লায়লাতুল কদর: অফুরন্ত কল্যাণ লাভের রজনী
প্রকাশিত: ১০:৩৫, ৪ মে ২০২১
পবিত্র লায়লাতুল কদর মহিমান্বিত একটি রজনী। কদরের রাতে অজস্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। সারা রমজান ধন্য রামাযানের আগমনে। আর রামাযান ধন্য লায়লাতুল ক্বদরের অবদানে। এই রাত্রির মধ্যে রয়েছে এমন এক সুপ্ত সফলতা, যা ৮৩ বছর ৪ মাসের চেয়েও উত্তম সফলতা (আল-ক্বদর, ৯৭/৩)
হতভাগ্য মানুষেরা এই রাতে ঘুমিয়ে যায়। অথচ শান্তির বার্তা নিয়ে ফজর পর্যন্ত ফেরেশতাকুলকে সাথে নিয়ে জিবরীল আমীন জেগে রয় (আল-ক্বদর, ৯৭/৪-৫) কেউ যদি এ রাতে জেগে থাকে, কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চায়, যদি আল্লাহর ভয়ে সিজদায় পড়ে রয়; তাহলে সেই এক রাতের ইবাদতে ৮৩ বছর ৪ মাসেরও বেশি হায়াতে সমৃদ্ধ হয়ে যায়। জীবনের পবিত্র প্রবৃদ্ধি এর থেকে বেশি আর কীইবা হতে পারে? এজন্যই রামাযানের শেষ দশক আসলে ইবাদত করার জন্য রাসূল সাঃ জোরালো প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন, সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারকেও জাগিয়ে দিতেন (বুখারী, হা/২০২৪; মিশকাত, হা/২০৯০)
লায়লাতুল কদর অর্থ :
১ – কদরের এক অর্থ সম্মান। ইরশাদ হয়েছে : (وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦٓ ) {আর তারা আল্লাহকে যথার্থ সম্মান দেয়নি}[ সূরা আল আনআম:৯১] সে হিসেবে লায়লাতুল কদর অর্থ হবে সম্মানিত রাত; কেননা এ রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, এ রাতে ফেরেশতাগণ নেমে আসেন এবং এ রাতে রবকত-রহমত-মাগফিরাত নাযিল হয়।
২ – কদরের আরেক অর্থ সংকীর্ণকরণ, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: (وَمَن قُدِرَ عَلَيۡهِ رِزۡقُهُۥ فَلۡيُنفِقۡ مِمَّآ ءَاتَىٰهُ ٱللَّهُۚ ) {আর যার রিয্ক সংকীর্ণ করা হয়েছে সে যেন আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা হতে ব্যয় করে।} [ সূরা আত-তালাক:৭] লায়লাতুল কদরের ক্ষেত্রে সংকীর্ণকরণের অর্থ হবে লায়লাতুল কদর সংঘটিত হওয়ার সুনির্দিষ্ট তারিখ গোপন করে রাখা।
শানে নুযূলঃ ইবনে আবী হাতেম (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে আছে রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) একবার বনী-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলাচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জেহাদে মশগুল থাকে এবং কখনও অস্ত্র সংবরন করেনি। মুসলমানগন একথা শুনে বিস্মিত হলে এ সূরা কদর অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্যে শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের এবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইবনে জরীর (রহঃ) অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনী-ইসরাঈলের জনৈক এবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত্রি এবাদতের মশগুল থাকত ও সকাল হতেই জেহাদের জন্যে বের হয়ে যেত এবং সারাদিন জেহাদে লিপ্ত থাকত। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ তায়ালা সুরা-কদর নাযিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করেছেন। এ থেকে আরও প্রতীয়মান হয় যে, শবে-কদর উম্মতে মুহাম্মদীরই বৈশিষ্ট্য। - (মাযহারী)
লায়লাতুল কদরের ফজিলত ও মর্যাদা
১- লায়লাতুল কদরেই পবিত্র কুরআন নাযিল করা হয়েছে আল্লাহ তাআলা বলেন : (إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ) {নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে।}[ সূরা আল কাদ্র:১]
২ – লায়লাতুল কদর হাজার মাস থেকেও উত্তম আল্লাহ তাআলা বলেন: (لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ) {লায়লাতুল কদর এক হাজার মাস থেকে উত্তম} [সূরা আল-কাদ্র:৩] অর্থাৎ লায়লাতুল কদরে আমল করা লায়লাতুল কদরের বাইরে এক হাজার মাস আমল করার চেয়েও উত্তম।
৩- লায়লাতুল কদরে ফেরেশতা ও জিব্রীল এর অবতরণ আল্লাহ তাআলা বলেন: (تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ) {সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রীল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে।}[ সূরা আল কাদ্র:৪] আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘লায়লাতুল কদর হলো সাতাশ তারিখ অথবা ঊনত্রিশ তারিখের রাত, আর ফেরেশতাগণ এ রাতে পৃথিবীতে কঙ্করের সংখ্যা থেকেও বেশি থাকেন।
৪ – লায়লাতুল কদর হলো শান্তির রাত আল্লাহ তাআলা বলেন : (سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ) {শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।}[ সূরা আল কাদ্র:৫] অর্থাৎ লায়লাতুল কদরের পুরোটাই ভালো, এর শুরু থেকে সুবেহ সাদেক পর্যন্ত আদৌ কোনো অনুত্তম বিষয় নেই।
৫- লায়লাতুল কদর মুবারক রাত আল্লাহ তাআলা বলেন: (إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ ) {নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।} [ সূরা আদ-দুখান:৩] উক্ত আয়াতে ‘লায়লাতুম্ মুবারাকা’- এর অর্থ ইবনে আব্বাস রাযি. এর নিকট ‘লায়লাতুল কদর।
৬ – এ রাতে এক বছরের সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: (فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ) {সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।} [ সূরা আদ-দুখান:৪]
৭ – যে ব্যক্তি ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় লায়লাতুল কদর যাপন করবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ছাওয়াবপ্রাপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় লায়লাতুল কদর যাপন করল, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হলো।’(বর্ণনায় ইবনে খুযায়মাহ)
কোন রাত লায়লাতুল কদর?
আল্লাহ তাআলা এ রাতকে গোপন করে রেখেছেন, যাতে মুসলিম ব্যক্তি রমজানের শেষ দশদিনে অধিক শ্রম ব্যয় করে, বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোয়। আর সেগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাত। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশের বেজোড় রাতগুলোতে লায়লাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম) আলেমদের কেউ কেউ বিভিন্ন দলিলের মাধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে বলেছেন, এ রাতগুলোর একেকটায় একেক সময় লায়লাতুল কদর সংঘটিত হয়ে থাকে।(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
লায়লাতুল কদরের আলামত
১ – এ রাত বেশি ঠাণ্ডাও হয় না, বেশি গরমও হয় না, বরং তা হয় উজ্জ্বল জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে লায়লাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এ রাত হলো রমজানের শেষ দশদিনের রাতগুলোয়। এ রাত হলো মুক্ত ও উজ্জ্বল, যা ঠাণ্ডাও না গরমও না।’(বর্ণনায় তিরমিযী)
২- লায়লাতুল কদর শেষে সকালের সূর্য আলোকরশ্মি ব্যতীত সাদা হয়ে উদিত হয়। উবায় ইবনে কা’ব রাযি. কে যখন লায়লাতুল কদরের আলামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বলেছেন,‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নিদর্শনের কথা বলেছেন, তার দ্বারা আমরা লায়লাতুল কদর চিনতে পারি, অর্থাৎ ওইদিন সূর্যোদয় হয় রশ্মিবিহীন আকারে।’ (বর্ণনায় ইবনে খুযায়মাহ) সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, ‘আলোকরশ্মিবিহীন সাদা আকারে।’ (বর্ণনায় তিরমিযী)
অনলাইন নিউজ পোর্টাল
মন্তব্য করুন: