শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

আফ্রিকায় ইসলামী জ্ঞানের মিনার

প্রাচীন টিমবাকটু শহর

 প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০

আফ্রিকায় ইসলামী জ্ঞানের মিনার

টিমবাকটু মালির একটি প্রাচীন শহর, নাইজার নদী থেকে ২০ কিমি উত্তরে অবস্থিত। দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে টিমবাকটু একটি মৈত্রী বসতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্থায়ী বাসস্থান হয়ে ওঠে। ১৪ শতকের প্রথম দিকে মালি সাম্রাজ্যের অংশ হয়। ১৫ শতকের প্রথমার্ধে, তুয়ারেগ উপজাতিরা অল্প সময়ের জন্য শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর সেনাবাহিনী সাঁহেইকে পরাজিত করে এবং গোগের পরিবর্তে এই শহরকে তাদের রাজধানী করে। এই শহর মালি সাম্রাজ্যের প্রধান শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। ১৮৯৩ সালে ফ্রান্সের শাসনভার গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন উপজাতি এই শহর শাসন করে।

বর্তমান সময়ে টিমবাকটু শহর দারিদ্র্য থেকে মুক্ত। সুবর্ণ যুগে এই শহরে বহু ইসলামী পণ্ডিত বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। টিমবাকটু আফ্রিকার সুপ্রাচীন মহান ঐতিহ্য। এটি আফ্রিকার শিক্ষার প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে।

ইউরোপীয়দের কাছে টিমবাকটু ‘এল ডোরাডো’র মতো গল্পকথা। যেহেতু আফ্রিকা মহাদেশ ও সাহারা মরুভূমি ইউরোপীয় ও মার্কিন সভ্যতার কাছে এখনো অনেকটাই রহস্যময়, তাই অনেক পণ্ডিত বিশ্বাস করতে চান না যে টিমবাকটুতে এককালে বিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়েছিল। এই শহরের শিক্ষিত ও পণ্ডিতরা আত্মিক, মানসিক ও জ্ঞানচর্চার উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন মানুষকে। নাইজার নদী থেকে ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আরবীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত ছিল টিমবাকটুর বাণিজ্য পথ। উট ও সোনার বিনিময়ে বস্ত্র, লবণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য খরিদ করত স্থানীয় মানুষ।

কিন্তু টিমবাকটুর উত্থান ও উন্নতি কিভাবে হয়েছিল? সাহারার তপ্ত বালুরাশির মধ্যে কিভাবে গড়ে উঠেছিল মণি-মুক্তাখচিত এই শহর? আসলে টিমবাকটু স্থাপন করেছিল সাহারার বিখ্যাত তুয়ারেগ উপজাতি। একাদশ শতকে বুকটু নামক এক তুয়ারেগ রমণী নাইজার নদীর প্লাবনভূমিতে এক জনপদ গড়ে তোলেন। সাহারার কঠিন পরিবেশ ও জলশূন্য পরিবেশে বুকটুর এই জনপদেই ছিল মিষ্টি জলের কুয়ো ও জলাশয়। এই জনপদেই তুয়ারেগরা গবাদি পশু চরাত, জল সংগ্রহ করত, সাহারার অন্য অঞ্চলে বাণিজ্য করতে যাওয়ার সময় বুকটু তাদের জিনিসপত্রের হেফাজত করত। এই ছোট্ট জনপদ তুয়ারেগদের কাছে পরিচিত ছিল ‘টিন-বুকটু’ নামে, যার অর্থ বুকটুর কুয়ো। এই টিন বুকটুই কালক্রমে টিমবাকটু নামক রাজসিক শহরে পরিণত হয়।

শুরু থেকেই এই শহরের অবস্থান সুবিধাজনক। সাহারার দক্ষিণাংশ দিয়ে প্রবাহিত উত্তরবাহিনী নাইজার নদী, তুয়ারেগ, আরব, ওয়াংরা, সোনঘাই, সোনিনকে প্রভৃতি উপজাতির মিলনস্থল ইত্যাদি কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই শহর। মালির বৌরে ও বামবুক খনি থেকে আহরিত সোনার মাধ্যমেই ব্যবসা-বাণিজ্য হতো। এই শহরে প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে মার্কা, ওয়াংগারা, সারাকোল ও মান্দিনকার ব্যবসায়ীরা। তাদের ও তুয়ারেগদের মধ্যে সুন্দর আদান-প্রদানের সম্পর্ক শুরু হয়। মাটির বাড়ি ও মসজিদ স্থাপনের পর আফ্রিকার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে মুসলিম পণ্ডিতদের পা পড়ে এই শহরে।

এই শহরকে ইসলামী জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান বানানোর ক্ষেত্রে মানসা মুসা নামের এক ব্যক্তির বিশেষ অবদান ছিল।

১৩২৫ সালে মালি ও সংলগ্ন অঞ্চলের শাসক মানসা মুসা নিজের মক্কা যাত্রা থেকে ফিরছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল প্রায় ৬০ হাজার অনুগামী, আট হাজার সৈনিক, ১৫ হাজার উট এবং প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার কেজি সোনা। কথিত আছে, মুসার কাছে এত সোনা ছিল যে ফেরার পথে যে যে শহরে তিনি অবস্থান করছিলেন সেই সেই শহরের ভাগ্য ফিরে যাচ্ছিল।

টিমবাকটুতে এসে তিনি তাঁর প্রধান স্থপতি আন্দালুসিয়ান আবু ইশক আস সাহেলিকে আদেশ দেন পশ্চিম আফ্রিকার সর্ববৃহৎ উপাসনাগৃহ তৈরি করতে। মুসার আদেশে গড়ে ওঠে জিঙারি বার বা আল মসজিদ আল কবির, যা এখনো টিমবাকটুর ঐতিহ্যময় ইতিহাসের সাক্ষী।

মানসা মুসার হাত ধরেই টিমবাকটুর নাম সারা বিশ্বে অল্প অল্প করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দামি, বিখ্যাত ও সচরাচর পাওয়া যায় না—এমন ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতির বই ছাপা হতে শুরু করে এই শহরে। ইবনে বতুতা, হাসান আল ওয়াজান প্রমুখ বিখ্যাত ভ্রামণিকরা এই শহরের উন্নত সংস্কৃতির দর্শন করতে আসেন। হাসান আল ওয়াজান নিজের ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলেন, ‘টিমবাকটুই একমাত্র শহর, যে শহরে বইয়ের মূল্য অন্যান্য দ্রব্যের থেকে বেশি।’

আফ্রিকার মুসলমানদের মক্কা যাওয়ার পথে বিশ্রাম নেওয়ার স্থান ছিল এই শহর, ফলে নানা কিসিমের লোক, অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এই শহরকে সমৃদ্ধ করেছেন।

এই শহরে প্রায় ১৫০টি মাদরাসা, সাংকোরে মসজিদে গড়ে ওঠা একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শিক্ষার ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করত এই শহর। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৫ হাজার ছাত্র ছিল। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, উসুল, আকিদা, বালাগাহ, মানতিক পড়ানো হতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম কিছু বছর সব কিছুই একটু একটু করে শিখিয়ে এরপর ছাত্রের পছন্দ ও দক্ষতা অনুসারে এক একজন আলেমের কাছে তাদের বিশেষ কোনো বিষয়ে শিক্ষালাভ শুরু হতো।

শিক্ষক ও ছাত্র এক পরিবার হয়ে যেত এর মাধ্যমে। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই টিমবাকটুর বহু পণ্ডিত উপকৃত হয়েছেন।

টিমবাকটুর মানুষ এর সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশের অন্য মানুষের উন্নতিসাধনেও কাজ করত। ১৭ শতক ও ১৮ শতকের ইসলামের ইতিহাসগুলোতে টিমবাকটুর ঐতিহ্যের কথা পাওয়া যায়।

যেসব ইউরোপীয় স্কলার মনে করেন আফ্রিকার ইতিহাস সে রকম গরিমাময় নয়, টিমবাকটু তাঁদের কাছে এক জ্বলন্ত প্রমাণ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সব কিছুর উন্নতির শিখরে ছিল টিমবাকটু।

কালো আফ্রিকায় ইসলামী জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়েছে টিমবাকটুর পথ ধরে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: