বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য

স্মৃতির জোনাকি...

 প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৩ আগস্ট ২০২০

স্মৃতির জোনাকি...

আমি মনে হয় এই পৃথিবীর সেইসব সৌভাগ্যবতী মেয়েদের একজন যারা জন্মের আগে থেকেই তাদের মামণিদের কথনসাথী। মামণি যত কথা আমার জন্মের আগে আমার সাথে বলেছেন তত কথা মনে হয় না জন্মের পর থেকে নিয়ে গত ১৭ বছরে বলেছেন। আমাদের পরিবারের প্রতিজন সদস্য সম্পর্কে মোটামুটি সবকিছু জন্মের আগেই মামণি আমাকে বলে ফেলেছিলেন। কিভাবে বলেছিলেন? আমার জন্য লেখা মামণির ডায়েরিতে। এমন একটা করে ডায়েরির মালিক অবশ্য আমরা সব ভাইবোনেরাই। কিন্তু আমার ডায়েরিটা সবচেয়ে স্পেশাল। স্পেশাল হবার অন্যতম দুটা কারণের একটি হচ্ছে আমার ডায়েরিটা মামণিকে পাপা গিফট করেছিলেন। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমার ডায়েরিটার একটা নাম আছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা নাম। ডায়েরির একদম প্রথমে মামণি লিখেছেন," অনিশ্চিত অনাগতের স্বপ্ন আঁকি, সাথে নিয়ে অতীত স্মৃতির জোনাকি"।

প্রথম পৃষ্ঠায় মামণি লিখেছেন, প্রিয় মানুষরা সবসময় আমাদের সাথে থাকে না। সাথে থাকে প্রিয় মানুষদের সাথে কাটানো দুঃখ-সুখের মূহুর্তগুলো। প্রিয়জনদের দেয়া বিরহানন্দের প্রহরগুলোর স্পর্শে জীবন গল্পে রচিত আনন্দ-বেদনার কাব্য। মনের আকাশে প্রিয়জনরাই তারার ফুল হয়ে হাসে, শুভ্র মেঘ হয়ে ভাসে, উঁকি দেয় প্রশান্তির এক ফালি চাঁদ রুপে। প্রিয়জন নামক ভেলায় চড়েই জীবনগাঙে ভিড়ে সুখপাখী। প্রতিজন প্রিয় মানুষ আসলে এক একটি জোনাকি। তাদের সাথে কাটানো ক্ষণ আলোতে হাসে, আঁধারে জ্বলজ্বল করে। ঠিক যেন স্মৃতির জোনাকি! স্মৃতির জোনাকি শব্দটা মামণি একাধিকবার লিখেছেন ডায়েরিতে বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে। আমার ডায়েরির নাম তাই আমি রেখেছি স্মৃতির জোনাকি। নামকরণের পেছনে এরচেয়েও বড় কারণ হচ্ছে যখনই কোন কারণে আমার মনে আঁধার ভর করে, মামণির ডায়েরিতে চোখ বুলালেই মনের ভেতরটা আলো আলো হয়ে যায়। সকল প্রতিকূলতাকে দিতে পারি আমি ফাঁকি, সম্মুখে মেলে ধরি যখন মামণির রেখে যাওয়া স্মৃতির জোনাকি। আলহামদুলিল্লাহ।

ডায়েরিতে আমাকে বলা মামণির প্রথম শিক্ষা ছিল, "জানো ছোট্ট বুড়ি এই জগতে সত্যিকার সুখী হতে চাইলে সর্বাগ্রে আত্মসুখ বিসর্জন দিতে হয়। জগতে যারাই আত্মসুখের লিপ্সা ত্যাগ করতে পেরেছে সুখ তাদের মনের গহীনে সবরের অলংকারে নিজ সাম্রাজ্য গড়ে নিয়েছে। আত্মত্যাগী মানুষেরা সেজন্য-ই এত স্থির, এত প্রশান্ত থাকতে পারে সর্বাবস্থাতে। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করি নিজের আগে আমার আপনজনদের সুখকে বড় করে দেখার। জানি না কতটুকুন পারি তবে কারো চোখের নদীতে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তোলার চাইতে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি রূপে ফুটতেই ভালোবাসি। আমার কারণে কেউ ব্যথিত হবে এমনটা কল্পনাও করতে পারিনা। মনেহয় কিছু ব্যথা সয়ে যদি অন্যের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারি এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিইবা হতে পারে জীবনে! আমার এমন ভাবনার পেছনে তোমার নানুমণির বিশাল অবদান রয়েছে। তোমার নানুমণি মানে আমার মামণি আমার ছোট্ট জীবনে দেখা সবচেয়ে অনন্যা নারী। মামণিকে দেখেই আমি শিখেছি ভালোবাসার সুতোয় কিভাবে গাঁথতে হয় সম্পর্কের মোতি। হাসতে হাসতে কিভাবে নিজের সুখের বদলে অন্যের তরে খুশি খরিদ করতে হয় সেই শিক্ষাও তোমার নানুমণির কাছ থেকেই পেয়েছি। জানি না আমি আমার মামণির মতো অসাধারণ মা হতে পারবো কিনা! তবে আমার মামণির কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো তোমাকে উপহার স্বরূপ দিয়ে যেতে চাই। কেননা তুমি এসবের হকদারও।"

এইটুকুন লিখে থামলো নাবিহা। জানালার পর্দা সরিয়ে বাগানে উঁকি দিলো। পুরো বাগানে চোখ বুলিয়ে আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিতে দেখতে না পেয়ে কিঞ্চিৎ আশাহত হতো। এই সময় পাপা সাধারণত বাগানেই থাকেন। আজকে তাহলে নিয়মের ব্যতিক্রম হলো কেন? নিয়মের ব্যতিক্রম হবার কারণ উদঘাটনের জন্য ডায়েরি বন্ধ করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো নাবিহা। মামণির ডায়েরির আলোকে নতুন আরেকটা ডায়েরি লিখতে শুরু করেছে এই তথ্যটা সবার আগে পাপাকে জানাতে চায় নাবিহা। কারণ এমনটা করার পরামর্শ পাপাই তাকে দিয়েছিলেন। একদিন কথায় কথায় পাপাকে বলেছিল মামণির ডায়েরি নিয়ে বসলেই নানান ধরণের ভাবনা এসে উঁকি দেয় মনে। পাপা তখন বলেছিলেন, এটা খুব স্বাভাবিক আমরা যখন কারো কথা শুনি, পড়ি তখন সেই কথাগুলোকে ঘিরে আমাদের মনে নিজস্ব ভাবনার জন্ম হয়। আমি চেষ্টা করি আমার এমন ভাবনাগুলোকে টুকে রাখতে। তুমিও চাইলে টুকে রাখতে পারো। পাপার কথা শোনার পর নাবিহা তার নিজস্ব ভাবনাগুলোকে লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ডায়েরির প্রারম্ভটা প্রশান্তিকর হয়েছে কিনা সেটা একবার পাপাকে দিয়ে যাচাই করে নিতে চায় সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার আগে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: