শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

‘ভাষার মাস’ : ভাষার মাসের নিবেদন

 প্রকাশিত: ১৭:১১, ২ মার্চ ২০২১

‘ভাষার মাস’ : ভাষার মাসের নিবেদন

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। এর গুরুত্বের সাধারণ দিকগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি সচেতন। ভাষার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। আবেগ-অনুভূতি আদান-প্রদান করি। ইচ্ছা, প্রয়োজন, সংকল্প, সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করি।

ভাষার মাধ্যমে চারপাশের মানুষজনের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরিবারে-পরিবারে সমাজে-সমাজে মেলবন্ধন রচিত হয়। স্থাপিত হয় এক প্রজন্মের সাথে অপর প্রজন্মের পরিচয় ও যোগসূত্র। চেতনা-বিশ্বাস, চিন্তা-ভাবনা, আদর্শ-মতাদর্শ ভাষাকে বাহন করে প্রবাহিত হয় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, সমাজ থেকে সমাজে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ভাষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জীবন ও জগতের এই অপরিহার্য অনুষঙ্গ, সভ্যতা-সংস্কৃতির এই অপরিহার্য উপাদান কীভাবে মানুষ লাভ করল। এ প্রশ্নের সহজ, স্বাভাবিক, স্পষ্ট ও যথার্থ জবাব আমরা পাই আলকুরআনুল কারীমে। মানুষ ও মানুষের ভাষার যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি জানিয়েছেন কীভাবে মানুষ অধিকারী হল এই অমূল্য সম্পদের। ইরশাদ হয়েছে-

اَلرَّحْمٰنُ  ، عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ  ،خَلَقَ الْاِنْسَانَ ، عَلَّمَهُ الْبَیَانَ.

পরম করুণাময়। শিখিয়েছেন কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। শিখিয়েছেন তাকে মনের ভাব প্রকাশ করতে। -সূরা আররহমান (৫৫) : ১-৩

মানুষের ব্যক্তিসত্তা ও চারপাশের সৃষ্টিজগতে ছড়িয়ে আছে আল্লাহ তাআলার কুদরত ও রহমত, শক্তি ও করুণার অজস্র দৃষ্টান্ত। মানুষ যদি তা গণনা করতে চায় গণনা করে শেষ করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলার এই মহা নিআমত ও নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে মানুষের নিজের মুখের ভাষা। প্রাত্যহিকতার কারণে তা হয়তো আমাদের কাছে অতি স্বাভাবিক, অতি সহজলভ্য কিন্তু চিন্তা করলে বোঝা যাবে, কী অদ্ভুত ভাষার এই ব্যাপারটি। পৃথিবীর আলো-বাতাসে চোখ-খোলা যে শিশুটির মুখে কোনো ভাষা ছিল না, ধীরে ধীরে কীভাবে তার মুখে ভাষার উন্মেষ ঘটল! অর্থহীন ধ্বনিগুলো কীভাবে অর্থপূর্ণ শব্দ-বাক্যের কাঠামো ধারণ করতে থাকল! একপর্যায়ে সে সাবলীল হয়ে উঠল! কথাবার্তা, তর্ক-বিতর্ক, বক্তৃতা-বিবৃতি সবক্ষেত্রে তার কী সরব বিচরণ!

মানুষের মাঝে এভাবে এই যোগ্যতার বিকাশ কে ঘটান? আল্লাহ তাআলা ।

তাই ভাষার ব্যাপারে আমাদের প্রথম কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া, তাঁর শোকর আদায় করা এবং তাঁর এই মহা নিআমতের প্রতি দায়িত্ব পালন করা।

ভাষার প্রতি আমাদের মৌলিক দায়িত্বগুলো কী?

আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান ও শোকর আদায়ের পর ভাষার ব্যাপারে আমাদের উপর যেসকল দায়িত্ব বর্তায় একশব্দে বললে তা হচ্ছে, ভাষার ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার। ব্যক্তিগত ও প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তরাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভাষার অন্যায়-অসঙ্গত ব্যবহার থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, রচনা-সম্পাদনা, সাহিত্য-সাংবাদিকতা, এককথায় জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার সকল বিভাগে ভাষার অন্যায়-অবৈধ ব্যবহার চিহ্নিত ও বর্জিত হতে হবে।

আল্লাহ তাআলার এই দান, তাঁর সৃষ্টিগুণের এই মহা নিদর্শনকে ব্যবহার করতে হবে তাঁর সন্তুষ্টির গণ্ডির ভিতরে। তিনিই মানুষের কল্যাণার্থে তার মাঝে বিভিন্ন যোগ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন। যেন এর মাধ্যমে মানুষ তার পার্থিব প্রয়োজনসমূহ পূরণ করে। পরকালীন কল্যাণ অর্জন করে। কাজেই জীবনযাত্রার স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে যেমন মানুষকে শরীয়তের বিধিনিষেধের প্রতি যত্নবান থাকতে হবে তেমনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করতে হবে শরীয়তের নীতি ও নির্দেশনা। ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে ইসলামের সুমহান আদর্শের বিস্তারের উপায়রূপে। ব্যক্তি ও সমাজের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের বাহনরূপে ।

আমাদের ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষাকে গড়ে তুলতে হবে দ্বীনের ভাষারূপে। দেশের ভিতরে-বাহিরে বাংলাভাষী যত মানুষ রয়েছেন, তাদের সবাই যেন মাতৃভাষায় দ্বীন-ঈমানের পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ কর্মপন্থা প্রণয়ন করতে হবে। শিরক, পৌত্তলিকতা ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার উপসর্গ থেকে এই ভাষাকে, ভাষার শব্দ-বাক্যকে পবিত্র করার প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে। ধর্মদ্রোহী, ইসলামবিদ্বেষী চক্রের অপসাহিত্যের যে আবর্জনা এই ভাষার শ্লীলতাহানি করে চলেছে তার খণ্ডন ও অপসারণের মাধ্যমে ভাষার ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করতে হবে এবং মুসলিমসমাজের ঈমান-আকীদা আখলাক-চরিত্রের সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই লক্ষ্যপূরণ এত বিস্তৃত ও ধারাবাহিক কাজের দাবি রাখে, যা কোনো এক ব্যক্তি, এক গোষ্ঠী কিংবা কোনো এক প্রজন্মের দ্বারা শেষ হয়ে যাওয়ার নয়। এর জন্য বাংলাভাষী সকল মানুষকে স্ব স্ব জায়গা থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রত্যেক প্রজন্মকে সজাগ সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে উম্মাহ্র এই মহাদায়িত্ব সম্পর্কে। মনে রাখতে হবে সেই ঐতিহাসিক উক্তি-

أنتم في رباط دائم.

তোমরা রয়েছো এক নিরবচ্ছিন্ন সীমান্ত প্রহরায়।

ভাষা ও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার সীমানাকে সকল প্রকারের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে হলে মুসলিম উম্মাহ্র প্রত্যেক প্রজন্মকে অবতীর্ণ হতে হবে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায়।

আল্লাহ তাআলার এই মহান নিআমতের শোকর আদায়, দ্বীনী দাওয়াতের দায়িত্ব পালন এবং দেশ-জাতির প্রতি কল্যাণকামিতার দাবি পূরণের জন্য আমরা যেন প্রস্তুত হই। সামর্থ্য অনুসারে আমরা যেন সচেষ্ট হই অন্তত কিছু মন্দের অপসারণ এবং কিছু ভালোর উদ্বোধনে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: