শুক্রবার ০৩ অক্টোবর ২০২৫, আশ্বিন ১৭ ১৪৩২, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

ইসরাইলি অবরোধ উপেক্ষা করে গাজা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে ফ্লোটিলা

 প্রকাশিত: ১৭:৫০, ২ অক্টোবর ২০২৫

ইসরাইলি অবরোধ উপেক্ষা করে গাজা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে ফ্লোটিলা

ঢাকা, ২ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : মানবিক ত্রাণ ও কর্মীদের বহনকারী আন্তর্জাতিক বেসামরিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরাইলি নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে।

আক্রমণাত্মক বাধাদানের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আয়োজকরা দাবি করেছেন, অনেক জাহাজ গাজায় পৌঁছাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা এই মিশনকে দীর্ঘস্থায়ী সমুদ্র অবরোধ ভাঙার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

নৌবহর সূত্রে জানা যায়, ১ অক্টোবর ক্যামেরা বন্ধ এবং জিপিএস সিগন্যাল বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি জাহাজের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাহাজগুলো বাধাগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে একটি ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া ইসরাইলি বাহিনী বোর্ডিং অভিযানও চালিয়েছে।

বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, বেশ কয়েকজন কর্মীকে আটক করে নৌযান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ‘ডন’-এর খবরে বলা হয়েছে, নৌবহর ঘোষণা করেছে, তাদেরকে ‘বেআইনীভাবে আটক’ করা হয়েছে এবং কমপক্ষে তিনটি জাহাজে আক্রমণ করা হয়েছে।

ফ্লোটিলা আরও জানায়, ইতোমধ্যে তারা ২০টিরও বেশি অজ্ঞাতনামা জাহাজকে কাছাকাছি আসতে দেখেছে, যা নৌ অবরোধ শুরুর ইঙ্গিত বহন করে।

এপি জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী গাজা থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে নৌবহরের ১৯টি জাহাজ আটকে দিয়েছে। কয়েকজন কর্মী বর্ণনা করেছেন, এই বাধা প্রক্রিয়ায় নৌবাহিনীর সতর্কবার্তা, বাজেয়াপ্তের হুমকি এবং ওয়াটার ক্যাননের ব্যবহার ছিল। বাধা সত্ত্বেও বহু নৌযান সামনে এগোচ্ছে বলে জানা গেছে।

রয়টার্স জানিয়েছে, ফ্লোটিলা গাজার উপকূল থেকে প্রায় ১২০ নটিক্যাল মাইলের কাছাকাছি পৌঁছালে ভোর হওয়ার আগেই অজ্ঞাত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহাজগুলো নৌবহরের কাছে আসে। এরপর তারা আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বন করে এবং নৌবহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফ্লোটিলা ড্রোন হামলা (স্টান গ্রেনেড ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে) এবং সংকেত দমনের অভিযোগ করেছে। তবে ইসরাইল প্রকাশ্যে এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেনি।

রয়টার্সের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়োজকরা জানায়, ত্রাণবহনকারী ১৩টি নৌকা আটকে দেওয়া হয়েছে। তবে আরও ৩০টি জাহাজ এখনো গাজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আটককৃতদের মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও ছিলেন।

বিক্ষোভকারীরা এই বাধাগুলোকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় সামুদ্রিক আইন লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানিয়েছেন। ঘটনাটি বৈশ্বিক কূটনৈতিক মহলেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, নৌপথে হয়রানির শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন ফ্লোটিলার সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, ইসরাইলি নৌযানগুলো ত্রাণবাহী জাহাজগুলোকে ঘিরে ধরে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল এবং প্রায় ১৪০ মাইল সমুদ্র উপকূলে নৌবহরটিকে নিয়ে গিয়েছিল।

পত্রিকাটি জানিয়েছে, ইতালি এবং গ্রীস ইসরাইলকে নিরাপদ যাত্রাপথের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে আয়োজকরা গির্জা বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিকল্প সরবরাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জোর দিয়ে বলছেন, সরাসরি সমুদ্রপথে সাহায্য পৌঁছানোই এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, যাত্রার শুরুতে ফ্লোটিলার দুর্বলতাগুলোও নিশ্চিত হয়েছে। এপি জানিয়েছে, গ্রিসের দক্ষিণে ফ্লোটিলার জাহাজ ড্রোন হামলার শিকার হয়েছিল, ফলে বিস্ফোরণ এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে এ আক্রমণ মিশনটিকে নতুন ধরনের ঝুঁকিতে ফেলে।

এর আগেও তিউনিসিয়ার জলসীমায় সিদি বো সাইদে নোঙর করা পর্তুগিজ পতাকাবাহী নৌবহরের ড্রোন হামলার অভিযোগের খবর প্রকাশ করেছে রয়টার্স। ওই জাহাজটিতে আগুন লাগে, তবে সবাই অক্ষত ছিলেন। দেশটি ড্রোন হামলার ঘটনা অস্বীকার করেছে।

ফ্লোটিলার সমন্বয়কারী সংস্থা সুমুদ নুসান্তারা কমান্ড সেন্টার (এসএনসিসি) জানিয়েছে, দুটি প্রধান জাহাজ আলমা এবং সিরিয়াসকে একটি সামরিক জাহাজ দ্বারা ঘিরে ফেলা হয়। এতে তাদের সিসিটিভি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। এসএনসিসি এই ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছে।

মালয়েশিয়ার দ্য স্টার জানিয়েছে, একটি ইসরাইলি যুদ্ধজাহাজ আলমার মাত্র পাঁচ ফুট দূরত্বে ছিল এবং সিস্টেমে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবে পরে সেটি চলে যায়।

এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে স্পষ্ট ঘোষণা করেছে, গাজার যেসব এলাকায় এখনও যুদ্ধ চলছে সেখানে জাহাজ ঢুকতে দেবে না এবং নৌ-অবরোধ প্রত্যাহার করবে না। তারা বিকল্প পথ হিসেবে গাজার সাহায্য পৌঁছে দিতে অ্যাশকেলন মেরিনায় জাহাজ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

এ ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ ১৫টি দেশ যৌথ বিবৃতিতে ফ্লোটিলার সুরক্ষা ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। বেলজিয়াম ড্রোন হামলার তদন্তের দাবি তুলেছে, আর মালয়েশিয়া নিরাপদ সমুদ্রপথ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে। 

আল জাজিরা জানিয়েছে, ইসরাইলি বাহিনী ১৩টি জাহাজ থামিয়েছে এবং ২শ’র বেশি মানুষকে আটক করেছে। তাদের মধ্যে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থানবার্গও রয়েছেন।

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা লাইভ ট্র্যাকার অনুযায়ী মিকেনো নামে একটি জাহাজ বর্তমানে গাজার জলসীমায় রয়েছে। তবে ইসরাইলি বাহিনী সেটিকে আটক করেছে কি না তা এখনো জানা যায়নি।

ইসরাইলি কমান্ডোরা ফ্লোটিলা নৌযানগুলোতে বাধা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে বহরে সক্রিয় জাহাজের সংখ্যা ২৪টি, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি গাজার জলসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।

এই পটভূমিতে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমের অংশগ্রহণ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ফ্লোটিলার অভিযানের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। আলম জানিয়েছেন, তিনি ‘বাংলাদেশের সকল মানুষের ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে’ অংশ নিচ্ছেন এবং গাজার পরিস্থিতি গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আইনগত দিক থেকে, ফ্লোটিলা ও ইসরায়েলের সংঘর্ষ নিয়ে কিছু জটিল প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, আন্তর্জাতিক জলে বেসামরিক জাহাজ আটক করা কি ঠিক, অবরোধ কতটা বৈধ ও সঠিকভাবে হয়েছে, এবং নিরপেক্ষ জাহাজের অধিকার কী হবে। 

যদিও ইসরাইল বলছে, নিরাপত্তার জন্য এই অবরোধ প্রয়োজন। তবে সমালোচকরা বলছেন, এটি সাধারণ মানুষের ওপর দমন ও মানবিক নীতির লঙ্ঘন।

ফ্লোটিলা এখন গাজার ১২০ নটিক্যাল মাইলের কম দূরত্বে অবস্থান করছে। এলাকাটিকে আয়োজকরা ‘উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ অবস্থায় বহরের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাহাজগুলো কি জোরপূর্বক আটক হবে, গ্রেফতার করা হবে, নাকি আংশিকভাবে স্থলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে? তবে আয়োজকরা বলছেন, সব ঘটনার তথ্য লাইভ রেকর্ড করা হচ্ছে যাতে যে কোনো আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ সামনে আনা যায়।

ত্রাণবাহী নৌবহরটি গাজা উপকূলে পৌঁছাক কি না, তা এখন আর মূখ্য বিষয় নয়। ইতিমধ্যেই এই অভিযান অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এবং এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সমুদ্র সংঘর্ষের সঙ্গে যুক্ত করেছে।