শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১৩ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

রোজা ও রমজান: পর্ব-৪৪: ইতিকাফ পালন ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

মুফতি মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন

 আপডেট: ২২:৩৬, ২৮ এপ্রিল ২০২২

রোজা ও রমজান: পর্ব-৪৪: ইতিকাফ পালন ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

ইতিকাফঃ ইতিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ কোন এক স্থানে অবস্থান করা। আর কুরআন-সুন্নাহর পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয় কতকগুলো বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একটা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। রমযানের শেষ দশকের সুন্নত ইতিকাফ শুরু হয় রমযানের ২০ তারিখে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্ব থেকে। তা সমাপ্ত হবে রমযানের শেষ সময়ে। পুরুষের জন্য মসজিদে এবং মহিলাদের জন্য নিজ গৃহে সালাতের নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করতে হয়। 

 

গুরুত্বঃ কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে ইতিকাফের অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল-কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে-
وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِىَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ
‘আমি হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ.) কে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী এবং রুকু-সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ সূরা ইবরাহীম, আয়াত-১২৫


সহীহ বুখারীতে হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে- 
كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ
‘রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। অতঃপর তার বিবিগণ তাঁর পর ইতিকাফ করতেন।’ সহীহ বুখারী, হাদীস-২০২৬

 

ইতিকাফের ফযিলতঃ ইতিকাফের ফযিলত অনেক। আমরা এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি ফযিলতের কথা আলোচনা করব।


১। রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফে দু’টি হজে¦র সাওয়াব পাওয়া যায়।


২। রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফে দু’টি ওমরা পালনের সাওয়াব পাওয়া যায়। হাদীসে এসেছে-
مَنْ اِعْتَكَفَ عَشْراً فِىْ رَمَضَانَ كانَ كَحَجَّتَيْنِ وَعُمْرَتَيْنِ
‘যে ব্যক্তি রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করবে তার সে যেন দু’টি হজ¦ এবং দু’টি ওমরা পালনের সাওয়াব লাভ করল।’ শুয়াবুল ঈমান, হাদীস-৩৯৬৬ 


৩। জাহান্নামকে কয়েক কোটি মাইল দূরে সরিয়ে দেয়া হবে। হাদীসে এসেছে-
مَنْ مَشَى فِىْ حَاجَةِ أَخِيْهِ كَانَ خَيْرًا لَهُ مِنْ اِعْتِكَافِ عَشْرَ سِنِيْنَ وَمَنْ اعْتَكَفَ يَوْمًا اِبْتِغَاءً وَجْهِ الله جَعَلَ الله بَيْنَه وَبَيْنَ النَّارِ ثَلَاثَ خَنَادِقَ كُلُّ خَنْدَقٍ أَبْعَدَ مِمَّا بَيْنَ الْخَافِقَيْنِ
‘যদি কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে হেঁটে যায় তবে তা তার জন্য দশ বৎসর ইতিকাফ করার চেয়েও বেশি উত্তম। আর যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে মহান আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। আর প্রত্যেক পরিখার দূরত্ব হলো দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি।’ আল-মুয়জামুল আওসাত, হাদীস-৭৩২৬

 

ইতিকাফের আমল ও আদবঃ 
১. কারো সাথে অহেতুক কথা না বলা। ২. উত্তম মসজিদ নির্বাচন করা। যেমন: মসজিদে হারাম, তারপর মসজিদে নববী, তারপর ফিলিস্তিনের বাইতুল মুকাদ্দাস, এরপর প্রত্যেক জামে মসজিদ এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় হয় এমন মসজিদ। ৩. বেশী করে কুরআন তিলাওয়াত করা। ৪. যিকির-আযকার এবং মাসনুন দুআ পড়া। আমরা এ বিষয়ে ‘লাইলাতুল কদর’ এর আলোচনাতে ‘আমলের’ শিরোনামে কিছু আমলের কথা উল্লেখ করেছি। সেখানে দেখে নিতে পারেন।

 

ইতিকাফের প্রকার ও সময়ঃ 
ইতিকাফ তিন প্রকার, এক. ওয়াজিব ইতিকাফ। তা হচ্ছে মান্নত ইতিকাফ। যেমন কেউ মান্নত করল তার অমুক কাজ হলে এতদিন ইতিকাফ করবে। যদি তার অমুক কাজটি হয়ে যায় তাহলে মান্নতকারী ব্যক্তি যতদিন ইতিক্বাফের মান্নত করবে সে ততদিন ইতিকাফ করা তার জন্য ওয়াজিব। দুই. সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। তা হচ্ছে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা। তিন. মুস্তাহাব ইতিকাফ। তা হচ্ছে উল্লেখিত দুইটি ইতিকাফ ব্যতিত যে ইতিকাফ করা হয়। যেমন নামাযের জন্য মসজিদে প্রবেশের সময় যে ইতিকাফ করার নিয়ত করা হয় তা মুস্তাহাব ইতিকাফ। এর কোনো সময় নির্ধারণ করা নেই। ভালোকরে মনে রাখতে হবে, মান্নত ইতিক্বফের জন্য সিয়াম পালন করা শর্ত। বাকী দুটি ইতিক্বাফের জন্য সিয়াম করা শর্ত নয়। আল-ফিকহুল মুয়াসসার

 

বিধান/হুকুমঃ 
রমযানের এই ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্বাদায়ে কিফায়া। সুতরাং মহল্লার একজন হলেও এই ইতিকাফ অবশ্যই করতে হবে। একজন করলেও মহল্লার সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। অন্যথায় মহল্লার সবাই সুন্নতে মুয়াক্কাদা ছেড়ে দেয়ার কারণে গুনাহগার হবে। 

 

ইতিকাফ নষ্ট হওয়ার কারণ: 
কিছু কারণ রয়েছে এমন যেসব কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন- ক. অকারণে মসজিদের বাইরে গেলে। তবে পেশাব-পায়খানা, ওযূ এবং ফরজ গোসলের জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে। পাঞ্জেগানা মসজিদে ইতিকাফ করলে জুমার সালাত আদায়ের জন্য বাইরে যেতে পারবে। এসব কাজ সম্পন্ন করার পর বিলম্ব করা যাবে না। খ. মহিলাদের ক্ষেত্রে তাদের মাসিক ঋতু এলে। গ. দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করলে এবং এর প্রাসঙ্গিক কোনো কাজ করলে। আল-ফিকহুল মুয়াস্সার

উদ্দেশ্যঃ ইতিকাফের উদ্দেশ্য হল লাইলাতুল কদরে ইবাদতের সুযোগ লাভ করা। ইতিকাফ পালন করা অবস্থায় বেশি বেশি ইবাদত করা। যেন লাইলাতুল কদর নিশ্চিত হয়। এজন্য উচিত হচ্ছে অহেতুক কথা ও কাজ পরিহার করে মহান আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকা।
আমরা সাদকাতুল ফিতর সম্পর্কে ‘মাহে রমযানের ঐতিহাসিক কর্মসূচী’র প্রথম কর্মসূচীতে আলোচনা করেছি। 
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে কুরআন-হাদীসের আলোকে ইতিকাফ পালন করার তাওফিক দান করুন এবং এর ফযিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন।
نرجو الله تعالى أن يجعل عملنا هذا خالصًا لوجهه الكريم وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

 

মুফতি মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন
সাতাউক মধ্যগ্রাম, লাখাই, হবিগঞ্জ
আমলের কথা জানতে ইউটিউবে সার্চ করুন, 01712961470

মন্তব্য করুন: