছে। প্রস্তুতির কাজগুলো হচ্ছে।…আমরা আমাদের মতো প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি এটাই বার্তা।”
প্রাক-প্রস্তুতিমূলক সভায় ১৩ বিষয়ে অগ্রাধিকার
সংসদ নির্বাচন আয়োজনে নিরাপত্তাই যে বড় চ্যালেঞ্জ তা মানছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন।
তিনি গত ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামে বলেছিলেন, “তবে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে ভোট গ্রহণের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সিকিউরিটি চ্যালেঞ্জেস। নিরাপত্তা এটা একটা বিরাট আকারে দেখা দিয়েছে।
“এটা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। এটা মোকাবিলাটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে।”
বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করছে। তাতে বিরাজমান আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, ভোটের পরিবেশ ও ইসির শক্ত ভূমিকা নেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০ অক্টোবর আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে বসতে যাচ্ছে ইসি।
এ মতবিনিময় সভায় থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান, বিমান বাহিনী প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, আইজিপি। এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপি, ডিজিএফআই, এনএসআই, এনটিএমসি, র্যাব, এসবি ও সিআইডির মতো সংস্থাগুলোর প্রধানের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এআই, ড্রোন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, নিরাপত্তাসহ আলোচ্যসূচিতে রয়েছে—
>> ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন,
>> আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধন ও সুসংহতকরণ;
>> সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা;
>> অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার রোধ ও নিয়ন্ত্রণ;
>>এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের প্রচারণা রোধে কৌশল নির্ধারণ;
>> নির্বাচনে বিদেশি সাংবাদিক ও প্রাক পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রদান;
>> পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থাপনা;
>> নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনের পরিকল্পনা;
>> অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ;
>> পার্বত্য/দুর্গম এলাকায় নির্বাচনি সরঞ্জাম পরিবহন এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের জন্য হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান;
>> গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতামত বা পরামর্শের আলোকে শান্তিশৃঙ্খলা বিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ;
>>ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের বৈঠক শেষে গেল জুলাইয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, এবারের ভোটে ৮ লাখের মোতা আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে।
এর মধ্যে ৫ লাখ ৭০ হাজার হচ্ছেন আনসার এবং ১ লাখ ৪১ হাজার হচ্ছেন পুলিশের সদস্য। ৪৭ হাজারের মতো পুলিশ থাকবে ভোট কেন্দ্রে। ১৬ হাজারের মতো ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে ধারণাও দেওয়া হয় বৈঠকে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ের প্রায় ৮০ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন করা হবে।
>>বর্তমানে ১২ কোটি ৬৩ লাখের মতো ভোটার রয়েছে। পুরুষ ৬,৩৯,২৮,৮০৯ জন; নারী ৬,২৩,০৬,১৭৭ জন; হিজড়া ১,১৮৫ জন।
>>ভোটকেন্দ্র (খসড়া) ৪২,৬১৮টি; ভোটকক্ষ ২,৪৪,০৪৬টি (খসড়া)।
>>গতবার রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন ৬৬ জন; এবার এখনো ঠিক হয়নি।
>>গতবার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন ৫৯২ জন; এবার এখনো ঠিক হয়নি।
সবশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ১১ কোটি ৯৭ লাখ; ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২ হাজারের বেশি, ভোটকক্ষ ছিল ২ লাখ ৬১ হাজারের বেশি। প্রতিকেন্দ্রে ছিল ১৫-১৭ জন নিরাপত্তা সদস্য।
সবমিলিয়ে আনসার সদস্য ছিল ৫ লাখ ১৬ হাজার জন, পুলিশ ও র্যাব সদস্য ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন, কোস্ট গার্ড দুই হাজার ৩৫০ জন এবং ৪৬ হাজার ৮৭৬ জন বিজিবি সদস্য এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় অর্ধলাখ।
অন্য প্রস্তুতি কতদূর
এ সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্বাচনি প্রশিক্ষণ। ভোটের কথা মাথায় রেখে এখন থেকে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনে এবং অফিসের পরেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে ইসি।
ইতোমধ্যে দুই দফা ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। ৩১ অক্টোবর হালনাগাদ শেষে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ১৮ নভেম্বর।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ চূড়ান্ত হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সম্ভাব্য তালিকা চলতি মাসের মাঝামাঝি হবে, দুটি নতুন দল নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটাও শেষ ধাপে রয়েছে।
নির্বাচনি আইন-বিধি সংস্কারের বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে; সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সায় দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ; আচরণবিধি জারির অপেক্ষায় রয়েছে।
অংশীজনের সংলাপ শুরু হয়েছে। এ মাসে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলবে ধাপে ধাপে। নভেম্বরে সব ধরনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিলের অপেক্ষা করবে ইসি।
সেপ্টেম্বরে দল নিবন্ধন ও আরপিও সংস্কারের কাজ শেষ করার কর্মপরিকল্পনা থাকলেও তা পিছিয়ে গেছে।
নতুন একডজন দল নিয়ে পুনঃতদন্ত এবং আইন সংস্কারের সরকারের সায় পেতে বিলম্বের কারণে দুটি বিষয়ে ‘রোডম্যাপ বাস্তবায়নে’ সূচিতে জট শুরু হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রবাসী ভোটিংয়ের নিবন্ধন অ্যাপ উদ্বোধন ও প্রচারণা শুরু হয়নি এখনও।
সবশেষ অগ্রগতি তুলে ধরে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ মঙ্গলবার বলেছেন, “ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী রোডম্যাপ ধরে প্রস্তুতি চলছে। ফেব্রুয়ারির ভোটের জন্য প্রস্তুতির সব কাজ বেশ ভালোভাবে এগোচ্ছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজ শেষ হয়েছে।
“পর্যবেক্ষক সংস্থার বিষয়ে আপত্তি আবেদনগুলো যথাসময়ে নিষ্পত্তি হবে। দল নিবন্ধনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে; নিবন্ধন অ্যাপ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বা নভেম্বরের শুরুতে উদ্বোধন হবে।”