শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১৪ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

রোজা ও রমজান: পর্ব-৩৯: লাইলাতুল কদর’ কখন?

মুফতি মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন

 আপডেট: ২২:৪৫, ২৫ এপ্রিল ২০২২

রোজা ও রমজান: পর্ব-৩৯: লাইলাতুল কদর’ কখন?

‘লাইলাতুল কদর’ কখন? এ ব্যপারে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। যেমন- 
১. বছরের যে কোন দিনঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) এবং ইরাকের কুফা নগরীর আলেমদের মতে ‘লাইলাতুল কদর’ সারা বছরে একটি এবং তা যে কোন মাসেই থাকার সম্ভাবনা আছে। 
২. রমযানুল মুবারকের পুরো মাসে ‘লাইলাতুল কদর’ থাকার সম্ভবনা রয়েছে।
৩. ইমাম গাযালি (রহ.) বলেছেন, রমযানের প্রথম রাত্রিই লাইলাতুল কদরের রাত্রি। (ইবনে কাছির, সূরায়ে কদরের ব্যাখ্যা।)
৪. রমযান মাসের একুশতম রাত্রি হলো ‘লাইলাতুল কদর।’ 
৫. রমযানের তেইশ তারিখ।     ৬. রমযানের চব্বিশ তারিখ। 
৭. হযরত আলী (রাদি.) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) হতে বর্ণিত আছে, রমযানের ঊনত্রিশতম রাত্রি হলো ‘লাইলাতুল কদর।’


৮. রমযানের শেষ দশকেঃ হযরত মুরসিদ (রাদি.) বলেন, আমি হযরত আবু যর (রাদি.) কে জিজ্ঞাসা করলাম ‘লাইলাতুল কদর’ সম্পর্কে আপনি কি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে কোনো প্রশ্ন করেছিলেন? হযরত আবু যর (রাদি.) উত্তরে বললেনঃ জেনে রেখো, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রায় সময় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করতাম। একবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম: হে আল্লাহর রাসূল! (সা.) আচ্ছা, ‘লাইলাতুল কদর’ কি রমযান মাসেই রয়েছে, নাকি অন্য মাসে রয়েছে। তিনি আমাকে উত্তরে বললেন, ‘লাইলাতুল কদর’ রমযান মাসেই রয়েছে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এই রাত্র কি নবীদের জীবদ্দশা পর্যন্তই থাকবে, নাকি কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তরে আমাকে বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। আমি আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, এই রাত্রি রমযানের কোন অংশে আছে? তিনি আমাকে জবাব দিলেন, ‘এই রাত্রি রমযানের প্রথম ও শেষ দশকে অনুসন্ধান কর। আমি তখন নীরব হয়ে রইলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্য দিকে মনোনিবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর একটু সুযোগ পেয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আমার হক আছে। এই জন্য আমি আপনাকে ক্বসম দিচ্ছি। দয়া করে আমাকে সংবাদ দিন, লাইলাতুল কদরের রাত্রি কোনটি? তিনি প্রশ্ন শুনে আমার উপর অত্যন্ত রাগ করলেন। ইতঃপূর্বে আমার উপর এতো রাগ আর কোনদিন করেননি। তারপরও তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, রমযানের শেষ দশ রাত্রে তালাশ করো। এরপর প্রশ্ন করো না’। 


৯. রমযানের ২৭ তারিখ। অর্থাৎ ছাব্বিশতম সিয়ামের পর যে রাত্রি আসে সেই রাত্রে। মুসনাদে আহমদে রয়েছে যে, প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উবাই ইবনে  কা’ব (রাদি.) কে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ আপনার ভাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) বলতেন, যে ব্যক্তি বৎসরের প্রত্যেক রাত্রে জাগ্রত থাকবে সে অবশ্যই ‘লাইলাতুল কদর’ পাবে। এ কথা শুনে উবাই ইবনে কা’ব (রাদি.) বললেন: আমি ঐ মহান আল্লাহর কসম করে বলছি, যিনি ছাড়া অন্য কোনো মা’বুদ নেই, ‘মহান আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন, তিনি (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এ কথা জানতেন যে, ‘লাইলাতুল কদর’ রমযান মাসের মধ্যে রয়েছে। আমার ভাই এই কথাও জানতেন যে, রমযানের সাতাইশতম রাত হলো ‘লাইলাতুল কদর’। 


হযরত কা’ব (রাদি.) কে আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো: আপনি এটা কি করে জানতে পারলেন। জবাবে তিনি বললেন, আমাদেরকে যে সব নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে সে সব দেখেই আমরা বুঝতে পেরেছি। যেমন, ঐ দিন সূর্য উদিত হওয়ার সময় সূর্য কিরণহীন অবস্থায় উদিত হয়। হযরত মুআবিয়া (রাদি.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাদি.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদি.), ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রীস আশ্শাফিয়ীর (রহ.), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্মল (রহ.) এবং ইমাম হাসান বসরী (রহ.) এমনকি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সহ প্রমুখের  মতে রমযান মাসের সপ্তদশ রাত্রিই হলো ‘লাইলাতুল কদর’। কোন মনীষী এই মতের উপর কুরআনের শব্দ দ্বারাও প্রমাণ পেশ করেছেন। যেমন, তাঁরা বলেনঃ আলোচ্য সূরার সর্বশেষ আয়াতে বর্ণিত  هِيَ (হিয়া অর্থঃ এটা) শব্দটি এই সূরার সাতাশতম শব্দ। এতেই প্রমাণ হয় যে, লাইলাতুল কদর রমযানের সাতাশতম রাত।


হাফিয আবুল কাসিম তাবরানি (রাহ.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাদি.) সাহাবায়ে কিরামকে সমবেত করে ‘লাইলাতুল কদর’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন সবাই ঐক্যমত প্রকাশ করলেন যে, এ রাত্রি রমযান মাসের শেষ দশকে রয়েছে। তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রাদি.) বললেনঃ ‘ঐ রাত্রি কোন্ রাত্রি সেটাও আমি জানি।’ হযরত উমর (রাদি.) তখন প্রশ্ন করলেনঃ সেটা কোন রাত্রি? হযরত ইবনে আব্বাস (রাদি.) জবাবে বললেনঃ ‘শেষ দশকের সাত দিন অতীত হবার পর অথবা সাত দিন বাকি থাকার পূর্বে।’ হযরত উমর (রাদি.) আবারও জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনি এটা কি করে জানলেন? হযরত ইবনে আব্বাস (রাদি.) বললেন: ‘দেখুন, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-
ক. সাতটি আকাশ সৃষ্টি করেছেন।        খ. সাতটি জমিন সৃষ্টি করেছেন। 
গ. সাত দিনে সপ্তাহ ও মাস আবর্তিত হয়।     ঘ. সাত থেকে মানুষের জন্ম।
ঙ. সাতটি বস্তু থেকে মানুষ খায়।         চ. সাত অঙ্গ দ্বারা সিজদা করে।


ছ. সাত হল কাবাগৃহের তাওয়াফের সংখ্যা।    জ. সাতটি প্রস্তর খন্ড দ্বারা শয়তানের প্রতি নিক্ষেপ করা হয়। এ ছাড়াও সাত সংখ্যায় আরো অনেক কিছু আছে। একথা শুনে হযরত উমর (রাদি.) বললেন: ‘আমাদের বিবেক বুদ্ধি যেখানে যেতে পারেনি, আপনার বিবেক সেখানে পৌছেছে। 


হযরত বাইজিদ বোস্তামী (রাহ.) বলেন: সূরায়ে কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দটি তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে, এবং আরবীতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দটিতে নয়টি অক্ষর আছে। এবার গণিতের সূত্রমতে নয়কে তিন দ্বারা গুন করলে ফলাফল হয় সাতাশ। অতএব আমরা আরো আশা করতে পারি ‘লাইলাতুল কদর’ রমযানের সাতাশ তারিখ। তাহলে এবার প্রশ্ন জাগে যে, এই রাতের তারিখটি অনির্দিষ্ট রাখা হয়েছে কেন? 

 

মুফতি মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন
সাতাউক মধ্যগ্রাম, লাখাই, হবিগঞ্জ
আমলের কথা জানতে ইউটিউবে সার্চ করুন, 01712961470

মন্তব্য করুন: