বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১১ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

তাবলীগ জামাতের সাথীদের প্রতি নিবেদন: মাকছাদ যেন ভুলে না যাই

আবু হাসসান রাইয়ান বিন লুৎফর রহমান

 প্রকাশিত: ২৩:১০, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২

তাবলীগ জামাতের সাথীদের প্রতি নিবেদন: মাকছাদ যেন ভুলে না যাই

আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন। আমাদের হুকুম করেছেনআমরা যেন জীবনের সর্ব অঙ্গনে এই দ্বীনের বিধি-বিধান পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করি। সেইসঙ্গে সমাজের সর্বস্তরে এই দ্বীনের শিক্ষা ও নির্দেশনাসমূহ ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার প্রচেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করি।

মূলত দাওয়াত-ওয়াজতাবলীগ-তালীমতারগীব-তারহীবআমর বিল মারূফ-নাহী আনিল মুনকারজিহাদ ফী সাবীলিল্লাহতাযকিয়া ও সুলূকঅন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা এবং এধরনের আরো যত বৈধ পন্থা আছে সবগুলো দ্বীনের খেদমত ও নুসরতের এক একটি শাখা। প্রতিটি শাখার সাথে ছোট ছোট অনেক প্রশাখা রয়েছে।

স্বয়ং দাওয়াত ইলাল্লাহ-এরই বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। বিভিন্ন পন্থায় দাওয়াত ইলাল্লাহ-এর মেহনত হয়েছেহচ্ছে। তেমনই একটি গুরুত্বপর্ণউপকারী ও ফলপ্রসূ মেহনত হলহযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর দাওয়াতী মেহনত।

শরীয়ত দাওয়াতের বিভিন্ন নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এর মৌলিক বিধানসমূহ বাতলে দিয়েছে। এসব নীতিমালা ও বিধানাবলির অনুসরণ করা প্রত্যেক দাঈ ও দাওয়াতী জামাতের সার্বক্ষণিক কর্তব্য। এসব নীতি ও বিধানের আওতায় থেকে দাওয়াতের পদ্ধতি-স্থান-কাল পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন হতে পারে।

বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাঈ ছিলেন হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.। তিনি কুরআন-সুন্নাহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত ও সীরাতে সাহাবার দাওয়াত অংশটি মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বড়দের সঙ্গে পরামর্শ ও মতবিনিময় করেছেন। অতঃপর দাওয়াতের একটি কর্মপদ্ধতি প্রস্তুত করেছেন। দিন যত অতিবাহিত হয়েছে এই দাওয়াতী মেহনত ততই অগ্রসর হয়েছে। অবশেষে আল্লাহর ইচ্ছায় এই দাওয়াতী মেহনত সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। আর মুসলিম উম্মাহ ব্যাপকভাবে এই মেহনতের সুফল ও কল্যাণ লাভ করেছে। আল্লাহ যেন এই দাওয়াতী কার্যক্রমকে কিয়ামত পর্যন্ত কবুল করে নেন এবং সবধরনের ফেতনা-ফাসাদ থেকে নিরাপদ রাখেন- আমীন।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. যেসকল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে এই দাওয়াতী মেহনত আরম্ভ করেছিলেনতন্মধ্যে অন্যতম বুনিয়াদি উদ্দেশ্য ছিলসাধারণ মানুষকে আলেমদের কাছাকাছি নিয়ে আসা। তাদের অন্তরে আলেমদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা জাগ্রত করা। সেইসাথে তাদেরকে এমনভাবে তরবিয়ত করাযাতে তারা নিজেরাই আলেমদের সোহবতে গিয়ে জরুরি দ্বীনী ইলম হাসিল করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এককথায় সাধারণ মানুষকে উলামামুখী করে তোলা ছিল এই দাওয়াতী মেহনতের মৌলিক উদ্দেশ্য। যে কোনো ব্যক্তি হযরতের জীবনীমালফুযাতমাকতুবাতে নজর বুলালেই এই সত্য উপলব্ধি করতে পারবে। নিম্নে আমরা কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি :

এক.

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. বলেন-

আমাদের এই দাওয়াতী আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই হলরাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত পূর্ণ দ্বীন শিক্ষা দেওয়া। অর্থাৎ ইসলামের পূর্ণ ইলমী ও আমলী নেযামের সাথে এই উম্মতকে জুড়ে দেয়া। এটা হল আমাদের আসল উদ্দেশ্য।... এটাও স্পষ্ট কথা যেআমাদের জামাত পরিপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম নয়। ব্যসতারা শুধু এতটুকুই পারবেন যেসর্ব মহলে পৌঁছে মেহনত-মোজাহাদার মাধ্যমে এক ধরনের সচেতনতা ও জাগরণ এবং চেতনা ও বোধ পয়দা করবেন। উদাসীনদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করে স্থানীয় দ্বীনদারদের সাথে জুড়ে দেয়া এবং অত্র এলাকার ফিকিরমান্দ আলেম এবং নেককার ব্যক্তিবর্গকে এদের ইসলাহ ও সংশোধনের কাজে নিয়োজিত করার চেষ্টা করা।... নিজের জায়গার আহলে দ্বীন থেকে ইস্তেফাদা করলেই সাধারণ মানুষের জন্য বেশি উপকারী হবে।’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.পৃ. ৩২মালফুয নং ২৪জামাতে তাবলীগ পার ইতেরাজাত কে জাওয়াবাতপৃ. ২৩)

উপরোক্ত মালফুয থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যেএই মেহনতের একটি  মৌলিক উদ্দেশ্য হলসাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীন শেখার আগ্রহ ও সচেতনতা তৈরি করে তাদেরকে স্থানীয় আহলে ইলমের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা।

এই মালফুয থেকে আরেকটি বিষয় শেখার আছে। এটা স্বীকৃত বাস্তবতা যেসাধারণ মুবাল্লিগ সাথী ভাইদের পক্ষে সর্বসাধারণকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন শেখানো সম্ভব নয়। তাই তাঁদের দায়িত্ব হলআহলে ইলমের সোহবতে গিয়ে প্রয়োজনীয় দ্বীনী ইলম হাসিল করা এবং অন্যদেরকেও শেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। কোনোভাবেই নিজেদের এই সামান্য মেহনতকে উলামা-মাশায়েখের সোহবতের বিকল্প মনে করার সুযোগ নেই।

দুই.

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. অন্যত্র বলেন-

আমাদের জামাতের সাথীরা যেখানেই যাবেতাঁরা যেন সেখানকার হক্কানী আলেম ও নেককারদের খেদমতে হাজির হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এই উপস্থিতির একমাত্র উদ্দেশ্য হবে তাঁদের থেকে উপকৃত হওয়া। সরাসরি তাঁদেরকে এই কাজের দাওয়াত দেবে না। কেননা তাঁরা দ্বীনের যেসব খেদমতে ব্যস্ত আছেনসে বিষয়ে তাঁরা ভালোভাবেই অবগত এবং এর উপকারিতা সম্পর্কেও তাঁরা বেশ অভিজ্ঞ।...’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.পৃ. ৩৫মালফুয নং ২৯)

তিন.

হযরত রাহ. আরো বলেন-

আমাদের জামাতের সাথীদের জন্য তিন শ্রেণীর লোকদের কাছে তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিশেষভাবে যাওয়া উচিত। ১. উলামা ও নেককারদের খেদমতে দ্বীন শিক্ষা করা এবং দ্বীনের উত্তম প্রভাব গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে যাওয়া উচিত...।’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. পৃ. ৭৫মালফুয নং ৮৫)

চার.

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. তাবলীগের নীতিমালা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন-

আমাদের এই তাবলীগের কাজে সাধারণ মুসলমানদের ইজ্জত করা এবং আলেমদের সম্মান করা বুনিয়াদি বিষয়। সকল মুসলমানকে ইসলামের সুবাদে ইজ্জত করা আর আলেমদের ইলমে দ্বীনের সুবাদে বিশেষভাবে সম্মান করা উচিত।

তিনি আরো বলেন-

ইলম ও যিকির এখন পর্যন্ত আমাদের মুবাল্লিগদের আয়ত্তে আসেনি। যার কারণে আমি অত্যন্ত চিন্তিত। এর একমাত্র সমাধান হলসাথীদেরকে আহলে ইলম এবং আহলে যিকিরের নিকট পাঠিয়ে দেয়া। তাঁদের নেগরানীতে তাবলীগের কাজও করবে এবং তাঁদের ইলম ও সোহবত থেকে উপকৃত হবে।’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.পৃ. ৫৭মালফুয নং ৫৪)

পাঁচ.

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. আরো বলেন-

চার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের উচিত আলেমদের খেদমত করা :

... দ্বিতীয়ততাঁদের অন্তর ও দেহ ইলমে নববীর ধারক ও বাহকএই হিসেবেও তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্রখেদমতের উপযুক্ত।  তৃতীয়ত তাঁরা আমাদের দ্বীনী কাজের নেগরান ও তত্ত্বাবধায়ক।’ (মালফুযাত হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.পৃ. ৫৪মালফুয নং ৫২)

ছয়.

আজ থেকে ৩৮ বছর পূর্বে ১৯৮৪ সালে মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র আরব আজমের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ২২ শে মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কাকরাইল মসজিদে অতি মূল্যবান এক বয়ান পেশ করেছিলেন। সেই বয়ানে তিনি বলেছিলেন-

আমার নিজের কথা নয়হযরতজী রাহ. (ইলিয়াস ছাহেব রাহ.) অত্যন্ত দরদের সংঙ্গে দাওয়াত ও তাবলীগের সাথীদের বলতেনইলমের জন্য আলেমদের কাছে যাও। আলেমের কদর করোইকরাম করোআলেমের কাছে যাও ইলম হাছিল করার জন্য। তার ইলম থেকে ফায়দা হাছিল করার জন্য।

হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রাহ. খুব তাকীদ দিয়ে বলতেনআলেমের কাছে আমরা যেন দাওয়াত নিয়ে না যাইবরং ইলমের তলব নিয়ে যাই। দুআর জন্য যাইছোহবত হাছিলের নিয়তে যাই। ফায়দা পৌঁছানোর জন্য যেন না যাইফায়দা হাছিল করার জন্য যাই।

হযরতজী রাহ.-এর একটা কথা এখনো আমার কানে বাজেবড় দরদপূর্ণ আওয়াজে তিনি বলতেনআমি তো এই কাজ শুরু করেছি মানুষকে উলামামুখী করার জন্যমানুষকে আলেমদের থেকে বিমুখ করার জন্য নয়।’ (দেখুনপশ্চিম দিগন্তেপূর্ব দিগন্তেপৃষ্ঠা ৫০৬সংকলন : মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুম)

সাত.

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল এই দাওয়াতী মেহনতের মাধ্যমে উলামা এবং আওয়ামকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসা। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন-

এই দাওয়াতী মেহনতের মাধ্যমে আমরা সর্বত্র উলামা-দ্বীনদার এবং দুনিয়াদারদের মাঝে প্রীতি-সম্প্রীতি এবং সমঝোতা-সহানুভূতীশিলতা সৃষ্টি করতে চাই।...’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.পৃ.  ৮৪মালফুয নং ১০২)

এ প্রসঙ্গে হযরত আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. লেখেন-

এ কারণেই আওয়াম ও উলামায়ে কেরামের অপরিচয় ও দূরত্ব কিছুতেই তাঁর বরদাশত ছিল না। এটাকে তিনি উম্মতের বিরাট দুর্ভাগ্যইসলামের ভবিষ্যতের জন্য বিরাট খতরা এবং ধর্মহীনতা ও ধর্মদ্রোহিতার পূর্বলক্ষণ মনে করতেন। মাওলানা তাঁর দাওয়াতী মেহনতের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন যেএ কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আওয়াম ও উলামায়ে কেরাম পরস্পর কাছাকাছি হতে পারবেন এবং একে অপরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারবেন।...

মাওলানা একদিকে উলামায়ে কেরামকে দাওয়াতের মাধ্যমে আওয়ামের কাছে যাওয়ার এবং আওয়ামের প্রতি দরদী হওয়ার তাকীদ করতেন। অন্যদিকে আওয়ামকে উদ্বুদ্ধ করতেনযেন তারা উলামায়ে কেরামের কদর ও মর্যাদা বুঝে এবং উসুল আদব রক্ষা করে তাদের খেদমতে হাজির হয় এবং প্রয়োজনীয় ইলম হাছিল করে। তাদেরকে তিনি উলামায়ে কেরামের যিয়ারাত ও মুলাকাতের সওয়াব এবং তাঁদের খেদমতে হাজির হওয়ার উসূল ও আদব শেখাতেন।...

এভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণিকেও উলামায়ে কেরামের এতো কাছে তিনি নিয়ে এসেছিলেন যেবিগত বহু বছরে সম্ভবত খেলাফত আন্দোলনের পরে (অর্থাৎ তাহরীকে খেলাফতহযরত শায়খুল হিন্দ) এমনটি কখনো দেখা যায়নি। ...হযরত মাওলানার এসকল প্রচেষ্টা ও কর্মকৌশল এতটুকু সফল অবশ্যই হল যেঅন্তত দাওয়াতী পরিম-লে আওয়াম দ্বীনের খাতিরে রাজনৈতিক বিরোধ বরদাশত করে নিল এবং রাজনৈতিক মতভিন্নতা সত্ত্বেও হক্কানী উলামায়ে কেরামের প্রতি ইজ্জত সম্মান এবং তাঁদের বড়ত্ব ও মর্যাদার স্বীকৃতিদানের একটি সুযোগ হল। বড় বড় ব্যবসায়ীযারা বহু বছর ধরে উলামায়ে কেরামের প্রতি কেমন হয়ে ছিলতারাও বা-আদব সেখানে হাজির হতে লাগলেন এবং নিজেদের তাবলীগী জলসায় যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে তাদেরকে নিতে লাগলেন।’ (হযরত মাওলানা ইলিয়াস আওর উনকী দ্বীনী দাওয়াতপৃ. ১৪০-১৪১অনুবাদ : মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুম)

আট.

প্রথম হযরতজী রাহ.-এর ন্যায় দ্বিতীয় হযরতজী মাওলানা ইউসুফ ছাহেব রাহ. বিভিন্ন প্রসঙ্গে দাওয়াতী মেহনতের এই মৌলিক উদ্দেশ্যের কথা বারবার তুলে ধরেছেন।

একবার তিনি বললেন-

আমি দেওবন্দসাহরানপুরে যেসকল জামাত পাঠিয়ে থাকিতার উদ্দেশ্য এই নয় যেতারা আলেমদেরকে তাবলীগ করবেতাঁদেরকে দাওয়াত দেবেবরং আমার উদ্দেশ্য হলবর্তমানে আওয়াম আলেমদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তারা যেন আলেমদের নিকটবর্তী হয়ে যায়। আর এর মধ্যেই আওয়ামের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইউসুফ রাহ.পৃ. ১১৬মালফুয নং ১৯৯)

নয়.

দাওয়াত ও তাবলীগের উসূল সম্বলিত এক দীর্ঘ চিঠিতে মাওলানা ইউসুফ ছাহেব রাহ. লেখেন-

শয়তানের উপর একজন আলেম হাজার আবেদ অপেক্ষা বেশি ভারী।... আলেমদের খেদমতে হাজির হতে হবে এবং এটাকেও ইবাদত হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে।।’ (তাযকেরায়ে হযরতজী মাওলানা ইউসুফ রাহ.পৃ. ৯৮সংকলক : মাওলানা মানযুর নোমানী রাহ.)

দশ.

হযরত মাওলানা ইউসুফ ছাহেব রাহ. আলহাজ্ব মাওলানা ফযলে আলীম সাহেব মুরাদাবাদী মাক্কীর নামে লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে লেখেন-

মানবজীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলইলম ও যিকিরের ব্যস্ততা। এর জন্য নিয়মিত দুটি গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে।

এক. আহলে ইলম ও আহলে যিকিরের আযমত ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা। নিজেদের যাবতীয় বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করা এবং তাঁদের যাবতীয় হক আদায় করা।’ (জামাতে তাবলীগ পার ইতেরাযাত কে জাওয়াবাতশায়েখ যাকারিয়া রাহ.পৃ. ২৭)

আলেমদের সমালোচনায় লিপ্ত হওয়াতাঁদের প্রতি বদগুমানী ও বদযবানী করা থেকে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-সহ অন্যান্য আকাবিরে তাবলীগ সর্বদা কঠোরভাবে বারণ করেছেন। এমনকি এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেও সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. বলেন-

জামাতের সাথীদেরকে ভালোভাবে নসীহত করে দেয়া হোক যেযদি উলামায়ে কেরামের দিক থেকে এই কাজের প্রতি অমনোযোগিতা পরিলক্ষিত হয়তবে যেন তাদের দিলে আলেমদের প্রতি কোনো ধরনের বিরূপ মনোভাব তৈরি না হয়। বরং মনে করতে হবে যেআলেমগণ আমাদের থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন। অন্যরা যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকেনতখনও রাত জেগে তাঁরা ইলমে দ্বীনের খেদমতে ব্যস্ত থাকেন।

তাঁদের অমনোযোগিতার জন্য নিজেদের দায়ী মনে করতে হবে। কেননা আমরা তাঁদের কাছে যাতায়াত কম করেছি। এজন্য যারা তাঁদের খেদমতে বছরকে বছর পড়ে আছে স্বভাবতই তারা উলামায়ে কেরামের অধিক মনোযোগ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

অতঃপর তিনি বললেন-

একজন সাধারণ মুসলমানের প্রতি অনর্থক বদগুমানি করা ধ্বংসাত্মক কাজ। আর আলেমদের প্রতি বদগুমানী ও বদযবানী করা তো আরও মারাত্মক অপরাধ।’ (মালফুযাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.পৃ.  ৫৬মালফুয নং ৫৪)

১৯৮৪ সালের ২২ শে মার্চ বৃহস্পতিবার বাদ মাগরিব কাকরাইল মসজিদে সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. বয়ানের শেষে বলেছিলেন-

একটা জরুরি কথা রয়ে গেছে। সেটা হলআলেমের ইকরাম। হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রাহ. এ বিষয়ে বারবার তাকীদ করতেন যেদিলের মধ্যে আলেম ও আহলে ইলমের মহব্বত ও ইকরাম যেন থাকে। তাঁদের কোনো ভুল যদি নযরে পড়ে নযর নামিয়ে ফেলো। আলেমের প্রতি মন্দ ধারণা দ্বীনের জন্য বড় ক্ষতিকর।’ (পশ্চিম দিগন্তেপূর্ব দিগন্তেপৃ. ৫১সংকলন : মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুম)

দাওয়াত ও তাবলীগের এই মেহনতের অনেক বড় মুরব্বী ছিলেন হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ খান ছাহেব রাহ.। তিনি তাঁর এক দীর্ঘ চিঠিতে তাবলীগের সাথীদের উদ্দেশে লেখেন-

দ্বিতীয় কথা হল এই যেআহলে ইলম ও আহলে যিকিরের বিরুদ্ধে উপহাসমূলক কোনো কথা যেন যবান দ্বারা উচ্চারিত না হয়। প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের প্রতি ইকরাম ও সম্মান বজায় রাখাতাঁদের সাথে আদবের সাথে কথা বলা জরুরি। এর দ্বারা নিজেদের তরবিয়ত হয় এবং উত্তম গুণাবলি অর্জন হয়।’ (মাকাতিবে মাওলানা সাঈদ আহমাদ খান রাহ.পৃ. ৩৬চিঠি নং ১০)

আমরা সকল তাবলীগী ভাইদের প্রতি বিনীত নিবেদন পেশ করছিআলেমদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ রেখে নিজেদের আখেরাত বরবাদ না করি। অতীতের ভুল থেকে তওবা করে নিজেদের সংশোধন করি। ইলম ও যিকিরের শিক্ষা মোতাবেক আলেমদের সোহবতে গিয়ে ফরযে আইন ইলম হাছিল করি এবং সর্বসাধারণকেও উলামামুখী করার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করে নিন- আমীন।

পুনশ্চ

সাথীদের প্রতি বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেকের আরয হল-

মাওলানা আবু হাসসান রাইয়ান একটি আহাম উসূলের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সকল সাথীর উচিততাবলীগের আকাবিরের এই হেদায়েতসমূহের গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং আমলে পরিণত করতে সচেষ্ট হওয়া।

তবে একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজনতা হলপ্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই ইতিদাল ও ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। কোনো কাজের ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা কাম্য নয়। কিছু সাথীকে দেখা যায়তারা -মাশাআল্লাহ- উলামায়ে কেরামের সাথে সম্পর্ক রাখেনমাশায়েখের ইসলাহী মজলিসেও হাজির হনকিন্তু সাথে সাথে তাদের মাঝে একটি অবহেলাও পরিলক্ষিত হয়- তারা তাবলীগের কাজ একেবারেই ছেড়ে দেন অথবা কমিয়ে দেন।

স্মরণ রাখুনএ অবস্থার সংশোধন জরুরি। কারণ এ থেকে অন্য সাথীদের প্রতি একটি ভুল বার্তা পৌঁছে। এ দেখে তাবলীগী অন্য ভায়েরা বলতে পারেআমরাও যদি উলামায়ে কেরামের কাছে যাই অথবা মাশায়েখের ইসলাহী মজলিসে হাযির হই তাহলে আমাদের অবস্থাও তাদের মত হবে। এ বাহানায় ওই সাথীরা উলামায়ে কেরামের সোহবতের কল্যাণ থেকে মাহরূম হবে। সুতরাং চিন্তা-ভাবনা ও মশওয়ারার মাধ্যমে একটি সুন্দর নেযামুল আওকাত তথা কাজের তারতীব বানিয়ে নেওয়া উচিতযার ভিত্তিতে তাবলীগী মেহনতও জারি থাকবেমাশায়েখের সোহবত থেকে ফায়েদা উঠানোও জারি থাকবে।

মুতাদিল মেযাজ তাজরেবাওয়ালা সাথীদের থেকে মশওয়ারা নিয়ে চললে সহজেই সবদিক রক্ষা করে চলা সম্ভব হবে। -বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

মন্তব্য করুন: