শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৭ ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে কিছু মাসআলার ভুল প্রয়োগ

 প্রকাশিত: ১৭:১২, ১৮ জুন ২০২০

শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে কিছু মাসআলার ভুল প্রয়োগ

কিবলার দিক করে ইস্তেঞ্জা করানো

কিবলার দিকে মুখ করে কিংবা পিঠ করে মলমূত্র ত্যাগ করার বিষয়ে হাদীসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এতে কিবলার অসম্মান করা হয়। ফিকহবিদগণ একে মাকরূহ বলেছেন। এক্ষেত্রে একটি ভ্রান্তি এই দেখা দেয় যে, অনেকেই এ হুকুম শুধু বড়দের জন্য নির্ধারিত মনে করেন। তাই শিশুদের মলমূত্র ত্যাগ করার সময় এ বিষয়ে লক্ষ রাখেন না। আসল কথা হচ্ছে তাকে ঐভাবে ইস্তেঞ্জা করাবেন তিনি দোষী হবেন। -রদ্দুল মুহতার ১/৬৫৫

কিবলার দিকে পা করে শোয়ানো

এবিধানও শুধু বড়দের জন্য মনে করা হয়। ফলে ছোট বাচ্চাদেরকে নির্দ্বিধায় কিবলার দিকে পা দিয়ে শোয়াতে দেখা যায়। এটা ঠিক নয়। এভাবে শোয়ালে যিনি শোয়ালেন ত্রুটি তার। -রদ্দুল মুহতার ১/৬৫৫

স্বর্ণ ও মেহেদীর ব্যবহার

পুরুষের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম। আর চুল-দাড়ি ছাড়া অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মেহেদী লাগানো জায়েজ নয়। অনেকে মনে করেন, এ বিধান শুধু বড়দের জন্য। তাই নাবালেগ বাচ্চাদেরকে স্বর্ণের আংটি পরানো, মেহেদী লাগানোকে দোষের মনে করা হয় না। এধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ছেলে শিশুদের জন্যও স্বর্ণ ব্যবহার করা, মেহেদী লাগানো নিষিদ্ধ। -ফাতাওয়া শামী ৬/৩৬২

কুরআন মজীদ স্পর্শ করার ক্ষেত্রে পবিত্রতা বিষয়ে অবহেলা 

শিশুর কষ্টের দিকে লক্ষ করে হিফজ ও কুরআন-শিক্ষার্থী  শিশুদের ওযুর ব্যাপারে শিথিলতার কথা কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকে এ মাসআলার উপর ব্যাপকতার ভিত্তিতে আমল করতে গিয়ে শিশুদের পবিত্রতার বিষয়ে মোটেও গুরুত্ব দেয় না। এটা ঠিক নয়। বরং কুরআন মজীদের সম্মান ও আদবের দাবি হল, যে শিশু বুঝমান, সে বালেগ না হলেও তাকে ওযুর সাথেই কুরআন স্পর্শ করার  ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। শিশুদেরকে এব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা বড়দেরই দায়িত্ব। -জামিউ আহকামিস্সিগার ১/৩৪

অবুঝ শিশুদের মসজিদের জামাতে নিয়ে যাওয়া

আজকাল অহরহ দেখা যায়, অবুঝ শিশু- যে নামায সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না- তাকেও মসজিদের জামাতে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকে তাদেরকে নিজের সাথে কাতারে দাঁড় করাতেও দ্বিধা করে না। ফলে যা ঘটার তাই ঘটে। নামায শুরু হতে  যা  দেরী,  বাচ্চার নানাবিধ শব্দ ও কর্মকান্ড অন্য নামাযীদের খুশুখুজু নষ্ট করতে কসূর করে না। আর বাচ্চার অভিভাবকের তো নামাযই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। নামাযের মধ্যেই হয়তো বাচ্চাকে সামলাচ্ছে, তাকে ইশারায় দুষ্টুমি করতে বারণ করছে- এভাবেই তার নামায শেষ হয়।

আর খুব কম অভিভাবক তাদেরকে পিছনে রেখে আসেন। কারণ অবুঝ হওয়ার কারণে এটি যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়। হয়তো জোরে জোরে কাঁদে, নয়তো দুষ্টুমি করে অন্যদের মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। তাই এটা ঠিক নয়।

যেসকল শিশু নামাযের গুরুত্ব বুঝে না তাদেরকে মসজিদে না আনা কর্তব্য। কারণ,তাদের কারণে নিজের নামাযের খুশুখুজু তো নষ্ট হয়েই থাকে, অন্য মুসল্লীদেরও নামায নষ্ট হয়। আর এর সব গুনাহ হয় ঐ অভিভাবকের। তাই নামাযের গুরুত্ব না বুঝা পর্যন্ত শিশুদেরকে মসজিদে না নেওয়াই কর্তব্য। বাড়িতেই তাদেরকে নামায শিক্ষা দিবে। নিজেদের সাথে নামাযে দাঁড় করাবে। এরপর ৬-৭ বছর বয়স থেকে নিজেদের সাথে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস করবে। -ফাতাওয়া শামী ১/৬৫৬

শিশুদের প্রশ্রাব নিয়ে ভ্রান্তি ও বিড়ম্বনা

কেউ কেউ মনে করে যে, বাচ্চা যত দিন দুধ পান করবে ততদিন তার প্রশ্রাব নাপাক নয়। কারণ, যতদিন শুধু দুধ পান করে ততদিন বাচ্চার প্রশ্রাব বেশি দুর্গন্ধ হয় না। এধারণা ভুল। হাদীস শরীফে এধরনের শিশুর প্রশ্রাবও যে নাপাক তার বর্ণনা রয়েছে। আর প্রশ্রাব দুর্গন্ধময় হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় তা নাপাক। দুর্গন্ধ না হলে নাপাক হবে না এধারণা ভুল। -সহীহ বুখারী ১/৩৫, জামে তিরমিযী ১/২১

ছেলে-মেয়ের প্রশ্রাবের মাঝে পার্থক্য করা 

অনেকে ছেলে শিশুর প্রশ্রাবকে নাপাক মনে করে না। শুধু মেয়ে শিশুর প্রশ্রাবকে নাপাক মনে করে। এ পার্থক্য ঠিক নয়। ছেলে-মেয়ে উভয়ের প্রশ্রাবই নাপাক এবং তা পবিত্র করার নিয়মও একই। -মাআরিফুস সুনান ১/২৬৮-২৬৯; ইলাউস্ সুনান ১/৪০৯; রদ্দুল মুহতার ১/৩১৮

মেঝেতে বাচ্চার প্রশ্রাব পড়লে তার পবিত্রতার নিয়ম নিয়ে ভ্রান্তি

মেঝে যদি মাটির হয় তাহলে তা শুকিয়ে প্রশ্রাবের চিহ্ন ও দুর্গন্ধ চলে গেলে ঐ স্থান পবিত্র হয়ে যায়। কিন্তু সাধারণত ঐ স্থানকে পবিত্র করতে গিয়ে প্রয়োজনের অধিক কসরত করতে দেখা যায়।

আর মেঝে পাকা হলে প্রশ্রাব মুছে নিয়ে ভিজা কাপড় দিয়ে ভালোভাবে মেঝে মুছে দিলে এবং প্রশ্রাবের প্রভাব ও দুর্গন্ধ চলে গেলেই তা পবিত্র হয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই এক্ষেত্রেও প্রয়োজনের বেশি কসরত করতে থাকে। ঐ স্থান নতুন পানি দিয়ে মোছার পর তা শুকিয়ে গেলেও পবিত্র মনে করা হয় না। বরং তিনবার পানি ঢেলে প্রতিবার শুকনা করে না মোছা পর্যন্ত পবিত্র ধরা হয় না। ঐ স্থানে ভিজা পা পড়লে পা অপবিত্র হয়ে যাওয়ার ধারণা করা হয়। অথচ সতর্কতার বাড়তি এ কষ্টটুকু মাসআলার সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে হয়ে থাকে। প্রকাশ থাকে যে, পাকা মেঝেতে প্রশ্রাব পড়ে তা শুকিয়ে গেলে এবং প্রশ্রাবের চিহ্ন ও দুর্গন্ধ চলে গেলে মোছা ছাড়াই ঐস্থান পবিত্র হয়ে যায়। -ইবনে আবি শাইবা ১/৭৬; আদ্দুররুল মুখতার ১/৩৩২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/৪২; ফাতহুল কাদীর ১/২০৩; তাতার খনিয়া ১/৩১৬

দুধের শিশুর বমি নিয়ে ভ্রান্তি

অনেকে দুধের শিশুর বমিকে নাপাক মনে করে না। বিশেষ করে দুধ পান করার পরক্ষণে যদি বমি করে আর ঐ বমি দুর্গন্ধযুক্ত না হয় তাহলে ঐ বমিকে নাপাক মনে করা হয় না। এটা সম্পূর্ণ ভুল।

এ ব্যাপারে সঠিক মাসআলা হল, শিশুর দুধবমির হুকুম বড়দের বমির মতোই। মুখ ভরে বমি হলে সেই বমি নাপাক। চাই দুধ পানের পরক্ষণেই বমি করুক বা পরে, বমি দুর্গন্ধযুক্ত হোক বা না হোক। আর মুখ ভরে না হলে ঐ বমি নাপাক নয়। -শরহুল মুন্য়া ১২৯; আদ্দুররুল মুখতার  ১/১৩৮; রদ্দুল মুহতার ১/১৩৮; হাশিয়াতুত্হত্বাবী আলাল মারাকী ৪৯; মিনহাতুল খালেক ১/৩৪

অল্প বমিকেও নাপাক মনে করা

অনেকে শিশুর অল্প বমিকেও নাপাক মনে করে। কাপড়ে-শরীরে লাগলে তা নাপাক হয়ে গেছে, ভাবে। অথচ অল্প বমি নাপাক নয়। বমি যতই দুর্গন্ধপূর্ণ হোক না কেন। সুতরাং ঐ বমি কোনো কিছুতে লাগলে সেটি নাপাক হবে না।

-আদ্দুররুল মুখতার ১/১৪০; সিয়ায়া ১/২২১; তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৯; খানিয়া ১/২২; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১৪/৪৬; সিরাজিয়া ৫; আলমুহীতুল বুরহানী ১/৩৬২

শিশুর পোশাক নিয়ে ভ্রান্তি

তিন-চার বছর বয়সী শিশুর উপর সতরের বিষয় নেই ঠিকই, কিন্তু এজন্য প্রয়োজন ছাড়াও তাদেরকে উলঙ্গ করে রাখতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে। হাঁ, এক-দেড় বছর বয়সী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এতে তেমন একটা দোষ নেই। কিন্তু এর চেয়ে বেশি বয়সী বাচ্চার প্রয়োজন ছাড়া সতর খুলে রাখা ঠিক নয়।

আর বাচ্চার বয়স চার বা তার বেশি হলে তার সামনে ও পিছনের সতরের অংশ ঢেকে রাখা জরুরি। এ বয়সের পরও তাদেরকে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন রাখা গুনাহ।

এরপর বাচ্চার শারীরিক গড়ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে এমন বয়সে উপনীত হলে সতরসহ আশপাশের অঙ্গ যথা উরু ইত্যাদি ঢেকে রাখা জরুরি। এবয়স থেকেই বাচ্চাকে পূর্ণ পোশাক যথা পায়জামা পরানো ভালো। যেন সাত বছর থেকেই পূর্ণ পোশাকে শিশু অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর নয়-দশ বছর থেকে বাচ্চার সতর বালেগদের মতোই, একই হুকুম।

আজকাল ৬-৭ বছর বয়সী বাচ্চাদেরকে হাফপ্যান্ট পরানো হয়, যা আদৌ সমীচীন নয়। আর ৯-১০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে তো হাফপ্যান্ট পরানো নাজায়েয। -রদ্দুল মুহতার ১/৪০৭-৪০৮; ইলাউস্ সুনান ২/১৭১-১৭২

জন্মের দিন থেকেই শিশুকে পূর্ণ পোশাক পরানো

কোনো কোনো মা-বোন অধিক উত্তম মনে করে নবজাতককেও পূর্ণ পোশাক পরান। যেমন- ছেলে হলে পায়জামা, আর মেয়ে হলে ফুল হাতা জামা ও পায়জামা পরিয়ে থাকেন। আসলে এ বয়সেও এই পূর্ণ পোশাক পরিধান করানো বাচ্চার জন্য নিঃসন্দেহে কষ্টের কারণ। আর এটি বিড়ম্বনাকরও বটে। শরীয়তের কোনো দলীলে এ বয়সেই পূর্ণ পোশাক পরানো উত্তম হওয়াটা প্রমাণিত নয়। বরং শিশুর আরাম ও মায়ের কম কষ্ট উভয়টি বিবেচনায় আনলে অন্তত এবয়সে পূর্ণ পোশাক না পরানোই উত্তম বিবেচিত হয়। হাঁ, শিশুর জন্য পূর্ণ পোশাক কষ্টকর নয় এমন বয়স থেকে পূর্ণ পোশাক পরানোটা উত্তম।

শিশুর বিজাতীয় পোশাক

মনে করা হয় শিশুদের পোশাক সম্পর্কে শরীয়তের কোনো নীতিমালা নেই। যেমন ইচ্ছা পরানো যাবে। অথচ এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

বড়দের ব্যাপারে পোশাকের যে নীতিমালা, ছোটদের ক্ষেত্রেও তাই। বিজাতীয় পোশাক যেমন বড়দের জন্য নিষিদ্ধ তেমনি ছোটদের জন্যও নিষিদ্ধ। একইভাবে ছেলেদেরকে মেয়েদের পোশাক এবং মেয়েদেরকে ছেলেদের পোশাক পরানোও গুনাহ। নাবালেগ

সন্তানদেরকে এধরনের নিষিদ্ধ পোশাক পরালে এর গুনাহ হবে মা-বাবার; অথচ এর খারাপ প্রভাব তো সন্তানদের উপর পড়বেই। আজকাল মেয়েরা যেমন ছেলেদের পোশাক প্যান্ট-শার্ট পরে তদ্রূপ ছোট মেয়েদেরকেও প্যান্ট-শার্ট পরাতে দেখা যায়, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

৭  বছর  বয়স  হয়ে  যাওয়ার  পরও সন্তানের নামাযের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া

হাদীস শরীফের সুস্পষ্ট হুকুম, ‘সন্তানের বয়স সাত  হলে তাদেরকে নামাযের নির্দেশ দাও।’ -সুনানে আবু দাউদ- ৪৯৫

হাদীসের এই হুকুম থেকে বোঝা যায় যে, এ বয়সের পূর্বেই শিশুকে নামাযের প্রয়োজনীয় সূরা-কেরাত, দুআ ও নিয়ম কানুন ধীরে ধীরে শেখাতে থাকা চাই, যেন সে সাত বছর বয়সে নামাযের হুকুম পালনের যোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আফসোস! সাত বছর কেন দশ বছরেও সন্তানের নামায শুদ্ধ হওয়ার  মতো সূরা-কেরাত অধিকাংশ পরিবারে শেখানো হয় না। নামাযের নিয়ম-কানুন ইত্যাদির প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করা হয় না।

হাদীসে নেক সন্তানকে মা-বাবার জন্য সদকায়ে জারিয়া হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক মা-বাবার দুর্ভাগ্য যে, সামান্য বেখেয়ালীর কারণে তাদের সন্তান গুনাহে জারিয়ার কারণ হয়ে যাচ্ছে। মা-বাপ ছোটকালে শেখায়নি বিধায় বড় হয়ে কর্মব্যস্ততার মাঝে নামাযটাও শুদ্ধ করে পড়ার সুযোগ হয় না অনেকের। এ সব সন্তান শুধু গুনাহে জারিয়াই নয় বরং কিয়ামতের দিন নিজের দুরবস্থার জন্য আহকামুল হাকেমীনের দরবারে মা-বাবার বিরুদ্ধে আপিল করতেও ছাড়বে না। আল্লাহ তাআলা সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন।

১০ বছর বয়সী শিশুর নামায-রোযা

সন্তানের বয়স ১০ বছর হলে হাদীস শরীফে নামাযের জন্য শাসন করার কথাও এসেছে। সাত বছর থেকে নামাযের জন্য এমনভাবে গড়ে তুলবে যেন ১০ বছর বয়সে সন্তান নামাযে পূর্ণ অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফিকাহবিদগণ বলেন, ‘রোযার হুকুমও একই।’ অর্থাৎ ৭-৮ বছর বয়সী সন্তানের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে তাদেরকে ধীরে ধীরে রোযার প্রতি অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। এরপর ১০ বছর বয়সে উপনীত হলে যদি স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল না হয় তাহলে প্রয়োজনে রোযার জন্য শাস্তিও দেওয়া যাবে। -ফাতাওয়া শামী  ২/৪০৯

সাহাবায়ে কেরাম রা. তাঁদের সন্তানদেরকে রোযা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। সাহাবিয়া রুবায়্যি বিনতে মুআওয়াজ রা. বলেন, ‘আমরা নিজেরা আশুরার রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য পশমের তৈরি খেলনা রাখতাম। যখন বাচ্চাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদত তখন তাকে খেলনা দিতাম, এভাবে ইফতারের সময় হয়ে যেত।’ -সহীহ বুখারী ১/২৬৩

নাবালেগ শিশুর সওয়াব-গুনাহের তোয়াক্কা না করা

সওয়াব-গুনাহের হিসাব-নিকাশ যেহেতু বালেগ হওয়ার পর থেকে শুরু হয় তাই অনেককেই নাবালেগ ছেলে-মেয়েদের বেলায় সওয়াবের বিষয়ে অগ্রসর হতে দেখা যায় না। তাদের দ্বারা গুনাহের কাজ হতে দেখলেও বারণ করতে দেখা যায় না। অথচ বালেগ হওয়ার পূর্বে হিসাব-নিকাশ না হওয়ার অর্থ কখনো এই নয় যে, তারা যত ইচ্ছা গুনাহের কাজ করুক তাতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং বড়দের সামনে  নাবালেগ সন্তান গুনাহের কাজ করলে তাদেরকেও বাধা দেওয়া জরুরি। অন্যথায় এর ভাগী হবে বড়রা। যেমনিভাবে এসব সন্তান সওয়াবের কাজ করলে এর সওয়াব পেয়ে থাকেন সন্তানের অভিভাবকগণ। এছাড়া সন্তান শৈশবে গুনাহের কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে বালেগ হওয়ার পরও তা চলতে থাকবে।

বুঝমান বাচ্চাকে নামাযের কাতারে দাঁড়াতে না দেওয়া

অনেকে মনে করে, বড়দের সাথে নাবালেগ ছেলে দাঁড়ালে বড়দের নামায মাকরূহ হয়ে যায়। এ ধারণা ভুল। এ ধারণার ভিত্তিতে বুঝমান নাবালেগ ছেলেকে বড়দের কাতার থেকে পিছনে ঠেলে দিতে দেখা যায়। এতে একে তো ভুল ধারণার উপর আমল করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত এ কারণে বাচ্চাদের মন ছোট হয়ে যায়। তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়। আবার অনেকে এ ধরনের বাচ্চাদেরকে পিছনে ঠেলে না দিলেও বড়দের কাতারের এক কোণে ঠেলে দেয়। এটাও নিষ্প্রয়োজন। বরং এর কারণে তারা দুষ্টুমির সুযোগ পেয়ে যায়।

এ ক্ষেত্রে জানা প্রয়োজন হল-

১। নামাযের জ্ঞান রাখে এবং যথানিয়মে নামায আদায়ে সক্ষম এমন নাবালেগ ছেলের বড়দের কাতারে দাঁড়ানো মাকরূহ নয়। এ কারণে বড়দের নামাযের কোনো ক্ষতিও হয় না। বরং এ ধরনের ছেলে একা হলে তাকে বড়দের সাথে দাড় করানোই নিয়ম। একা পিছনের কাতারে দাঁড় করানো মাকরূহ। হাদীস ও সাহাবীদের আমল দ্বারা এমনটিই প্রমাণিত। ফিকহের কিতাবাদিতেও এমনই উল্লেখ রয়েছে।

-সহীহ বুখারী ১/১০১, আলবাহরুর রায়েক ১/৩৫৩, তাহতাবী আলাল মারাকী ১৬৮

২। বুঝমান নাবালেগ ছেলের সংখ্যা বেশি হলে এবং তাদেরকে পিছনের এক কাতারে কিংবা বড়দের একপার্শ্বে দাঁড় করালে যদি তারা দুষ্টুমি না করে বা বড়দের নামাযে বিঘ্ন ঘটানোর মতো কোনো কাজ করার আশঙ্কা না থাকে তবে তাদেরকে বড়দের কাতারের একপার্শ্বে কিংবা পিছনের কাতারে দাঁড় করানো ভালো। হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী বড় ও বিজ্ঞজনদের জন্য ইমামের কাছাকাছি দাঁড়ানো ভালো। অবশ্য বুঝমান নাবালেগ ছেলে বেশি হলে তখন তাদেরকে পিছনের কাতারে দাঁড় না করিয়ে বড়দের সাথে দাঁড় করালেও কারো নামাযের ক্ষতি হবে না। বরং কোনো কোনো ফকীহ নাবালেগ ছেলে অধিক হলেও বড়দের সাথে দাঁড় করানোর পরামর্শ দেন। কারণ বাচ্চারা একাকি দাঁড়ালে তাদের দুষ্টুমির কারণে বড়দের নামাযে স্বভাবতই বিঘ্ন ঘটে থাকে, যা বড়দের মাঝে দাঁড়ালে হয় না।

-আততাহরীরুল মুখতার ১/৭৩, ইলাউস সুনান ৪/২৫৬, তুহফাতুল মুহতাজ ৩/১০৬-১০৭, আলমুগনী ইবনে কুদামাহ ২/৫৭

নাবালেগের আযান-ইকামত

আযান-ইকামত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। নাবালেগ ছেলে নামায-আযানের জ্ঞান রাখলে এবং সহীহ শুদ্ধভাবে আযান দিতে পারলে তার আযান-ইকামত যদিও সহীহ গণ্য হয়, কিন্তু শরীয়তের দৃষ্টিতে এ গুরুত্বপূর্ণ বিধান আঞ্জাম দেওয়ার অধিক উপযোগী হল বালেগ পুরুষ। তাই তাদের উপস্থিতিতে নাবালেগ ছেলেদের দ্বারা আযান-ইকামত দেওয়ানো ঠিক নয়।

-সুনানে ইবনে মাজাহ ১৮৭, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ১/২৫৬, মাবসূতে সারাখসী ১/১৩৮, ফাতহুল কাদীর ১/২৫১, বাদায়েউস সানায়ে ১/১৫০

নাবালেগের পিছনে তারাবীহ নামায

নাবালেগের পিছনে বালেগের ইক্তিদা সহীহ নয়। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে অনেক মসজিদে এবং ঘরে-বাড়িতে নাবালেগ হাফেজের পিছনে তারাবীর নামায পড়া হয়। এতে বালেগদের তারাবীহ আদায় হয় না।

অনেকে মনে করে, নাবালেগ হাফেজ বালেগ পুরুষদের ইমামতি না করতে পারলেও মহিলাদের ইমামতি করতে পারবে। তাই বাসা-বাড়িতে নাবালেগ হাফেজদেরকে নিয়ে তাদের পিছনে মহিলারা জামাত করে তারাবীহ পড়ে; অথচ নাবালেগের পিছনে বালেগদের ইক্তিদা সহীহ নয়। চাই বালেগ পুরুষ হোক বা মহিলা উভয়ের একই হুকুম।

-নাইলুল আওতার ১/২০১, মুসান্নাফ আব্দিররাজ্জাক ২/৩৯৮, শরহুল মুনয়া ৪০৮, বাদায়েউস সানায়ে ১/৩৫৯, রদ্দুল মুহতার ১/৫৭৭, জামিউ আহকামিস সিগার ১/৩৯

১০ বছর থেকে বালেগ হওয়ার নিকটবর্তী বয়স পর্যন্ত কিছু ভুল আমল বিছানা পৃথক না করা

সন্তানের বয়স ১০ বছর হয়ে গেলে তার শোয়ার জায়গা পৃথক করার ব্যাপারে হাদীস শরীফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এ বয়সের আগ থেকেই পৃথক শোয়ানোর জন্য বাচ্চাকে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। যেন দশম বছরে পদার্পণ করলেই এ হুকুমের উপর পরিপূর্ণ আমল করা যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হল, শরীয়তের এ হুকুমটির ব্যাপারে অনেকেই ভ্রুক্ষেপ করে না। দশ বছরেরও বেশি বয়সী ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার সাথেই ঘুমায়। কোনো মা-বাবা তাদের সাথে নিজেদের বিছানা পৃথক করলেও ছেলেমেয়েদেরকে একত্রেই শোয়ায়। তাদের প্রত্যেকের ঘুমানোর ব্যবস্থা পৃথক করে না।

-সুনানে আবু দাউদ ৪৯৫-৪৯৬, সুনানে বাইহাকী ৭/৯৪, ফাতাওয়া শামী ৬/৩৮২

ছেলেদের বালেগ হওয়ার সময় এবং পর্দার ব্যাপারে ভ্রান্তি

‘১৫ বছর বয়সে ছেলেরা বালেগ হয়’ এই একটা অস্পষ্ট কথার উপর ভিত্তি করে আজকাল অনেক পর্দানশীন পরিবারেও এর কম বয়সী ছেলেদের সাথে পর্দা করার কথা চিন্তাই করা হয় না। যদিও সে বাস্তবে বালেগ হোক না কেন। ১৫ বছরের আগে স্বপ্নদোষ হলে কিংবা নাভির নিচের পশম হলে অথবা বীর্য নির্গত হলে যে কোনো বালক বালেগ হয়ে যায়। কিন্তু যে ছেলের এসব নিদর্শনের কোনোটি প্রকাশ পায়নি তার বয়স ১৫ হলে তাকে বালেগ ধরে নেওয়া হবে। সুতরাং প্রতীয়মান হল যে, ১৫ বছর বয়স হওয়া বালেগ হওয়ার জন্য একটি নিদর্শন। এর পূর্বে অন্যান্য নিদর্শনাবলীর কোনোটি প্রকাশ পেলে সে-ও বালেগ। যদিও তার বয়স ১৩ বা ১৪ হোক না কেন।

-রদ্দুল মুহতার ৬/১৫৩-১৫৪, আলবাহরুর রায়েক ৮/৮৫, তাবয়ীনুল হাকায়েক ৫/২০৩

মেয়েদের বালেগ হওয়ার সময় নিয়ে ভ্রান্তি

সমাজে প্রচলন রয়েছে যে, মেয়েরা বালেগ হয় স্রাব চালু হলে। এটাকেই একমাত্র মাপকাঠি ধরা হয়। অথচ এটি নিদর্শনাবলীর একটি। এই নিদর্শন প্রকাশ না পেলে ১৫ বছর বয়স হলেই বালেগ ধরা হবে। চাই স্রাব চালু হোক বা না হোক।  (প্রাগুক্ত)

মেয়েদের পর্দার বয়স

এক্ষেত্রে প্রথম ভুল হল, প্রচলন অনুযায়ী পর্দার সময় স্রাব চালু হওয়াকেই ধরে নেওয়া হয়। এর আগে পর পুরুষের সামনে বে-পর্দা হওয়াকে গুনাহ মনে করা হয় না। অথচ মেয়েরা পরিপূর্ণ বালেগ হওয়ার আগে যখন শরীরের বাহ্যিক দিকগুলো বালেগদের মত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তখন থেকেই তাদের উপর পর্দা করা জরুরি হয়ে যায়। এ পর্যায়ে পর্দার বিধানটা গুনাহ ও ফেতনা থেকে মুক্ত থাকার জন্যে। ফিকাহবিদগণ নয় বছর বয়স থেকেই শরীরের গড়ন অনুযায়ী এ হুকুম আরোপিত হতে পারে বলে মত ব্যক্ত করেছেন।

বয়োসন্ধির নিকটবর্তী ছেলেদের সাথে পর্দার শিথিলতা

অনেক পরিবারে ছেলেরা পূর্ণ বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের সাথে পর্দা তো নয়ই, এমনকি ঢেকে টেকে থাকারও প্রয়োজন অনুভব করা হয় না। অথচ কুরআন মজীদে সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে পর্দার হুকুম থেকে মুক্ত ব্যক্তিদের আলোচনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং  তারা  যেন  তাদের  স্বামী,  পিতা, সন্তান, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।’ (সূরা নূর ৩১)

উক্ত আয়াতে সর্বশেষে দ্বাদশ নম্বরে এ সকল অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালককে বোঝানো হয়েছে যারা এখনো সাবালকত্বের নিকটবর্তী হয়নি এবং নারীদের বিশেষ আকর্ষণ, কমনীয়তা ও গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বে-খবর, তাদেরকে পর্দার হুকুমের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে যে বালক নারীদের এসব অবস্থা সম্পর্কে সচেতন তার কাছে নারীদের পর্দা করা ওয়াজিব। যদিও এসব বালকের উপর পর্দা ফরয নয়, কিন্তু নারীদের জন্য এদের সাথে পর্দা করে চলা জরুরি। ফিকাহবিদগণ বালকের এ হুকুম অবস্থাভেদে ১০ বছর থেকে শুরু হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং বালেগ হয়নি কিংবা পনের বছর হয়নি বলেই এ বয়সের ছেলেদেরকে গায়রে মাহরাম মহিলাদের ভিতর যেতে দেওয়া অন্যায়। তদ্রূপ মহিলাদের জন্যও এ বয়সের ছেলেদের সামনে বেপর্দা চলাফেরা করা গুনাহ।

-মাআরিফুল কুরআন ৬/৪০৫, তাফসীরে কুরতুবী ১২/১৫৭, তাফসীরে মাজহারী ৬/৫০১, আল মুফাস্সাল ফী আহকামিন নিসা ৩/১৭৬-১৭৭, আহসানুল ফাতাওয়া ৩৬-৪০

স্রাবের হুকুম না জানানো

স্রাব মহিলাদের শারীরিক একটি বিষয়। যার সম্মুখীন হতেই হয়। কিন্তু লজ্জায় হোক বা অন্য কোনো কারণে অধিকাংশ মেয়েকেই এ সম্পর্কে যথাযথ হুকুম জানানো হয় না। শুধু এতটুকু জেনেই ক্ষান্ত হয়ে যায় যে, এ অবস্থায় নামায পড়া যায় না। কিন্তু কতদিন হলে কীভাবে হলে কী করণীয়? এ সময়ের নিষিদ্ধ কাজ কী কী ইত্যাদি বিষয়ে তারা অনবগতই থেকে যায়। ফলে শত শত মহিলা এমন আছে যারা ১৫-২০ দিন স্রাব আসলেও নামায-রোযা করে না। এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য আহকামও জানে না। এভাবে কত নামায-রোযা যে অনাদায়ী থেকে যায় তা ভাবাই যায় না। মা-বাবার কর্তব্য হল, মেয়ে এ অবস্থায় উপনীত হওয়ার পূর্বেই এ সম্পর্কিত মাসআলার সহীহ জ্ঞান দেওয়া বা এর ব্যবস্থা করা।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: