মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১০ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠত্ব ও কিছু বৈশিষ্ট্য

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 আপডেট: ০৬:৩৬, ২৫ জানুয়ারি ২০২২

খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠত্ব ও কিছু বৈশিষ্ট্য

الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لاشريك له، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، خاتم النبيين لا نبي بعده، صلى الله تعالى وبارك وسلم، عليه وعلى آله الأطهار، ورضي الله تعالى عن صحابته الكرام الغر الميامين أجمعين، أما بعد!

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামকে আল্লাহ তাআলা অন্যান্য নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম থেকে অনেক বিষয়ে স্বাতন্ত্র্য দান করেছেন। তাঁকে বিশেষভাবে অনেক বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। সেসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হল, আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে নবুওত ও রিসালাতের ধারা সমাপ্ত করেছেন; তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ হওয়ার মর্যাদা দান করেছেন এবং এই উপাধিতে তাঁকে অভিষিক্ত করে কুরআনে কারীমে ঘোষণাও করে দিয়েছেন। তাঁর নবুওত ও রিসালাতকে ব্যাপক করে দিয়েছেন। বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও ভূখণ্ড সবকিছু ছাড়িয়ে কিয়ামত অবধি সকলের জন্য তাঁকে রাসূল বানিয়েছেন। সবার উপর তাঁর আনুগত্য ফরয করেছেন। তাঁকে নবুওত দানের পর দুনিয়াবী সফলতা ও পরকালীন মুক্তিকে তাঁর প্রতি ঈমান ও তাঁর অনুসরণের মধ্যে সীমিত করে দিয়েছেন।

 

অন্য অনেক বৈশিষ্ট্য ও ফযীলতের মত এই দুই বৈশিষ্ট্যও কুরআনে কারীমে স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে যেমনিভাবে তাঁর খাতামুন নাবিয়্যীন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তেমনি তাঁকে রাহমাতুল লিলআলামীন খেতাবও দান করেছেন। [দ্র. সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০; সূরা আম্বিয়া (২১) : ১০৭]

 আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট ঘোষণা-

 

وَ مَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا كَآفَّةً لِّلنَّاسِ بَشِیْرًا وَّ نَذِیْرًا وَّ لٰكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ.

আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। -সূরা সাবা (৩৪) : ২৮

কুরআনে কারীমে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যান্য গুণ ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনা যদি নাও করা হয় তবু শুধু এই দুই বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং ‘সায়্যিদুন নাস’ (অন্য শব্দে সায়্যিদু উল্দি আদাম এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন) হওয়া প্রমাণিত হয়ে যায়। কিন্তু এ নিবন্ধে এই বাস্তবতাটি কুরআন কারীম থেকে পেশ না করে হাদীস শরীফ, সাহাবায়ে কেরামের বাণী এবং ইজমা তথা মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের আলোকে পেশ করব। শরীয়তের যে কোনো দলীলের মাধ্যমে কোনো বিষয় সাব্যস্ত হয়ে গেলে মুমিন সেটাকে সত্য ও সঠিক বলে মেনে নেয়। গোমরাহ লোকদের মত সে এই হঠকারিতা করে না যে, অমুক দলীলে প্রমাণিত হলে মানব, নতুবা মানব না। কেননা এ ধরনের হঠকারিতা কুফর। কুরআন যেসব বিষয়কে দ্বীন ও শরীয়তের দলীল সাব্যস্ত করেছে সবগুলোই দলীল। আর দলীলের মাধ্যমে প্রমাণিত সকল বিষয় সত্য এবং সঠিক। শরয়ী দলীলের মাধ্যমে প্রমাণিত কোনো বিষয়কে মিথ্যা বলাটাই স্বয়ং মিথ্যা এবং স্পষ্ট ভ্রষ্টতা।

হাদীসে বর্ণিত কিছু বৈশিষ্ট্য

১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন ইমামুন নাবিয়্যীন। সর্বপ্রথম তাঁরই সুপারিশের অনুমতি লাভ হবে এবং সর্বপ্রথম তাঁর সুপারিশই কবুল করা হবে

শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত নবী-রাসূলের ইমাম- এই বিষয়টি আল্লাহ তাআলা একবার মেরাজের রজনীতে প্রকাশ করেছিলেন। সে রাতে মসজিদে আকসায় সকল নবী তাঁর ইকতিদা করে নামায আদায় করেন। এই বিষয়টি বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

এই বিষয়টি আল্লাহ তাআলা দ্বিতীয়বার প্রকাশ করবেন সমস্ত বনী আদমের উপস্থিতিতে হাশরের ময়দানে। উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে শক্তিশালী সনদে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ كُنْتُ إِمَامَ النَّبِيِّينَ وَخَطِيبَهُمْ، وَصَاحِبَ شَفَاعَتِهِمْ غَيْرَ فَخْرٍ.

কিয়ামত দিবসে আমি সকল নবীর ইমাম হব। তাঁদের খতীব হব এবং শাফাআতকারীও হব। (এটা আল্লাহর নিআমত,) কোনো গর্ব নয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১২৪৫; কিতাবুয যুহদ, ইমাম ইবনুল মুবারক, হাদীস ১৬১৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩২২৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৯৪১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪৩১৪; আলমুসতাদরাক আলাস সহীহাইন, হাকেম আবু আব্দুল্লাহ, হাদীস ২৪১; আলআহাদীসুল মুখতারাহ, জিয়াউদ্দীন আলমাকদিসী, হাদীস ১১৭৯

এমনিভাবে নির্ভরযোগ্য সনদে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেন-

أَنَا قَائِدُ الْمُرْسَلِينَ وَلَا فَخْرَ، وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ وَلَا فَخْرَ، وَأَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ وَلَا فَخْرَ.

আমি রাসূলগণের সরদার; কোনো গর্ব নয়। আমি সর্বশেষ নবী; কোনো গর্ব নয়। আমি সর্বপ্রথম সুপারিশকারী; কোনো গর্ব নয়। সর্বপ্রথম আমার সুপারিশই কবুল করা হবে; কোনো গর্ব নয়। -সুনানে দারেমী, খ. ১, পৃ. ২৪৩ (ফাতহুল মান্নান) হাদীস ৫১

২. কিয়ামত দিবসে হামদের ঝাণ্ডা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে থাকবে

নির্ভরযোগ্য সনদে একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে আহমাদে মজবুত সনদে আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

إِنِّي لَأَوَّلُ النَّاسِ تَنْشَقُّ الْأَرْضُ عَنْ جُمْجُمَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا فَخْرَ، وَأُعْطَى لِوَاءَ الْحَمْدِ، وَلَا فَخْرَ، وَأَنَا سَيِّدُ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا فَخْرَ، وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا فَخْرَ.

কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম আমার কবর খুলবে, কোনো গর্ব নয়। আমাকে হামদের ঝা-া প্রদান করা হবে, কোনো গর্ব নয়। কিয়ামতের দিন আমি সকল মানুষের সরদার হব, কোনো গর্ব নয় এবং সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী আমি হব, কোনো গর্ব নয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪৬৯; সুনানে দারেমী, খ. ১, পৃ. ২৫৪ (ফাতহুল মান্নান), হাদীস ৫৫

আরো দেখুন, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫৪৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪১৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪৩০৮; দালায়েলুন নুবুওয়াহ, আবু নুআঈম ইস্পাহানী, খ. ১, পৃ. ৬৪, হাদীস ২৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৪৭৫

মুসনাদুল বাযযারে মজবুত সনদে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত; নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

والذي نفسي بيده إن صاحبكم لصاحب لواء الحمد يوم القيامة، تحته آدم فمن دونه. (قال الهيثمي : إسناده جيد)১

যেই সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম! তোমাদের নবী কিয়ামতের দিন হামদের ঝাণ্ডা বহনকারী হবেন। যার নীচে আদম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর পরবর্তী সকলেই থাকবেন। -মুসনাদুল বাযযার, হাদীস ৮১৩৩; শরহু ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাহ, হিবাতুল্লাহ লালিকায়ী, খ. ৪, পৃ. ৭৮৩; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খ. ১৭, পৃ. ২১৭, হাদীস ১৪০২২

৩. জান্নাতের দরজা সর্বপ্রথম তাঁর জন্য খোলা হবে

সহীহ মুসলিমে আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

آتِي بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتفْتِحُ، فَيَقُولُ الْخَازِنُ: مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُولُ: مُحَمَّدٌ، فَيَقُولُ: بِكَ أُمِرْتُ لَا أَفْتَحُ لِأَحَدٍ قَبْلَكَ.

কিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়াব এবং দরজা খুলতে বলব। জান্নাতের প্রহরী জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কে? বলব, মুহাম্মাদ। বলবেন, হাঁ, আপনার বিষয়েই আমাকে হুকুম করা হয়েছে; আপনার আগে কারও জন্য যেন (জান্নাতের দরজা) না খুলি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭

৪. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সায়্যিদুন নাস এবং সায়্যিদু উল্দি আদাম

শাফাআতের দীর্ঘ হাদীসটি মুতাওয়াতির। এর সারকথা এটাই যে, আল্লাহ তাআলা যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সকল বনী আদমের সরদার বানিয়েছেন, তার প্রকাশ সেখানে ঘটাবেন। মানুষেরা হাশরের ময়দানের ভয়াবহতায় পেরেশান হয়ে আদম আলাইহিস সালাম থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদার অধিকারী নবীগণের নিকট সুপারিশের জন্য যাবে। কিন্তু সবশেষে তাদেরকে খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসতে হবে। শাফাআতের হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী সহীহ সনদে প্রমাণিত, তিনি বলেন-

أَنَا سَيِّدُ النَّاسِ يَوْمَ القِيَامَةِ.

কিয়ামত দিবসে আমি সকল মানুষের সরদার হব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭১২

আর সহীহ সনদে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

أَنَا سَيِّدُ وُلْدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ، وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ.

কিয়ামতের দিন আমি সকল বনী আদমের সরদার হব। সর্বপ্রথম আমার কবর খুলবে। আমি সর্বপ্রথম সুপারিশকারী হব এবং সর্বপ্রথম আমার সুপারিশ কবুল করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৭৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৭৩

সকল নবী-রাসূল আদম আলাইহিস সালামেরই সন্তান। অতএব তিনি যখন সকল আদম সন্তান এবং সমস্ত মানুষের সরদার তাহলে তিনি সকল নবী-রাসূলেরও সরদার। ইমামুল আম্বিয়া এবং সায়্যিদুল মুরসালীন। সেজন্য সাহাবায়ে কেরাম থেকে অদ্যাবধি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দুই বৈশিষ্ট্য উম্মতের মাঝে স্বীকৃত। আমাদের জানামতে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে বিদআতী গোমরাহ ফেরকার লোকেরাও কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেনি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রা. বলেন-

سَيِّدُ الْأَنْبِيَاءِ خَمْسَةٌ، وَمُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَيِّدُ الْخَمْسَةِ: نُوحٌ وَإِبْرَاهِيمُ وَمُوسَى وَعِيسَى وَمُحَمَّدٌ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلَامُهُ. (قال الحاكم : صحيح الإسناد وإن كان موقوفا على أبي هريرة)

নবীগণের সরদার পাঁচজন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পাঁচজনের মধ্যেও সরদার। নূহ আ., ইবরাহীম আ., মূসা আ., ঈসা আ. এবং মুহাম্মাদ সালাওয়াতুল্লাহি ওয়া সালামুহু আলাইহিম। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৪০০৭

মহান সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. দরূদ শরীফের শব্দ এভাবে শেখাতেন, যেটা তাঁর থেকে নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত আছে-

اللّٰهُمَّ اجْعَلْ صَلَوَاتِكَ وَرَحْمَتَكَ وَبَرَكَتَكَ عَلَى سَيِّدِ الْمُرْسَلِينَ وَإِمَامِ الْمُتَّقِينَ، وَخَاتَمِ النَّبِيِّينَ مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ إِمَامِ الْخَيْرِ، وَقَائِدِ الْخَيْرِ وَرَسُولِ الرَّحْمَةِ...

হে আল্লাহ! আপনি আপনার যাবতীয় রহমত, বরকত ও অনুগ্রহ বর্ষণ করুন সায়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুত্তাকীন মুহাম্মাদের উপর, যিনি আপনার বান্দা ও রাসূল। কল্যাণের ইমাম, কল্যাণের সরদার এবং রহমতের রাসূল...। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, খ. ২, পৃ. ২১৩, হাদীস ৩১০৯; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, খ. ৯, পৃ. ১১৫, হাদীস ৮৫৯৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৪৫৩

যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বৈশিষ্ট্যটি শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত এবং তা ঈমানের সঙ্গে সম্পর্কিত সেজন্য এ বিষয়টি মুসলমানদের আকীদার কিতাবগুলোতেও বিবৃত হয়েছে। ইসলামী আকীদার নির্ভরযোগ্য ও সর্বজনস্বীকৃত কিতাব আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ। তাতে হানাফী ইমাম তহাবী রাহ. ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর সূত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদাসমূহ আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত আকীদায় এই বক্তব্য উল্লেখ আছে-

وأنه خاتم الأنبياء وإمام الأتقياء وسيد المرسلين وحبيب رب العالمين.

তিনি সর্বশেষ নবী, মুত্তাকীদের ইমাম, রাসূলগণের সরদার এবং রাব্বুল আলামীনের বন্ধু।

ইমাম বায়হাকী রাহ. শুআবুল ঈমান গ্রন্থে (২/১৭৮) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশিষ্ট্যের আলোচনায় লেখেন-

ومنها أنه صلى الله عليه وسلم كان سيد المرسلين.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি বৈশিষ্ট্য হল, তিনি সায়্যিদুল মুরসালীন-নবীগণের সরদার।

ইমাম আহমাদ রাহ.-এর বর্ণনা অনুযায়ী আকীদা সংকলন করেছেন ফকীহ আবুল ফযল তামীমী, তাতে রয়েছে-

إن بعض النبيين أفضل من بعض، ومحمد صلى الله عليه وسلم أفضلهم.

কতক নবী কতক নবীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন তাঁদের মাঝে শ্রেষ্ঠ। -তবাকাতুল হানাবিলা, কাযী ইবনে আবী ইয়ালা, খ. ২, পৃ. ২৬৩

বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকীহ আবদুল গনী মাকদিসী ইসলামী আক্বীদার কিতাব ‘আলইকতিসাদ ফিল ই‘তিকাদ’-এ লেখেন-

ونعتقد أن محمداً المصطفى خير الخلائق، وأفضلهم، وأكرمهم على الله عز وجل وأعلاهم درجة، وأقربهم إلى الله وسيلة.

আমরা মুসলমানেরা বিশ্বাস করি, মুহাম্মাদ মুস্তফা হলেন সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তিনি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত ও সবচাইতে বেশি মর্যাদাবান এবং আল্লাহ তাআলার সর্বাধিক নিকটবর্তী। -আলইকতিসাদ, পৃ. ১৯৬

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক সুন্নতের অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। তাঁর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ হেদায়েত-গ্রন্থ কুরআন কারীমে তাদাব্বুর করার, এর হেদায়েতসমূহ মনেপ্রাণে গ্রহণ করার এবং তার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

পুনশ্চ : যেমনটা আমি উল্লেখ করেছি- সম্ভবত এখন পর্যন্ত কোনো বেদআতী গোমরাহ ফেরকার কোনো ব্যক্তিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইমামুল আম্বিয়া ও সায়্যিদুল মুরসালীন হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনি। কিন্তু একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা-

একজন নিজে নিজে গবেষক সেজে এ বিষয়ে বড়সড় একটা বই লিখে ফেলেছেন। বইটির কম্পোজ করা কপির পিডিএফ তিনি আমাকেও পাঠিয়েছেন। বইটি মিথ্যাচার এবং বিভিন্ন কুফরী কথা ও মতবাদে ভরা। কুফর চিহ্নিত করার প্রয়োজনে কখনো বাধ্য হয়ে কুফরী কথা উদ্ধৃত করতে হয়। তাই তার বইয়ের কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করা হচ্ছে; আল্লাহ সাক্ষী, আমি এসব কথা থেকে মুক্ত এবং সম্পর্কহীন।

তার দাবি: “শেষ নবীকে নিয়ে ‘আশরাফুল আম্বিয়া’ বা ‘ইমামুল আম্বিয়া’ বা ‘সাইয়্যিদুল মুরসালীন’ সংক্রান্ত ধারণা সবচেয়ে বড় মাপের ডাহা মিথ্যাচার- ইসলামের নামে এ যাবৎকালে যত যত মিথ্যা উদ্ভাবন করা হয়েছে তার মধ্যে এটি হচ্ছে সকল মিথ্যার জননী। এটি খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদের চাইতেও ভয়াবহ এক বিষবৃক্ষ যার ফল ভক্ষণ মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের মুনাফিক এবং মুশরিকে পরিণত করছে। প্রতিনিয়ত মিথ্যা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহ ‘নকল মুসলমানে’ পরিণত হয়েছে। ‘আশরাফুল আম্বিয়া’ তত্ত্বের মিথ্যার উপর ভিত্তি করেই দীন ইসলামে হাজারো মিথ্যা রচনা এবং তার উপর ভিত্তি করে বহুমুখী ধর্ম-ব্যবসার ক্ষেত্রকে অবারিত, সুপ্রশস্ত করা হয়েছে যুগে যুগে।”

তার আরো দাবি: “আর এভাবেই তারা তাদের অজান্তে মুসলিম নাম নিয়েই পাক্কা মুনাফিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সে ‘বেহেশতে’ যাবার দিবাস্বপ্ন দেখছে, অথচ কুরআন অনুযায়ী তার অবস্থান জাহান্নামে কাফেরের চেয়েও নিকৃষ্ট স্থানে।”

আর এসবের পেছনে রয়েছে তার ভাষায়- ‘সিংহভাগ ধর্মীয়  গোষ্ঠী’, ‘ইমাম-আলেম-ওলামা’!

নাউযু বিল্লাহ! ছুম্মা নাউযু বিল্লাহ!!

পুরো বই গালিগালাজ ও মিথ্যাচারে ভরা। আসলে এই বেচারা হল- যেটা তার বই থেকে একদম স্পষ্ট- ‘মুনকিরে হাদীস’ তথা আল্লাহর রাসূলের হাদীস অস্বীকারকারী। হাদীসকে সে দ্বীন ও শরীয়তের দলীল হিসাবে মানে না। বরং হাদীসের উপহাস করে! এটা জানার পর এখন আর এই কথা ভেবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, ঈমানের দাবিদার কোনো লোক কীভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এইসকল বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করতে পারে? আসলে যার অন্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান রয়েছে এবং তাঁর প্রতি ঈমান ও মহব্বত রয়েছে, সে ‘মুনকিরে হাদীস’ কীভাবে হয়? কারণ কেউ মুনকিরে হাদীস হওয়ার অর্থ এটাই যে, সে রাসূল  অবমাননার অপরাধে অপরাধী। তাই এ ধরনের লোকদের থেকে এমন আচরণ অসম্ভব নয়। আফসোস, এরা এ-ও বোঝে না যে, হাদীস অস্বীকার করার পর কুরআনের প্রতি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমানের দাবি করার কোনো অর্থ থাকে না। মনে রাখতে হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হাদীসে যা আছে তা ওহীর এক প্রকার। তা কখনো কুরআন পরিপন্থী হওয়া সম্ভব নয়। এর কোনো কিছুকে অস্বীকার করা আল্লাহর ওহীকে অস্বীকার করা।

উল্লিখিত বইটি হাদীস অস্বীকারসহ অনেক ভয়াবহ গোমরাহী ও কুফরিতে ভরা। তিনি নিজে মিথ্যার পর মিথ্যা বলে যান; অপরদিকে আলেমদের প্রতি তার না-হক অভিযোগ যে, তারা মিথ্যা বলেন। আমি তার জন্য হেদায়েতের দুআ করি, যদিও তিনি আমার নামেও মিথ্যাচার করেছেন।

দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে বিভিন্ন শিরোনামে হাদীস অস্বীকারের ফেতনা বিস্তার লাভ করছে। আল্লাহ তাআলা সব ধরনের ফেতনা থেকে উম্মতকে হেফাযত করুন- আমীন।

ইলম, তাকওয়া, আমানতদারি ও দ্বীনদারি ছাড়া নিজে নিজে গবেষক হওয়ার সবচেয়ে ছোট ক্ষতি এই যে, মানুষ অজ্ঞাতসারে গোমরাহ হয়ে যায়। তবে নিজেকে সবচেয়ে বড় হেদায়েতপ্রাপ্ত ও জ্ঞানী ভাবে এবং অন্য সবাইকে গোমরাহ ও মূর্খ মনে করতে থাকে। আসলে ‘জাহালাতে মুরাক্কাবা’-এর শিকার যারা, তাদের জন্য হেদায়েতের দুআ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কবি সত্যই বলেছেন-

آں کس کہ نداند ونداند کہ نداند

در جہل مرکب ابد الدہر بماند

آں کس کہ نداند ونخواہد کہ بداند

حیف است چنیں جانوری زندہ بماند

(কবিতার মর্ম) যে জানে না এবং সে যে জানে না তাও সে জানে না। আজীবন সে ‘জাহলে মুরাক্কাবে’ (ডবল মূর্খতায়) থেকে যাবে।

যে জানে না এবং জানতেও চায় না তার যিন্দা থেকে লাভ কী?

গোমরাহীর শিকার কেউ যখন নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে অথবা কমপক্ষে এটুকু অনুভব করে যে, সম্ভবত আমি ভুলের মধ্যে আছি, তাহলেই তো সে কোনো আলেমে দ্বীন থেকে ইলম হাসিলের চেষ্টা করবে এবং তার ওই সংশয়গুলোর সমাধান খুঁজবে, যেগুলোকে বাহানা বানিয়ে শয়তান তাকে গোমরাহ করে দিয়েছে। কিন্তু আলেমদেরই যদি সে মুনাফিক ভেবে বসে থাকে! আল্লাহ তুমি রক্ষা কর!

هذا، وصلى الله تعالى وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين، وسيد المرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين. হ

 

-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

১৫-০২-১৪৪৩ হি.

  1ـ قال الراقم : وهذا يؤيد رواية علي بن زيد بن جدعان عن أبي نضرة، عن أبي سعيد، وعن ابن عباس عند الترمذي : "وما من نبي يومئذ، آدم فمن سواه إلا تحت لوائي"، كما يؤيدها رواية سعيد عن قتادة عن أنس، عند أبي نعيم في "الدلائل" : لواء الحمد معي، وتحته آدم ومن دونه ومن بعده من المؤمنين". (والإسناد إلى سعيد لا بأس به)

মন্তব্য করুন: