রোজা ও রমজান: পর্ব-৪২: লাইলাতুল কদরের আমল
মুফতি মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন
আপডেট: ০৯:১৯, ২৭ এপ্রিল ২০২২
লাইলাতুল কদরে আমলের কোনো বিশেষ পদ্ধতি নাই। কারণ এগুলো নফল আমল। অতএব যার যত ইচ্ছা সে ততই বেশি আমল করতে পারেন। তবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা ওলীগণের নিয়ম হল, তারা রাতে যে পরিমাণ সময় জাগ্রত থাকতে পারবেন সে সময়কে আমলের জন্য তাঁরা তিনভাগ করে নিতেন।
প্রথমভাগঃ অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত। দ্বিতীয়ভাগঃ বেশী-বেশী নফল সালাত (নামায) পড়া। বিশেষকরে ওমরী কাযা আদায় করা। তৃতীয়ভাগঃ অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা। মহান আল্লাহর যিকির এবং নবী (সা.) এর প্রতি সালাত (দরুদ) প্রেরণ করা।
এ বিষয়টি কুরআনের আয়াতে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ
‘আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব তিলাওয়াত করুন এবং সালাত কায়েম করুন। নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর যিকির সর্বশ্রেষ্ঠ।’ সূরা আনকাবুত, আয়াত-৪৫
তাহলে আমরা রাতের তিনটিভাগে যেসব আমল করতে পারি তা হচ্ছে-
১. কুরআন তিলাওয়াত করাঃ এর সওয়াব অনেক বেশী । হাদীসে এসেছে-
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
‘তোমাদের মধ্যে সে সর্বোত্তম যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যজনকে কুরআন শিক্ষা দেন।’ (সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নং-৫০২৭
২. বেশী-বেশী নফল সালাত (নামায) পড়া। বিশেষকরে ওমরী কাযার সালাত আদায় করাঃ আর নফল সালাতের মধ্যে রাকআত সংখ্যা বেশী হওয়ার চেয়ে সালাতের রাকআত উত্তম হওয়া অনেক ভালো। মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমরা সাজদাহ করো এবং নৈকট্য অর্জন করো। (সূরা আলাক্ব, আয়াত-১৯)
আমাদের এই সংক্ষিপ্ত পুস্তিকাতে ‘ওমরী কাযা’ এবং ‘সালাতুত তাসবীহ’ সম্পর্কে কিছু লিখা সম্ভব হয়নি। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা অন্যান্য নির্ভরযোগ্য পুস্তক থেকে আপনারা জেনে নিবেন।
৩. অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করা। মহান আল্লাহর যিকির এবং নবী (সা.) এর প্রতি সালাত (দরুদ) প্রেরণ করা। এ বিষয়েও এখানে বিস্তারিত কিছু লিখা সম্ভব হয়নি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের লিখা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ‘মাসনুন দুআ ও যিকির’ বইটি পড়তে পারেন। আমাদের এই বইটির পরিবেশক ‘মাসনুন দুআ ও যিকির’ সম্পর্কিত বইটি পরিবেশন করেছেন। এছাড়া আমাদের সার্বিক যোগাযোগ ঠিকানাতে যোগাযোগ করতে পারেন। এখানে কয়েকটি আমলের কথা উল্লেখ করছি।
ক. ফযিলতপূর্ণ কয়েকটি দরুদঃ
যে দরুদ পড়লে এক হাজার দিন পর্যন্ত সওয়াব লিখা হয়ঃ
جَزَى اللهُ عَنَّا مُحَمَّدًا مَا هُوَ أَهْلُهُ
জাযাল্লাহু য়ান্না মুহাম্মাদান মা- হুওয়া আহলুহু।
‘ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদ (সা.) কে আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিদান প্রদান করুন তিনি যে সকল প্রতিদানের উপযুক্ত।’ মাযমাউয যাওয়াইদ, হাদীস-১৭৩০৫
ফযিলতঃ যে ব্যক্তি উল্লেখিত দরুদটি একবার পাঠ করবেন, তার জন্য ৭০ জন ফিরিশতা এক হাজার দিন পর্যন্ত অনবরত সওয়াব লিখতে থাকবেন। মাযমাউয যাওয়াইদ, হাদীস-১৭৩০৫
যে দরুদ পড়লে আশি বছরের গুনাহ মাফ হয়ঃ
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِىِّ الْاُمِّىِّ وَعَلَى آلِهِ وَسَلِّمَ تَسْلِيْمًا
আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদিন আন-নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি, ওয়ালা আ-লিহি ওয়া ছাল্লিম তাসলীমা।
‘হে আল্লাহ! উম্মি নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর এবং তাঁর পরিবার পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করুন। শান্তি বর্ষণ করুন পরিপূর্ণভাবে।’ ইরশাদুল ইবাদ ইলা সাবিলির রাসাদ, ১/৮১
নোটঃ যে ব্যক্তি জুমআর দিন আছরের সালাতের পর কারো সাথে কথা বলার পূর্বে এবং সালাতের স্থান থেকে উঠার আগে আশিবার উল্লেখিত দরুদটি পাঠ করবেন, মহান আল্লাহ তাঁর আশি বছরের সকল ছগীরা গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তাঁকে আশি বছরের নফল ইবাদত-বন্দেগী করার সমান সওয়াব দান করবেন। ইরশাদুল ইবাদ ইলা সাবিলির রাসাদ, ১/৮১ (শামিলা)
খ. ইস্তিগফার পাঠ করাঃ ইস্তিগফার হচ্ছে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, যা তাওবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কুরআন-হাদীসে ‘ইস্তিগফার’-এর অনেক ফযিলত রয়েছে। হাদীসে যে সব ইস্তিগফার বর্ণিত হয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ইস্তিগফার হচ্ছে ‘সায়্যিদুল ইস্তিগফার’ যা বুখারীসহ অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে-
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّىْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِىْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوْءُ لَكَ بِذَنْبِىْ فَاغْفِرْ لِىْ فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلَّا أَنْتَ
আল্লাহুম্মা আংতা রাব্বি, লা-ইলাহা ইল্লা আংতা খালাক্বতানী। ওয়া আনা আবদুকা, ওয়া আনা আলা আহদিকা, ওয়া ওয়াদিকা মাছতা ত্বায়‘তু আউযুবিকা মিং শাররি মা ছানা‘তু, আবুউলাকা বিনিয় মাতিকা আলাইয়া। ওয়া আবুউলাকা বিযামবী ফাগফিরলী, ফাইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আংতা।
‘হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রভু। আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দা। আমি সাধ্যমত আপনার প্রতিশ্রæতিতে অঙ্গিকারাবদ্ধ রয়েছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট হতে আপনার কাছে আশ্রয় চাই। আমার প্রতি আপনার নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করছি। আর আমি আমার গুনাহ স্বীকার করছি, অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি ছাড়া গুনাহ ক্ষমা করার কেউ নেই। সহীহ বুখারী, হাদীস-৬৩০৬
‘যদি সকালে দৃঢ় বিশ্বাস করে ইস্তিগফার পড়ে, আর ঐদিন সে সন্ধ্যার আগে মারা যায় তাহলে সে জান্নাতে যাবে। এমনিভাবে সন্ধ্যার সময় কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে পড়ে সকাল হওয়ার আগেই সে মারা যায় তাহলে সেও জান্নাতে যাবে।’ সহীহ বুখারী, হাদীস-৬৩০৬
এছাড়াও হাদীসে আরো অনেক ইস্তিগফার বর্ণিত রয়েছে। আর সবচেয়ে ছোট ইস্তিগফার হলো اَسْتَغْفِرُ اللَّه (আস্তাগফিরুল্লাহ) অথবা رَبِّ اغْفِرْ لِىْ (রাব্বিগ ফিরলী) পড়া।
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাদি.) জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! (সা.) যদি আমি লাইলাতুল কদর বুঝতে পারি, তবে আমি কি দুআ করব? তিনি উত্তর দিলেন: তুমি এই দুয়া পড়বে-
اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّى
‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। মেহেরবানী করে আমাকে ক্ষমা করুন।’ (আল-মুসতাদরাক, হাদীস নং-১৯৪২)
গ. সহীহ হাদীসে বর্ণিত সর্বাধিক সাওয়াব লাভের আমলঃ
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، يُحْيِىْ وَيُمِيْتُ وَهُوَ حَىٌّ لَا يَمُوْتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ
‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো মা‘বুদ নেই। তিনি এক। তার কোনো অংশীদার নেই। রাজত্ব এবং সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি জীবিত করেন এবং মৃত্যু দান করেন। তিনি চিরঞ্জীব, কখনো মৃত্যু বরণ করেন না। তাঁরই হাতে কল্যাণ। তিনি সকল বিষয়ের উপর সর্বশক্তিমান।’ তিরমিযি, হাদীস-৩৪২৯
ফযিলতঃ হযরত ওমর (রাদি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
مَنْ قَالَ فِىْ السُّوْقِ لَا إلَهَ إلَّا الله ... شَىْءٍ قَدِيْرٌ؛ كَتَبَ الله لَهُ أَلْفَ أَلْفِ حَسَنَةٍ وَمَحَا عَنْهُ أَلْفَ أَلْفِ سَيِّئَةٍ وَرَفَعَ لَهُ أَلْفَ أَلْفِ دَرَجَةً وَبَنَى لَهُ بَيْتًا فِى الْجَنَّةِ
‘যে ব্যক্তি বাজারে (হাট-বাজার, ঘাট, শহর-বন্দর, কর্মস্থল, দোকান, অফিস, আদালত ইত্যাদিতে) প্রবেশ করে উল্লেখিত দুআটি বলবে, আল্লাহ তাঁর জন্য দশ লক্ষ সওয়াব লিখবেন। তাঁর দশ লক্ষ (সাধারণ ছোটখাট) গুনাহ মুছে দিবেন। তাঁর দশ লক্ষ মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং তাঁর জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি তৈরি করবেন। তিরমিযি, হাদীস-৩৪২৯
নোটঃ সাধারণত কোনো সহীহ হাদীসে কোনো যিকির বা আমলের এত বেশি সওয়াবের কথা পাওয়া যায় না। এখানে পাঠক/পাঠিকা একটু চিন্তা করলেই বেশি সওয়াবের কারণ বুঝতে পারবেন। কারণ হচ্ছে, যে স্থানে আল্লাহর স্মরণ ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে স্থানে তাঁকে স্মরণ করার সওয়াবও বেশি। হাট-বাজার, ঘাট, শহর-বন্দর, কর্মস্থল, দোকান, অফিস, আদালত ইত্যাদিতে মানুষের দেহ-মন স্বভাবতই বিভিন্নমুখী কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকে। এ সময়ে যে বান্দা নিজেকে আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত রাখতে পারেন তিনি নিঃসন্দেহে এই বিশাল সওয়াবের অধিকারী হবেন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
মুফতি মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন
সাতাউক মধ্যগ্রাম, লাখাই, হবিগঞ্জ
আমলের কথা জানতে ইউটিউবে সার্চ করুন, 01712961470
মন্তব্য করুন: