শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

শত্রুর সাথে যেমন ছিল প্রিয় নবী সাঃ এর আচরণ

 প্রকাশিত: ১১:০০, ১৪ জুলাই ২০২১

শত্রুর সাথে যেমন ছিল প্রিয় নবী সাঃ এর আচরণ

বর্তমানে ইসলামকে সংঘাত ও সহিংসতার ধর্ম বলে প্রচার করা হয়। অভিযোগ করা হয়, ইসলাম তার অনুসারীদের সংঘাত ও সহিংস হতে উৎসাহী করেছে। 

শত্রুর সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) আমাদের আদর্শ। তার বিশ্বাসের কারণে তিনি প্রচন্ড প্রতিকূলতা ও  নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এমনকি তার শত্রুরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলো এবং তাকে খুন  করার চেষ্টাও করে ছিলো, কিন্তু আল্লাহর রাসূল তাদের শত্রুতার জবাব দিয়েছিলেন দয়া ও সৌন্দর্যের সাথে। 

সবসময় তিনি তার শত্রুদের জন্য প্রার্থনা করতেন। তিনি কামনা করতেন, যেনো তারাও আল্লাহর হেদায়েত অর্জন করতে পারে। তারা ক্ষতিগ্রস্থ বা অভিযুক্ত হোক এটি তিনি কখনোই চাইতেননা। তার লক্ষ্য ছিলো ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতেই ইসলামের মাধ্যমে সকল মানুষের কল্যাণ করা।  

একবার রাসূল(সা.) এর সাহাবারা তার শত্রুদের দ্বারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে তারা রাসূল (সা.) এর কাছে আবেদন জানান,

 ‘হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।’ কিন্তু রাসূল(সা.) উত্তর দিলেন, ‘আমি অভিশাপ দেওয়ার জন্য আসিনি, বরং আমি এসেছি ক্ষমা প্রার্থনার জন্য।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৯৯) 

অপর একসময় সাহাবারা রাসূল(সা.) এর বিরোধিতাকারী দাউস নামের এক গোত্রের ধ্বংস কামনা করে বলছিলেন,

‘আল্লাহ যেনো দাউস গোত্রকে ধ্বংস করে ছাড়েন।’ কিন্তু আল্লাহর রাসূল(সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! দাউস গোত্রকে হেদায়েতের পথ দেখাও এবং আমার নিকটে নিয়ে আসো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪১৩১) 

হুনায়েনের যুদ্ধে রাসূলের সাহাবারা রাসূল (সা.) এর কাছে আবেদন জানান,

 ‘হে আল্লাহর রাসূল! সাকীফ গোত্রের তীর আমাদের ছিন্নভিন্ন করেছে। তাদের ধ্বংসের জন্য দোয়া করুন।’ কিন্তু আল্লাহর রাসূল(সা.) দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! সাকীফ গোত্রকে হেদায়েত কর।’ (সূনান তিরমিযী, হাদীস নং ৩৯৪২)

উহুদ যুদ্ধের সময় শত্রুদের দ্বারা রাসূল (সা.) নিজেও আহত হয়েছিলেন এবং তার চেহারা হতে রক্ত ঝড়ছিলো। এই অবস্থায়ও রাসূল(সা.) তাদের জন্য দোয়া করলেন,

 ‘হে আমার মালিক! আমার লোকদের ক্ষমা কর। তারা জানেনা যে, তারা কী করছে।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং ৯৮৫) 

রাসূল(সা.) তার শত্রুদের জন্য আল্লাহর কাছে শুধু ক্ষমা প্রার্থনাই করতেন না, বরং তিনি তাদের জন্য কৈফিয়তও প্রকাশ করতেন। 

ইসলামে যুদ্ধের উদ্ধেশ্য এটি নয় যে, মানুষকে জোর করে মুসলমান বানাতে হবে। ইসলামে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। রাসূল(সা.) যুদ্ধের সময় একটি সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে চলতেন।  

যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) এর নির্দেশনা ছিলো, কোনো্ নারী, শিশু, ধর্মীয় পাদ্রী/পুরোহিত, শ্রমিক, যুদ্ধ হতে বিরত সাধারন মানুষ এবং আত্মসমর্পণকারী সৈনিকদের হত্যা না করার। 

একইসাথে তিনি অন্য ধর্মের লোকদের গির্জা, মন্দির বা সম্পত্তির ধ্বংস করতে নিষেধ করেছেন। যুদ্ধের মধ্যে দুর্ঘটনায়ও যাতে কোনো প্রাণীসম্পদের ধ্বংস না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধ বা শান্তিকালীন কোনো সময়ই কাউকে জোর করে মুসলমান বানাতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন। 

যুদ্ধবন্দীদের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাসূল(সা.) এর আচরণ ছিলো কুরআন হতে উৎসারিত। কুরআনের সূরা ইনসানের আট নং আয়াতে সেই মুসলমানদের প্রশংসা করা হয়েছে যারা নিজেদের পূর্বে যুদ্ধবন্দীদের খাদ্য সহ প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করেছে। রাসূল(সা.) যুদ্ধবন্দীদের সাথে উত্তম ব্যবহারের জন্য কঠোরভাবে আদেশ প্রদান করেছেন।  

বদর যুদ্ধের একজন বন্দী আবু আজিজ ইবনে উমায়ের থেকে জানা যায়, তিনি যখন বদর যুদ্ধে বন্দী হয়ে এসেছিলেন, তখন মদীনার নাগরিকরা নিজেরা না খেয়ে তাদের জন্য রুটির ব্যবস্থা করেছিলেন। এই আচরণই তাকে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম গ্রহণে। (মু’যাম আল কবীর) 

অপর একটি বর্ণনা হতে জানা যায়, রাসূল(সা.) বলেছেন,

‘যেই মুসলিম তার বন্দীর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৩২) 

ক্ষতির কোনো আশংকা না থাকলে রাসূল(সা.) সাধারনভাবে যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দিতে উৎসাহ প্রদান করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৫৮) 

প্রকৃতপক্ষে ইসলামের ইতিহাস হচ্ছে দয়া, ক্ষমা এবং পরিত্রাণের। রাসূল(সা.) দীর্ঘ তেরো বছর মক্কায় শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রচার করেছিলেন। তিনি তখনই মদীনায় হিজরত করেন যখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূলে চলে গিয়েছিলো। এরপর ক্রমাগত দশ বছর মদীনায় মুসলমানরা মক্কার আক্রমণ প্রতিহত করে একতা ও বিশ্বাসের বলে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল(সা.) তার সেই শত্রুদের উপর ক্ষমতার অধিকারী হন, যারা দীর্ঘ তেইশ বছর বিভিন্নবাবে তাকে কষ্ট দিয়েছে, এমনকি তার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। রাসূল (সা.) ইচ্ছা করলে এইসময় তার সকল প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সকলের জন্য সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করলেন। (তারিখ দিমাশক) 

মক্কা বিজয়ের দিন কোনো প্রকার প্রতিশোধ না নিয়েই রাসূল (সা.) তার শত্রুদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এটিই শত্রুর সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান। ধৈর্য, ক্ষমা এবং দয়ার মধ্য দিয়েই শত্রুকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: