শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

ইতিহাসের পাতায় হুদাইবিয়ার সন্ধি

 প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ১২ আগস্ট ২০২১

ইতিহাসের পাতায় হুদাইবিয়ার সন্ধি

মিস্ওয়ার ইবনু মাখরামাহ (রাঃ) ও মারওয়ান (রহ.) হতে বর্ণিত। তাদের উভয়ের একজনের বর্ণনা অপরজনের বর্ণনার সমর্থন করে তাঁরা বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুদাইবিয়ার সময় বের হলেন। যখন সহাবীগণ রাস্তার এক জায়গায় এসে পৌঁছলেন, তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘খালিদ ইবনু ওয়ালিদ কুরাইশদের অশ্বারোহী অগ্রবর্তী বাহিনী নিয়ে গোমায়ম নামক স্থানে অবস্থান করছে। তোমরা ডান দিকের রাস্তা ধর।’ আল্লাহর কসম! খালিদ মুসলিমদের উপস্থিতি টেরও পেলো না, এমনকি যখন তারা মুসলিম সেনাবাহিনীর পশ্চাতে ধূলিরাশি দেখতে পেল, তখন সে কুরাইশদের সাবধান করার জন্য ঘোড়া দৌঁড়িয়ে চলে গেল।

এদিকে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অগ্রসর হয়ে যখন সেই গিরিপথে উপস্থিত হলেন, যেখান থেকে মক্কার সোজা পথ চলে গিয়েছে, তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উটনী বসে পড়ল। লোকজন (তাকে উঠাবার জন্য) ‘হাল-হাল’ বলল, কাস্ওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, কাসওয়া ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘কাসওয়া ক্লান্ত হয়নি এবং তা তার স্বভাবও নয় বরং তাকে তিনিই আটকিয়েছেন যিনি হস্তি বাহিনীকে আটকিয়ে ছিলেন।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! কুরাইশরা আল্লাহর সম্মানিত বিষয় সমূহের মধ্যে যে কোন বিষয়ের সম্মান দেখানোর জন্য কিছু চাইলে আমি তা পূরণ করব।’ অতঃপর তিনি তাঁর উষ্ট্রীকে ধমক দিলে সে উঠে দাঁড়াল।

রাবী বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের পথ ত্যাগ করে হুদায়বিয়ার শেষ সীমায় অল্প পানি বিশিষ্ট কুপের নিকট অবতরণ করেন। লোকজন সেখান থেকে অল্প অল্প করে পানি নিচ্ছিল। এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন পানি শেষ করে ফেলল এবং আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট পিপাসার অভিযোগ পেশ করা হলো। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কোষ থেকে একটি তীর বের করলেন এবং সে তীরটি সেই কূপে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। আল্লাহর কসম, তখন পানি উথলে উঠতে লাগল, এমনকি সকলেই তৃপ্তি সহকারে তা থেকে পানি পান করলেন।

এমন সময় বুদায়ল ইবনু ওয়ারকা খুযাঈ তার খুযাআ গোত্রের কতিপয় ব্যক্তিদের নিয়ে আসল। তারা তিহামাবাসীদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষী ছিল। বুদাইল বলল, আমি কা‘ব ইবনু লুওয়াই ও আমির ইবনু লুওয়াইকে রেখে এসেছি। তারা হুদাইবিয়ার প্রচুর পানির নিকট অবস্থান করছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে বাচ্চাসহ দুগ্ধবতী অনেক উষ্ট্রী। তারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতে বাধা দেয়ার জন্য প্রস্তুত।

আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আমি তো কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি; বরং ‘উমরাহ করতে এসেছি। যুদ্ধ অবশ্যই কুরাইশদের দুর্বল করে দিয়েছে, কাজেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা চাইলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে পারি আর তারা আমার ও কাফিরদের মধ্যকার বাধা তুলে নিবে। যদি আমি তাদের উপর বিজয় লাভ করি তাহলে অন্যান্য ব্যক্তি ইসলামে যেভাবে প্রবেশ করেছে, তারাও ইচ্ছে করলে তা করতে পারবে। আর না হয়, তারা এ সময়ে শান্তিতে থাকবে। কিন্তু তারা যদি আমার প্রস্তাব অস্বীকার করে, তাহলে সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার গর্দান আলাদা না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। আর অবশ্যই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ বুদায়ল বলল, ‘আমি আপনার কথা তাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিব।

অতঃপর বুদায়ল কুরাইশদের নিকট এসে বলল, আমি সেই ব্যক্তিটির কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁর নিকট কিছু কথা শুনে এসেছি। তোমরা যদি চাও, তাহলে তোমাদের তা শোনাতে পারি।’ তাদের মধ্যে নির্বোধ লোকেরা বলল, ‘তাঁর পক্ষ থেকে আমাদের নিকট তোমার কিছু বলার দরকার নাই।’ কিন্তু তাদের জ্ঞানসম্পন্ন লোকেরা বলল, ‘তুমি তাঁকে যা বলতে শুনেছ, তা বল।’ তারপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা যা বলেছিলেন, বুদায়ল সব তাদের শুনাল।

অতঃপর ‘উরওয়াহ ইবনু মাস‘ঊদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে লোকেরা! আমি কি তোমাদের পিতৃতুল্য নই?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’ ‘উরওয়াহ বলল, ‘তোমরা কি আমার সন্তান তুল্য নও?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ অবশ্যই।’ ‘উরওয়াহ বলল, ‘আমার ব্যাপারে তোমাদের কি কোন অভিযোগ আছে?’ তারা বলল, না। ‘উরওয়াহ বলল, তোমরা কি জান না যে, আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য উকাযবাসীদের নিকট আবেদন করেছিলাম এবং তারা আমাদের ডাকে সাড়া দিতে অস্বীকার করলে আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্ততি ও আমার অনুগত লোকদের নিয়ে তোমাদের নিকট এসেছিলাম? তারা বলল, হ্যাঁ, জানি। ‘উরওয়াহ বলল, এই ব্যক্তিটি তোমাদের নিকট একটি ভাল প্রস্তাব পেশ করেছেন। তোমরা তা গ্রহণ কর এবং আমাকে তার নিকট যেতে দাও। তারা বলল, আপনি তাঁর নিকট যান।

অতঃপর ‘উরওয়াহ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এল এবং তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করল। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার সঙ্গে কথা বললেন, যেমনিভাবে বুদায়লের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ‘উরওয়াহ তখন বলল, হে মুহাম্মদ, আপনি কি চান যে, আপনার কওমকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন, আপনি কি আপনার পূর্বে আরববাসীদের এমন কারো কথা শুনেছেন যে, সে নিজ কওমের মূলোৎপাটন করতে উদ্যত হয়েছিল? আর যদি অন্য রকম হয়, (তখন আপনার কি অবস্থা হবে?) আল্লাহর কসম! আমি কিছু চেহারা দেখছি এবং বিভিন্ন ধরনের লোক দেখতে পাচ্ছি যাঁরা পালিয়ে যাবে এবং আপনাকে পরিত্যাগ করবে। তখন আবূ বাকর (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি লাত দেবীর লজ্জাস্থান চেটে খাও। আমরা কি তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যাব। ‘উরওয়াহ বলল, সে কে? লোকজন বললেন, আবূ বাকর। ‘উরওয়াহ বলল, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি তাঁর কসম করে বলছি, আমার উপর যদি আপনার ইহসান না থাকত, যার প্রতিদান আমি দিতে পারিনি, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার কথার জবাব দিতাম।

রাবী বলেন, ‘উরওয়াহ পুনরায় নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দাড়িতে হাত দিত। তখন মুগীরাহ ইবনু শুবা (রাঃ) আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিয়রে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে ছিল একটি তরবারী ও মাথায় ছিল লৌহ শিরস্ত্রাণ। ‘উরওয়াহ যখনই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দাড়ির দিকে তার হাত বাড়াতো মুগীরাহ (রাঃ) তাঁর তরবারীর হাতল দিয়ে তার হাতে আঘাত করতেন এবং বলতেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দাড়ি থেকে তোমার হাত হটাও। ‘উরওয়াহ মাথা তুলে বলল, এ কে? লোকজন বললেন, মুগীরাহ ইবনু শুবাহ। ‘উরওয়াহ বলল, হে গাদ্দার! আমি কি তোমার গাদ্দারীর পরিণতি থেকে তোমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করিনি? মুগীরাহ (রাঃ) জাহেলী যুগে কিছু লোকদের সঙ্গে ছিলেন। একদা তাদের হত্যা করে তাদের সহায় সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি তোমার ইসলাম মেনে নিলাম, কিন্তু যে মাল তুমি নিয়েছ, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অতঃপর ‘উরওয়াহ চোখের কোণ দিয়ে সহাবীদের দিকে তাকাতে লাগল। সে বলল, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনো থুথু ফেললে তা সহাবীদের হাতে পড়তো এবং তা তারা গায়ে মুখে মেখে ফেলতেন। তিনি তাঁদের কোন আদেশ দিলে তা তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পালন করতেন। তিনি ওযু করলে তাঁর ওযুর পানির জন্য তাঁর সহাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হত। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন তাঁরা নীরবে তা শুনতেন এবং তাঁর সম্মানার্থে সহাবীগণ তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেন না।

অতঃপর ‘উরওয়াহ তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে গেল এবং বলল, হে আমার কওম, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা-বাদশাহর নিকটে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার, কিসরা ও নাজাশী সম্রাটের নিকটে দূত হিসেবে গিয়েছি; কিন্তু আল্লাহর কসম করে বলতে পারি যে, কোন রাজা বাদশাহকেই তার অনুসারীদের মত এত সম্মান করতে দেখিনি, যেমন মুহাম্মাদের অনুসারীরা তাঁকে করে থাকে। আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যদি থুথু ফেলেন, তখন তা কোন সহাবীর হাতে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা তা সঙ্গে পালন করেন; তিনি ওযু করলে তাঁর ওযুর পানি নিয়ে সহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগতিা শুরু হয়; তিনি কথা বললে, সহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে শুনেন। এমনকি তাঁর সম্মার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না। তিনি তোমাদের নিকট একটি ভালো প্রস্তাব পাঠিয়েছেন, তোমরা তা মেনে নাও। তা শুনে কিনানা গোত্রের এক ব্যক্তি বলল, আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও। লোকেরা বলল, যাও।

সে যখন আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সহাবীগণের নিকট এল তখন আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ হলো অমুক ব্যক্তি এবং এমন গোত্রের লোক, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে থাকে। তোমরা তার নিকট কুরবানীর পশু নিয়ে আস। অতঃপর তার নিকট তা নিয়ে আসা হলো এবং লোকজন তালবিয়া পাঠ করতে করতে তার সামনে এলেন। তা দেখে ব্যক্তিটি বলল, সুবহানাল্লাহ্! এমন সব লোকদেরকে কা‘বা যিয়ারত থেকে বাধা দেয়া সঙ্গত নয়। অতঃপর সে তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে গিয়ে বলল, আমি কুরবানীর পশু দেখে এসেছি, সেগুলোকে কিলাদা পরানো হয়েছে ও চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই তাদের কা‘বা যিয়ারতে বাধা প্রদান সঙ্গত মনে করি না। তখন তাদের মধ্য থেকে মিকরায ইবনু হাফ্স নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে তাঁর নিকট যেতে দাও। তারা বলল, তাঁর নিকট যাও। অতঃপর সে যখন মুসলিমদের নিকটবর্তী হল, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ হল মিকরায আর সে দুষ্ট ব্যক্তি। সে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় সুহায়ল ইবনু আমর এল। মা‘মার বলেন, ‘ইকরিমাহ (রহ.) সূত্রে আইয়ুব (রহ.) আমাকে বলেছেন যে, যখন সুহায়ল এল তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সহজ হয়ে গেল।’

মা‘মার (রহ.) বলেন, যুহরী (রহ.) তাঁর বর্ণিত হাদীসে বলেছেন যে, সুহায়ল ইবনু আমর এসে বলল, আসুন আমাদের ও আপনাদের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র লিখি। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন লেখককে ডাকলেন। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, (লিখ) بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ  এতে সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! রাহমান কে-? আমরা তা জানি না, বরং পূর্বে আপনি যেমন লিখতেন, লিখুন بِاسْمِكَ اَللَّهُمَّ  মুসলিমগণ বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ ব্যতীত আর কিছু লিখব না। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, লিখ, بِاسْمِكَ اَللّٰهُمَّ

অতঃপর বললেন, এটা যার উপর চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। তখন সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! আমরা যদি আপনাকে আল্লাহর রাসূল বলেই বিশ্বাস করতাম, তাহলে আপনাকে কা‘বা যিয়ারত থেকে বাধা দিতাম না এবং আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হতাম না। বরং আপনি লিখুন, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ (এর তরফ থেকে)। তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর রাসূল; যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী মনে কর। (হে ফাতির!) লিখ, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ।’ যুহরী (রহ.) বলেন, এটি এজন্য যে, তিনি বলেছিলেন, তারা যদি আল্লাহর পবিত্র বস্তুগুলোর সম্মান করার কোন কথা দাবী করে তাহলে আমি তাদের সে দাবী মেনে নিব।

অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ চুক্তি কর যে, তারা আমাদের ও কা‘বা শরীফের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না, যাতে আমরা (নির্বিঘ্নে) তাওয়াফ করতে পারি। সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! আরববাসীরা যেন একথা বলার সুযোগ না পায় যে, এ প্রস্তাব গ্রহণে আমাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে। বরং আগামী বছর তা হতে পারে। অতঃপর লেখা হলো।

সুহায়ল বলল, এও লিখা হউক যে, আমাদের কোন ব্যক্তি যদি আপনার নিকট চলে আসে এবং সে যদিও আপনার দ্বীন গ্রহণ করে থাকে, তবুও তাকে আমাদের নিকট ফিরিয়ে দিবেন। মুসলিমগণ বললেন, সুবহানাল্লাহ্! যে ইসলাম গ্রহণ করে আমাদের নিকট এসেছে, তাকে কেমন করে মুশরিকদের নিকট ফেরত দেয়া হতে পারে?

এমন সময় আবূ জানদাল ইবনু সুহায়ল ইবনু আমর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বেড়ী পরিহিত অবস্থায় ধীরে ধীরে চলছিলেন। তিনি মক্কার নিম্নাঞ্চল থেকে বের হয়ে এসে মুসলিমদের সামনে নিজেকে পেশ করলেন। সুহায়ল বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনার সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রথম কাজ হলো তাকে আমার নিকট ফিরিয়ে দিবেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এখনো তো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি। সুহায়ল বলল, আল্লাহর কসম! তাহলে আমি আপনাদের সঙ্গে আর কখনো সন্ধি করব না। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কেবল এ ব্যক্তিটিকে আমার নিকট থাকার অনুমতি দাও। সে বলল, না, এ অনুমতি আমি দেব না। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, তুমি এটা কর। সে বলল, আমি তা করব না। মিকরায বলল, আমরা তাকে আপনার নিকট থাকার অনুমতি দিলাম।

আবূ জানদাল (রাঃ) বলেন, হে মুসলিম সমাজ, আমাকে মুশরিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হবে, অথচ আমি মুসলিম হয়ে এসেছি। আপনারা কি দেখছেন না, আমি কত কষ্ট পাচ্ছি। আল্লাহর পথে তাকে অনেক নির্যাতিত করা হয়েছে। ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এলাম এবং বললাম, আপনি কি আল্লাহর সত্য নাবী নন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, তা হলে দ্বীনের ব্যাপারে কেন আমরা এত হেয় হবো? আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘আমি অবশ্যই রাসূল; অতএব আমি তাঁর অবাধ্য হতে পারি না, অথচ তিনিই আমার সাহায্যকারী।’ আমি বললাম, আপনি কি আমাদের বলেন নাই যে, আমরা শীঘ্রই বায়তুল্লাহ্ যাব এবং তাওয়াফ করব। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি কি এ বছরই আসার কথা বলেছি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই কা‘বা গৃহে যাবে এবং তাওয়াফ করবে।

‘উমার (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললাম, ‘হে আবূ বাকর। তিনি কি আল্লাহর সত্য নাবী নন?’ আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘অবশ্যই।’ আমি বললাম, আমরা কি সত্যের উপর নই এবং আমাদের দুশমনরা কি বাতিলের উপর নয়? আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, নিশ্চয়ই। আমি বললাম, তবে কেন এখন আমরা আমাদের দ্বীনের ব্যাপারে এত হীনতা স্বীকার করব? আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘ওহে! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি তাঁর রবের নাফরমানী করতে পারেন না। তিনিই তাঁর সাহায্যকারী। তুমি তাঁর অনুসরণকে অাঁকড়ে ধরো। আল্লাহর কসম! তিনি সত্যের উপর আছেন।’ আমি বললাম, তিনি কি বলেননি যে, আমরা অচিরেই বায়তুল্লাহ্ যাব এবং তার তাওয়াফ করব? আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, অবশ্যই। কিন্তু তুমি এবারই যে যাবে একথা কি তিনি বলেছিলেন? আমি বললাম, না। আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘তবে নিশ্চয়ই তুমি সেখানে যাবে এবং তার তাওয়াফ করবে।’ যুহরী (রহ.) বলেন যে, ‘উমার (রাঃ) বলেছেন, আমি এর জন্য (অর্থাৎ ধৈর্যহীনতার কাফ্ফারা হিসেবে) অনেক নেক আমল করেছি।

বর্ণনাকারী বলেন, সন্ধিপত্র লেখা শেষ

হলে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবাদেরকে বললেন, ‘তোমরা উঠ এবং কুরবানী কর ও মাথা কামিয়ে ফেল।’ রাবী বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল তিনবার তা বলার পরও কেউ উঠলেন না।’ তাদের কাউকে উঠতে না দেখে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর নিকট এসে লোকদের এই আচরণের কথা বলেন। উম্মু সালামাহ (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর নাবী, আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সঙ্গে কোন কথা না বলে আপনার উট আপনি কুরবানী করুন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিন।’ সেই অনুযায়ী আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সঙ্গে কোন কথা না বলে নিজের পশু কুরবানী দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়ালেন। তা দেখে সহাবীগণ উঠে দাঁড়ালেন ও নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলেন এবং একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন। অবস্থা এমন হল যে, ভীড়ের কারণে একে অপরের উপর পড়তে লাগলেন।

অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট কয়েকজন মুসলিম মহিলা এলেন। তখন আল্লাহ্ তাআলা নাযিল করলেনঃ ‘‘হে মুমিনগণ! মুমিন মহিলারা তোমাদের নিকট হিজরত করে আসলে,………..কাফির নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না।’’ (আল-মুমতাহিনাহঃ ১০)।

সেদিন ‘উমার (রাঃ) দু’জন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন, তারা ছিল মুশরিক থাকাকালে তাঁর স্ত্রী। তাদের একজনকে মু‘আবিয়াহ ইবনু আবূ সুফ্ইয়ান এবং অপরজনকে সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া বিয়ে করেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদিনা্য় ফিরে আসলেন। তখন আবূ বাসীর (রাঃ) নামক কুরাইশ গোত্রের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এলেন। মক্কার কুরাইশরা তাঁর তালাশে দু’জন লোক পাঠাল। তারা (রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে) বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছেন (তা পূর্ণ করুন)। তিনি তাঁকে ঐ দুই ব্যক্তির হাওয়ালা করে দিলেন। তাঁরা তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং যুল-হুলায়ফায় পৌঁছে অবতরণ করল আর তাদের সঙ্গে যে খেজুর ছিল তা খেতে লাগল। আবূ বাসীর (রাঃ) তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম! হে অমুক, তোমার তরবারিটি খুবই চমৎকার দেখছি। সে ব্যক্তিটি তরবারীটি বের করে বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! এটি একটি উৎকৃষ্ট তরবারী। আমি একাধিক বার তার পরীক্ষা করেছি। আবূ বাসীর (রাঃ) বললেন, তলোয়ারটি আমি দেখতে চাই আমাকে তা দেখাও। অতঃপর ব্যক্তিটি আবূ বাসীরকে তলোয়ারটি দিল। আবূ বাসীর (রাঃ) সেটি দ্বারা তাকে এমন আঘাত করলেন যে, তাতে সে মরে গেল।

অতঃপর অপর সঙ্গী পালিয়ে মদিনা্য় এসে পৌঁছল এবং দৌড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে দেখে বললেন, এই ব্যক্তিটি ভীতিজনক কিছু দেখে এসেছে। ইতোমধ্যে ব্যক্তিটি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট পৌঁছে বলল, আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, আমিও নিহত হতাম। এমন সময় আবূ বাসীর (রাঃ)-ও সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর! আল্লাহর কসম! আল্লাহ্ আপনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাকে তার নিকট ফেরত দিয়েছেন; এ ব্যাপারে আল্লাহ্ আমাকে তাদের কবল থেকে নাজাত দিয়েছেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সর্বনাশ! এতো যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিতকারী, কেউ যদি তাকে বিরত রাখত।

আবূ বাসীর (রাঃ) যখন এ কথা শুনলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে, তাকে আবার তিনি কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠাবেন। তাই তিনি বেরিয়ে নদীর তীরে এসে পড়লেন। রাবী বলেন, এ দিকে আবূ জানদাল ইবনু সুহায়ল কাফিরদের কবল থেকে পালিয়ে এসে আবূ বাসীরের সঙ্গে মিলিত হলেন। অতঃপর থেকে কুরাইশ গোত্রের যে-ই ইসলাম গ্রহণ করতো, সে-ই আবূ বাসীরের সঙ্গে এসে মিলিত হতো। এভাবে তাদের একটি দল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তাঁরা যখনই শুনতে যে, কুরাইশদের কোন বাণিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাবে, তখনই তাঁরা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন আর তাদের হত্যা করতেন ও তাদের মাল সামান কেড়ে নিতেন। তখন কুরাইশরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট লোক পাঠাল। আল্লাহ্ ও আত্মীয়তার ওয়াসীলাহ দিয়ে আবেদন করল যে, আপনি আবূ বাসীরের নিকট এত্থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ পাঠান। এখন থেকে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট কেউ এলে সে নিরাপদ থাকবে (কুরাইশদের নিকট ফেরত পাঠাতে হবে না)।

অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের নিকট নির্দেশ পাঠালেন। এ সময় আল্লাহ্ তা‘আলা নাযিল করেনঃ وَهُوَ الَّذِيْ كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْم بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ থেকে الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ পর্যন্ত। ‘‘তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে বিরত রেখেছেন ….. জাহিলী যুগের অহমিকা পর্যন্ত’’  (আল-ফাত্হঃ ২৬)। তাদের অহমিকা এই ছিল যে, তারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে আল্লাহর নাবী বলে স্বীকার করেনি এবং بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ  মেনে নেইনি; বরং বায়তুল্লাহ্ ও মুসলিমদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।

(১৬৯৪-১৬৯৫) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৫৩১ প্রথমাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫৪৪)

সূত্রঃ সহীহ বুখারী, মাকতাবায়ে শামেলা, হাদিস নং – ২৭৩১।

 

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: