বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত

 প্রকাশিত: ১৪:৫২, ২০ অক্টোবর ২০২০

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হায়াতুল মুসলিমীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আখলাক তথা স্বভাব-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা স্বীয় অন্তরে বদ্ধমূল করবে, যার দ্বারা তাঁর ভালবাসাও বৃদ্ধি পাবে এবং সে সমস্ত স্বভাব-চরিত্র গ্রহণের অনুরাগও জন্মাবে। এ সংক্রান্ত কিছু আয়াত এবং কিছু হাদীস লিখছি।
১.আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

’ নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।’(সূরা আল কলম)
২. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

’ (হে লোকসকল!) তোমাদের নিকট এমন একজন রাসূল এসেছেন, যিনি তোমাদের(মত মানব) শ্রেণীভুক্ত। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, (বিশেষতঃ) মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’(সূরা তাওবা-১২৮)
৩. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

’ নিশ্চয় এটা নবীর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কাছে সংকোচ বোধ করেন(তাই তিনি মুখে স্পষ্ট করে বলেন না যে, তোমরা উঠে যাও), কিন্ত্ত আল্লাহ সত্য কথা বলতে সংকোচ করেন না।’
(সূরা আল-আহযাব৫২)
ফায়দা: কত চূড়ান্ত তাঁর ভদ্রতা যে, নিজের ছাত্রদেরকেও একথা বলতে সংকোচ করতেন যে, এখন নিজেদের কাজ করো। তবে এ ছাড় ছিলো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ব্যাপারসমূহে। আল্লাহর বিধান পৌছানোর ক্ষেত্রে এ ছাড় ছিলো না।
এখন কিছু হাদীস তুলে ধরা হচ্ছে।
১. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বণির্ত আছে-

’ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দশ বছর খেদমত করেছি। তিনি আমাকে কখনও ধমক দেননি। একথাও কখনও বলেননি যে, অমুক কাজটি কেন করেছো বা অমুক কাজটি কেন করোনি।’ (বুখারী ও মুসলিম)

ফায়দা: সার্বক্ষণিক খাদেমকে দীর্ঘ দশ বছর সময়কালে কোন কিছু না বলা সাধারণ ব্যাপার নয়। দীর্ঘ এ সময়ে একটি বিষয়ও কি তার নাজুক প্রকৃতির পরিপন্থি হয়নি?
২. হযরত আনাস (রাযিঃ)থেকে আরো বণির্ত আছে-

’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বাধিক সদাচারী ছিলেন। তিনি আমাকে একদিন একটি কাজে যেতে বললেন। আমি বললাম,’ আমি তো যাবো না।’ আর আমার মনের ইচ্ছা ছিলো যেখানে তিনি যেতে বলেছেন, সেখানে যাবো। (এটি ছিলো তাঁর শিশুসুলভ আচরণ)। আমি সেখানে যাওয়ার পথে বাজারের মধ্যে খেলায় রত কিছু ছেলের নিকট দিয়ে অতিক্রম করি। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিছন দিক থেকে (এসে) আমার ঘাড় ধরেন। আমি তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি হাসছিলেন। তিনি বললেন, আমি যেখানে তোমাকে যেতে বলেছিলাম, তুমি সেখানে যাও! আমি নিবেদন করলাম, ‘জ্বি হাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি যাচ্ছি। ’(মুসলিম)

৩. হযরত আনাস(রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
’ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে যাচ্ছিলাম। তাঁর পবিত্র দেহে তখন নাজরানের তৈরী একটি মোটা চাদর ছিলো। তাঁর সঙ্গে এক বেদু্ঈন এসে মিলিত হলো। সে তাঁর চাদর ধরে খুব জোরে টান দিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সিনার নিকট চলে গেলেন। আমি দেখলাম, তীব্র টানের ফলে রাসূলুল্লাহ রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর লোকটি বললো, হে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার জন্যও আল্লাহর ঐ মাল থেকে দেওয়ার হুকুম দাও, যা তোমার নিকটে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকালেন, তারপর হাসলেন। তারপর তাকে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)

৪. হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট যখনই কোন জিনিস চাওয়া হয়েছে, তিনি কখনো দেবো না বলেননি। (থাকলে দিয়ে দিতেন অন্যথায় ঐ সময় অপারগতা জানিয়ে অন্য সময়ের জন্য ওয়াদা করতেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)

৫. হযরত আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে-
’ জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের নিকট কিছু বকরী চাইলো। (যেগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের ছিলো এবং দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থলে বিচরণ করছিলো।) তিনি তাকে সবগুলো বকরী দিয়ে দিলেন। লোকটি স্বজাতির নিকট এলো এবং বলতে লাগলো, হে আমার কওম! তোমরা মুসলমান হয়ে যাও। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব দান করেন। এমনকি রিক্ত হস্ত থাকাকেও ভয় করেন না। (মুসলিম)

৬. হযরত জুবায়ের বিন মুতইম (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
’ একদা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে পথ চলছিলেন। তখন তিনি হুনাইন থেকে ফিরছিলেন। বেদুঈন লোকেরা তাঁকে জড়িয়ে ধরলো এবং তাঁর কাছে দান চাইতে আরম্ভ করলো। অবশেষে তাঁকে একটি বাবলা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ালো এবং তাঁর চাদরটিও ছিনিয়ে নিলো। তিনি দাঁড়ালেন এবং বললেন- আমার চাদরটা তো দিয়ে দাও। আমার নিকট যদি এখানকার বৃক্ষসমূহের সমসংখ্যক উটও থাকতো তাহলে আমি সব তোমাদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। তোমরা আমাকে কৃপণও পাবে না, মিথ্যুকও পাবে না এবং ছোট মনেরও পাবে না।’ (বুখারী)

৭.হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ভোরের নামায শেষ করতেন, তখন মদীনার (লোকদের) ক্রীতদাসেরা নিজেদের পাত্র আনতো। সেগুলোর মধ্যে পানি থাকতো। যে পাত্রই তারা পেশ করতো তিনি(বরকতের জন্য) তাতে স্বীয় পবিত্র হাত দিতেন। অনেক সময় শীতের সকাল হতো, তখনও তিনি তাঁর পবিত্র হাত তার মধ্যে দিতেন।(মুসলিম)

৮. তাঁর থেকে আরো বর্ণিত আছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুঢ় প্রকৃতির ছিলেন না, অভিসম্পাতকারী ছিলেন না এবং তিরস্কারকারীও ছিলেন না। তিরস্কার করার মত কোন কিছু হলে তিনি এভাবে বলতেন, অমুক ব্যক্তির কি হলো? তার কপাল ধুলাচ্ছন্ন হোক। (এতে কোন কষ্টই নেই, বিশেষত যদি তা সেজদায় গিয়ে লাগে তাহলে তো এটি তার জন্য নামাযী হওয়ার দু’আ। আর নামাযের মধ্যে মন্দ কাজ থেকে বাধা দেওয়ার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিধায় এটি তার জন্য সংশোধনের দু’আও হলো)। (বুখারী)

৯. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পরিমাণ লজ্জাশীল ছিলেন, যেমন কুমারী নারী তার পর্দার মধ্যে থাকে। বরং তার চেয়েও অধিক। তাই যখন কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখতে পেতেন, তখন (লজ্জার কারণে মুখে বলতেন না, কিন্ত্ত) আমরা তার প্রভাব তাঁর পবিত্র মুখমন্ডলে দেখতে পেতাম। (বুখারী ও মুসলিম)

১০. হযরত আসওয়াদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
’ আমি হযরত আয়েশা (রাযিঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গৃহাভ্যন্তরে কি কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন- তাঁর ঘরের লোকদের কাজে লেগে থাকতেন। ঘর ঝাড়ু দিতেন এবং বাজার থেকে নিজেই সওদা বয়ে আনতেন।’ (বুখারী)

১১. হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জুতা ছিঁড়ে গেলে নিজেই তা গিরা দিতেন, নিজের কাপড় সেলাই করতেন এবং নিজের ঘরে তেমনি কাজ করতেন যেমন তোমাদের সাধারণ ব্যক্তি তার ঘরে কাজ করে থাকে। হযরত আয়েশা (রাযিঃ) একথাও বলেন যে, তিনি মানবজাতির মধ্যকারই একজন মানব ছিলেন। (নিজ গৃহে মনিব ও বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে থাকতেন না।) নিজের কাপড়ের উকুন দেখতেন(অর্থাৎ, অন্য কারো থেকে উঠে এসেছে কিনা, কারণ, তিনি এ থেকে পবিত্র ছিলেন)। নিজের বকরীর দুধ নিজে দোহন করতেন। (এসব ঘরের কাজের দৃষ্টান্ত, কারণ, এসব কাজ ঘরওয়ালাদের করার প্রচলন রয়েছে) এবং নিজের (ব্যক্তিগত) কাজও করতেন। (তিরমিযী)

১২. হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের হাতে কোন জিনিসকে কখনও প্রহার করেননি। কোন মহিলাকেও না এবং কোন সেবককেও না। তবে হাঁ, আল্লাহর পথের জিহাদ এ থেকে ব্যতিক্রম। (অর্থাৎ, প্রবৃত্তির তাড়নায় রাগে উন্মত্ত হয়ে মারার অভ্যাস তাঁর ছিল না) এবং তাঁকে কেউ কখনও কষ্ট দিলে তিনি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত কোনটিতে লিপ্ত হতো, তখন তিনি আল্লাহর জন্য তার প্রতিশোধ নিতেন্ (মুসলিম)

১৩. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমার বয়স যখন আট বছর তখন আমি হুযূরের খেদমতে আসি। পূর্ণ দশ বছর সময় পর্যন্ত আমি তার খেদমত করি।
আমার হাতে কোন ক্ষতি হলেও তিনি কখনও আমাকে তিরস্কার করেননি। তাঁর পরিবারের কেউ তিরস্কার করলেও তিনি বলতেন, আরে ছেড়ে দাও। যদি অন্য কিছু ভাগ্যে থাকতো তবে তাই হতো।’ (মাসাবীহ-তে হুবহু এবং বাইহাকীতে ঈষৎ পরিবর্তিত)

১৪. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা বর্ণনা করতেন যে,
’ তিনি অসুস্থদের খোঁজ-খবর নিতে যেতেন এবং জানাযার সঙ্গে গমন করতেন।’ (ইবনু মাজা, বাইহাকী)

১৫. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে আরো বর্ণিত আছে-
’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কারো সঙ্গে মোসাফাহা করতেন তখন সে ব্যক্তি নিজের হাত বের করার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের হাত তার হাত থেকে বের করতেন না এবং সে ব্যক্তি নিজের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি নিজের মুখ তার থেকে ফিরিয়ে নিতেন না এবং তাকে কখনও নিজের কাছে উপবেশনকারীদের সম্মুখে নিজের হাঁটুকে অগ্রসর করতে দেখা যায়নি। (বরং সারির মধ্যে সবার সমানে বসতেন। হাঁটু দ্বারা পাও উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ, তিনি কারো দিকে পা ছড়িয়ে বসতেন না। (তিরমিযী)

দু’টি দীর্ঘ হাদীস রয়েছে। তার কিছু বাক্য উদ্ধৃত করছি- হযরত হুসাইন (রাযিঃ) তাঁর আব্বাজান হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন-
’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার গৃহে তাশরীফ নিতেন, তখন তিনি গৃহে অবস্থান করার সময়টিকে তিন ভাগে ভাগ করতেন। এক ভাগ মহান আল্লাহর ইবাদতের জন্য, একভাগ পরিবারের লোকদের হক আদায়ের জন্য, আর একভাগ নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্য। উপরন্ত্ত, নিজের ব্যক্তিগত ভাগটিকে নিজের মধ্যে এবং অন্যদের মধ্যে এভাবে ভাগ করতেন যে, সেই ভাগের (বরকতসমূহকে) নিজের বিশিষ্ট সাহাবীদের মাধ্যমে সাধারণ লোকদের পর্যন্ত পৌছাতেন। (অর্থাৎ, ঐ সময় বিশিষ্ট জনদের জ্ঞান আহরণের অনুমতি ছিলো। তারপর তারা সাধারণ লোকদের পর্যন্ত সেই জ্ঞানের কথা পৌছে দিতেন) এবং উপরোক্ত ভাগে তাঁর অভ্যাস এই ছিলো যে, জ্ঞানী-গুনীদেরকে (উপস্থিতির) অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের উপর প্রাধান্য দিতেন এবং ঐ সময়টিকে তাদের মধ্যে তাদের ধর্মীয় মর্যাদা অনুপাতে বন্টন করতেন। কারণ, কারো একটি প্রয়োজন থাকতো, কারো দু’টি, কারো তিনটি। তিনি সেই অনুপাতে তাঁদের সঙ্গে ব্যাপৃত থাকতেন এবং তাদেরকেও এমন কাজে নিয়োজিত রাখতেন, যার মধ্যে তাঁদের এবং উম্মতের কল্যাণ রয়েছে, যেমন মাসআলা জিজ্ঞাসা করা, বিভিন্ন অবস্থা অবগত করানো। এবং সবাই তাঁর কাছে জ্ঞানপিপাসু হয়ে আসতো এবং (জ্ঞান আহরণ ছাড়াও) কিছু পানাহার করে ফিরে যেতো এবং দ্বীনের হেদায়েত দানকারীরুপে বের হয়ে যেতো।(এ ছিলো তাঁর বিশেষ মজলিসের ধরণ)
তারপর আমি স্বীয় পিতার নিকট তাঁর বাইরে তাশরীফ আনা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করি।(তিনি সবিস্তারে তা বর্ণনা করেন, যা আমি তারঁই অপর একটি হাদীস থেকে উদ্ধৃত করছি।) হযরত আলী (রাযিঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা প্রফুল্ল চেহারা, বিনম্র আচরণ ও বিনীত প্রকৃতির অধিকারী ছিলেন। তাঁর সম্মুখে মানুষ পরস্পরে বিবাদ করতো না। তাঁর সম্মুখে কেউ কথা বললে তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি নীরব থাকতেন। বহিরাগত মানুষ কথা বলতে ও প্রশ্ন করতে অসৌজন্য আচরণ করলে তিনি তা সহ্য করতেন। তিনি কারো কথা খন্ডন করতেন না। হাঁ, কেউ কথায় সীমালংঘন করলে তাকে বাধা দিয়ে বা নিজে উঠে গিয়ে তা খন্ডন করতেন।( এ ছিল তাঁর সাধারণ মজলিসের দৃশ্য)।
এ আচরণ তো ছিলো নিজের লোকদের সঙ্গে। বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে তাঁর আচরণ কিরূপ ছিলো তাঁরও কিছুটা বর্ণনা করছি।

১৮. হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার তাঁর নিকট নিবেদন করা হলো-
’ হে আল্লাহর রাসূল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিকদের উপর বদদু’আ করুন। তিনি বললেন, আমি অভিশম্পাতকারীরুপে প্রেরিত হইনি। আমি তো কেবলই রহমতস্বরুপ প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম)

ফায়দা: এজন্য শত্রুদের জন্যও কল্যাণের দু’আ করাই তাঁর অভ্যাস ছিলো। তবে কদাচিৎ আপন রবের দরবারে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষার প্রার্থনায় কোন ফরিয়াদ করা, সে ভিন্ন কথা।

১৯. হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে তায়েফ গমনের একটি দীর্ঘ ঘটনা বর্ণিত আছে।
সেখানে তিনি কাফেরদের হাতে এতো মর্মান্তিক কষ্ট পান, যাকে তিনি উহুদ যুদ্ধের কষ্টের
চেয়েও অধিক তীব্র বলেছেন। তখনকার অবস্থা সম্পর্কে বর্ননা করেন-
তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করান। ফেরেশতা তাঁকে সালাম করে নিবেদন করেন যে, হে মুহাম্মাদ! (সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম) আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা। আল্লাহ তাআলা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। যেন আপনি আমাকে নির্দেশ দান করেন। আপনি চাইলে আমি দুই পাহাড়কে তাদের উপর এনে এক করে ফেলবো। (যার মধ্যে এরা সবাই পিষে যাবে)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, না, আমি তো আশা করি যে, আল্লাহ তাআলা তাদের বংশে এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যারা কেবল আল্লাহরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করবে না। (বুখারী ও মুসলিম)

ফায়দা: লক্ষ্য করুন! এ সময় নিজের হাত দ্বারা প্রতিশোধ নেওয়ার পরিস্থিতি না থাকলেও মুখ দ্বারা বলা তো সহজ ব্যাপার ছিলো। বিশেষতঃ যখন তাঁকে এ নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছিল যে, তাঁর নির্দেশমাত্র সবকিছু তছনছ করে দেওয়া হবে। কিন্ত্ত তিনি তারপরও রহমতের আচরণই করেছেন। এ আচরণ ছিলো এমন বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে, যারা ছিলো তাঁর প্রতিপক্ষ।
কিছু বিরুদ্ধবাদী ছিলো এমন, যারা তাঁর অধীনস্থ প্রজা ছিলো। যাদের উপর তাঁর আইনানুগ ক্ষমতাও ছিলো। তাদের সঙ্গে তাঁর আচরণের কথাও শুনুন।

২০. হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে দীর্ঘ একটি হাদীস বর্ণিত আছে।
এক ইহুদী যে কিনা মুসলমানদের প্রজা হয়ে মদীনায় বাস করছিলো- হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার থেকে কিছু ঋন নিয়েছিলেন। একবার সে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এই পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করে যে, যোহর থেকে নিয়ে পরদিন ভোর পর্যন্ত তাঁকে মসজিদ থেকে বাড়ীতেও যেতে দেয়নি। মানুষরা এজন্য তাকে ভৎর্সনা করলে তিনি বললেন- ’ আল্লাহ তাআলা আমাকে সন্ধিকারী এবং সন্ধিকারী নয় উভয় প্রকার লোকদের উপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন। এ ঘটনাতেই বর্ণিত আছে যে, যখন দুপুর হয়ে এলো তখন ইহুদী আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলে মুসলমান হয়ে গেলেন এবং একথাও বললেন যে, আমি এসব এজন্য করেছি যে, আপনার যে পরিচয় ও গুনাবলী তাওরাতে রয়েছে অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবদুল্লাহর পুত্র, তাঁর জন্ম মক্কায়, হিজরত হবে মদীনায় এবং তাঁর রাজত্ব ‍চলবে সিরিয়ায়(সুতরাং পরবর্তীতে এমনটি হয়েছে)। তিনি কঠোর আচারী, শুষ্ক প্রকৃতির এবং বাজারে হৈচৈকারী নন। অশ্লীল কাজ এবয় অশ্লীল কথা তাঁর স্বভাব নয়। এ বিষয়টি আমার পরীক্ষা করার ছিলো,(যে ইনি তিনিই কিনা, তাই পরীক্ষা করে দেখলাম যে, ইনিই তিনি)। (বাইহাকী)
শামায়িল থেকে উদ্ধৃত হাদীসদ্বয় ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত হাদীস মিশকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত।

পরামর্শঃ এ অল্প কয়টি হাদীসকেও প্রতিদিন একবারই যদি পড়ো বা কারো দ্বারা পড়িয়ে শোনো, তাহলে দেখতে পাবে, তুমি কত তাড়াতাড়ি কত ভালো হও।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: