শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

শরীয়া আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে এমন জঘন্য ঘটনা বারবার ঘটবে না

 প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৯ অক্টোবর ২০২০

শরীয়া আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে এমন জঘন্য ঘটনা বারবার ঘটবে না

সারাদেশে একের পর এক ভয়াবহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। নরপশুদের হাত রেহাই পাচ্ছে না শিশু, গৃহবধূ, বয়োবৃদ্ধা কেউই। গোটা দেশের মানুষ এখন চরম আতঙ্কিত, ক্ষুব্ধ এবং ন্যায়বিচারের জন্য ফুঁসে উঠেছে। নোয়াখালী, সিলেট, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, পিরোজপুর, লক্ষীপুর, গাজিপুর, নারায়াণগঞ্জ, রাজশাহীসহ সারাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক ও সর্বস্তরের জনগণ দফায় দফায় রাজপথে বিক্ষোভ করে চলেছেন।

ধর্ষকের দ্রুত কঠিন বিচার না হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে, ধর্ষকরা আরো হিংস্র হয়ে ওঠছে। বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে ঘরে-বাইরে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়- এটাই এখন সকলের মনের কথা। এমনকি ন্যায্য বিচার না করার কারণে সরকারের পদত্যাগের দাবিও তুলছে বিএনপিসহ  প্রভাশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
এই মুহূর্তে দেশের অনেক পরিচিত রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরাও ধর্ষকদের শাস্তি প্রকাশ্যে ফাঁসি, ক্রসফায়ার, ও অঙ্গ কেটে দেওয়ার দাবি তুলছেন। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করা হচ্ছে।’

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ইসলাম টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, উচ্চতর ইসলামি আইন গবেষণা ও দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার পরিচালক মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ। তিনি বলেন,স্বভাবধর্ম ইসলামে চৌদ্দশ বছর আগেই ধর্ষকের কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।দেশে ইসলামি আইনের শাসন থাকলে আজকে নারী ধর্ষণের শাস্তির জন্য মানুষকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে হতো না।

ইসলাম বিদ্বেষীদের মুখে এখন ‘ক্রসফায়ার ও ফাঁসির’ দাবি
দেশের শীর্ষ এ আলেমে দ্বীন বলেন, ‘আজকে এতদিন পর যারা ধর্ষকের প্রকাশ্যে ফাঁসি ও ক্রসফায়ার দেওয়ার দাবি তুলছেন, সোশাল মিডিয়ায় বিবৃতি দিচ্ছেন, লেখালেখি করছেন, এমনকি মাতৃজাতি নারীকে পণ্যে পরিণত করা গোষ্ঠীটির লোকেরাও ধর্ষকের মৃতুদণ্ড দাবি করছে, তারাই কিন্তু এতদিন ইসলামে ধর্ষণের মৃতুদণ্ডের শাস্তির বিধানকে ‘বর্বর ও অমানবিক’ বলে কটাক্ষ করেছিল।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দেশবাসীর কাছে, সচেতন নাগরিক ও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলব, আপনারা এ লোকদের কথাগুলোকে লিখে রাখুন। রেকর্ড করে রাখুন। ভবিষ্যতে যাতে ইসলামের শাস্তিকে অমানবিক বলার সময় তাদেরকে আয়নায় মুখ দেখানো যায়।’
মুফতী আবুল হাসান আবদুল্লাহ বলেন, ‘ইসলাম যে মানুষের স্বভাবধর্ম, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা আবারও সামনে এলো। এ ধরনের চরম মূহূর্তগুলোতে মানুষের হৃদয়ের যে স্বতঃস্ফূর্ত দাবি, সেটাকেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামের বিধান করে দিয়েছেন তার পবিত্র কালামে।’
‘শুধু ধর্ষণ নয়, যুক্ত হবে ফাসাদ ফিলআরদের শাস্তি’

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে যাওয়া স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে ছাত্রাবাসে নিয়ে সরকারদলীয় ছাত্রলীগ কর্মীদের পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। জাতীয় পর্যায়ের একটি বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এমন গর্হিত ঘটনাকে দেশে লাগামহীন বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে- তারই এক ভয়ংকর নমুনা বলে উল্লেখ করেন বিশিষ্টজনেরা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আরেক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানী ও নির্যাতন করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে গোটা দেশ।

ইসলামে এ ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধান কী- এমন প্রশ্নের উত্তরে মুফতী আবুল হাসান আবদুল্লাহ বলেন, ‘এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, অনেকে স্বেচ্ছায়-ব্যভিচার আর জোরপূর্বক ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায়, ইসলামী আইনে স্বেচ্ছায় ও জোরপূর্বক ব্যভিচার দুটিই জঘন্য অপরাধ। অবশ্য ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষিতা শাস্তি পাবে না, শাস্তি পাবে শুধু ধর্ষক। এছাড়া ব্যভিচার ও ধর্ষণের  শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি হলো বিবাহিতের ক্ষেত্রে পাথর মেরে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড, আর অবিবাহিতের ক্ষেত্রে একশ বেত্রাঘাত। কিন্তু দেশের চলমান ঘটনাবলির ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে শুধু যে ধর্ষণের শাস্তি প্রযোজ্য হবে তা নয়, বরং যুক্ত হবে ফাসাদ ফিলআরদ তথা সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির শাস্তি। কোরআনে কারীমে পরিষ্কার উল্লেখ আছে, যারা পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে তাদের শাস্তি হলো, মৃত্যুদণ্ড, শূলে চড়িয়ে হত্যা, একহাত-এক পা কেটে ফেলা এবং দেশান্তর করে দেওয়া।’ (দেখুন সূরা মায়েদা, আয়াত ৩৩)

‘ফাসাদ ফিল আরদ’ বা সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি
চলমান নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোতে ইসলামী আইনে ধর্ষণের শাস্তির সঙ্গে কীভাবে কোরআনে বর্ণিত ফাসাদ ফিল আরদ তথা জমিনে বিশৃংখলার শাস্তি প্রযোজ্য হবে- এ প্রসঙ্গে এ বিশিষ্ট মুফতী বলেন, ‘আপনি আলোচিত সিলেটের ঘটনা বলুন আর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর বা সাভারের ঘটনা- সবগুলোতে ধর্ষণের চেয়েও মারাত্মকভাবে জমিনে অশান্তি সৃষ্টির বিষয়টি প্রকটভাবে বিদ্যমান। জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া, স্বামীকে বেঁধে রাখা, ধর্ষণের পর খুন করার ভয় দেখানো, ভিডিও করা-ছড়িয়ে দেওয়া, ব্ল্যাকমিল করে একাধিকবার ধর্ষণ করা, দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে শ্লীলতাহানি করা, মারধর- এসবই পরিষ্কার ফাসাদ ফিলআরদ। ফলে যদি কোনো কারণে ধর্ষণের ইসলামী আইন কার্যকর করা নাও যায়, তবুও ফাসাদ ফিল আরদের আইনে অপরাধীদের ওপর মৃত্যুদণ্ড, দেশান্তর এবং এক হাত-এক পা কেটে দেওয়ার শাস্তির বিধান প্রযোজ্য হবে।’
‘আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি, শরীয়া আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে এমন জঘন্য ঘটনা বারবার ঘটবে না’

এমন দিন সম্ভবত কমই আছে, যেদিন পত্র-পত্রিকায় ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয় না। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরইমধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৪১ জন। সেই হিসেবে চলতি বছর প্রতিমাসে গড়ে ১১১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এগুলো তো হচ্ছে পত্র-পত্রিকার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরিকৃত পরিসংখ্যান-প্রতিবেদন। প্রকৃত হিসাব করা হলে যে পরিসংখ্যান আরো ভয়াবহ হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দেশে নানান ইস্যুতে সরকার আইন সংশোধন করে,জননিরাপত্তা আইন করে,বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে, কিন্তু ধর্ষণের মতো হিংসাত্মক অপরাধের বিরুদ্ধে কেন সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করে ট্রাইবুনাল গঠন করা হয় না? কেন বিচারের দাবিতে আন্দোলন করতে হয় বারবার? চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে আমরা লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদেরকে পুলিশ বাধা দিয়েছে। তাদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয়েছে।  এর কারণ কী? প্রশাসন কি ধর্ষকদের সমর্থন করছে তাহলে?’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, আন্দোলন করার দরকার নেই, সরকার বিচার করবে। খুবই আশ্চর্যর কথা, ধর্ষকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও আন্দোলন করলে সরকারের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ কী? মানুষের ক্ষোভকে সমর্থন হিসেবে না দেখে কেন নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে? এতে তো অপরাধীরা যে ভয়টা পাচ্ছে, সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ তো সরকার বিরোধী আন্দোলন করছে না, মানুষ ধর্ষক বিরোধী আন্দোলন করছে। যত বিক্ষোভ বাড়বে, তত অপরাধীদের মনোবল কমবে, তারা আতঙ্কিত থাকবে। তা না করে আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করা হচ্ছে কেন?’
মুফতী আবুল হাসান আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি, শরীয়া আইনে ধর্ষকের একটি মাত্র বিচার করুন। ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড বা একশ বেত্রাঘাতের শাস্তি প্রয়োগ করুন। সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির শাস্তি হিসেবে একবার হলেও অপরাধীর একহাত একপা কেটে দিন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করুন। আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি, ছয়মাসের মধ্যে দেশে ধর্ষণের হার আশিভাগ কমে যাবে।’

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বৃহত্তর বিক্ষোভ ও কর্মসূচি দেওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইসলামে মাতৃজাতির সম্মান ও অধিকারের স্বপক্ষে যদি হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দল ও ব্যক্তিত্বগণ ব্যাপক সচেতনতা ও জনমত গড়ে তুলতে চান, তাহলে তারা চাইলেই লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত করতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘এটা জরুরি নয় যে, রাজধানীতে এধরনের জমায়েত করতে হবে, বরং তারা চাইলে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে বড় বড় সমাবেশ করতে পারেন। দেশে যখন ইসলাম বিরোধী নারীনীতি আইন করা হয়, তখন যেমন আমরা আন্দোলন করি, তেমনি মাতৃজাতিকে অসম্মান করার এ ধরনের পরিস্থিতিতেও আমাদের আরো সোচ্চার হওয়া উচিত। এটা এখন সময়ের প্রয়োজন। আমরা এর প্রতি দেশের বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- যোগ করেন তিনি।

​​​​​​

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: