বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৪ ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

মুসলিমের বিজয় উদযাপন: কতইনা মহিমাপূর্ণ

 প্রকাশিত: ১৪:২৭, ১৮ জুন ২০২১

মুসলিমের বিজয় উদযাপন: কতইনা মহিমাপূর্ণ

প্রত্যেক জাতিরই বিজয় আছে, আমাদের মুসলমানেরও আছে, কিন্তু মুসলমানের বিজয় নানা দিক থেকে আলাদা। চিন্তা ও মূল্যায়ন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, কর্ম ও কর্মপন্থা সব দিক থেকেই মুসলমানের বিজয় ভিন্ন মাত্রার, ভিন্ন প্রকারের।

 

কুরআন মাজীদে বিজয়ের দুটো রূপ খুব স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এক. স্বার্থ ও সা¤্রাজ্যবাদী বিজয়ের রূপ আর দুই. কল্যাণ ও আদর্শবাদী বিজয়ের রূপ।

প্রথমটি বর্ণিত হয়েছে সূরা নামলের ৩৪ নম্বর আয়াতে

اِنَّ الْمُلُوْكَ اِذَا دَخَلُوْا قَرْیَةً اَفْسَدُوْهَا وَ جَعَلُوْۤا اَعِزَّةَ اَهْلِهَاۤ اَذِلَّةً.

রাজা-বাদশা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে তখন তা বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাবান-লোকদের অপদস্থ করে। (২৭ : ৩৪)

 

কুরআন মাজীদ ‘বিপর্যস্ত করে’ ও ‘অপদস্থ করে’  এই দুটি মাত্র শব্দে যে বাস্তবতা বর্ণনা করেছে, যুগে যুগে রাজ্য বিস্তার ও সা¤্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও যুদ্ধজয়ের রূপটি কি তার চেয়ে কিছুমাত্রও আলাদা ছিল? এই যুদ্ধ ও যুদ্ধজয় যে কত জনপদ তছনছ করেছে! কত মানুষের রক্ত প্রবাহিত করেছে! কত নারীর সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত করেছে! কিন্তু এর বিনিময়ে মানবতা কী পেয়েছে প্রভু বদল ও দাসত্বের পালাবদল ছাড়া? এ কারণে বিজয়ের এই প্রকারটি মানবতার বিজয় নয়, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বিজয়।

বিজয়ের আরেক রূপ কুরআন বর্ণনা করেছে এভাবে

اَلَّذِیْنَ اِنْ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَ اَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَ نَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ  وَ لِلهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ.

আমি এদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা সালাত আদায় করবে, যাকাত দান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।  সূরা হজ্ব (২২) : ৪১

এ হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয় এবং মানব ও মানবতার বিজয়।

 

মুসলিম হিসেবে আমাদের গৌরববোধ থাকা উচিত যে, বিজয়ের এই রূপটিই আমাদের। শুধু নীতিগত দিক থেকে নয়, বাস্তব ইতিহাসেও এ রূপটিই আমাদের বিজয়ের রূপ। তবে হাঁ, হাজার বছরের পথচলায় কখনো যে আমাদের বিচ্যুতি ঘটেনি তা নয়, কিন্তু বিচ্যুতি তো বিচ্যুতিই।

আমাদের আদর্শ ইতিহাস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে শুধু ফাত্হে মক্কার অধ্যায়টিই দেখুন। পুরো বিবরণ তো হাদীস ও সীরাত গ্রন্থে রয়েছে। এখানে শুধু হিরে-জহরতের মতো কিছু টুকরো ঘটনা তুলে ধরছি

 

নবম হিজরীর মাহে রমযানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মক্কা-অভিমুখে রওনা হলেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইতিমধ্যে ইসলাম কবুল করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মুসলিম বাহিনীর যাত্রাপথে দাঁড় করিয়ে দিলেন, যেন ইসলামের শান-শওকত তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।

একের পর এক গোত্র অতিক্রম করে যাচ্ছে, আনসারীদের দলটি যখন অতিক্রম করছিল, যার পতাকা ছিল বিখ্যাত আনসারী সাহাবী সা‘দ ইবনে উবাদা রা.-এর হাতে, কুরাইশের নেতা আবু সুফিয়ানকে দেখে তিনি বলে উঠলেন

"اليوم يوم الملحمة"

“আজ রক্তপাতের দিন।”

আবু সুফিয়ান রা. ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের কাছে প্রশ্ন করলে তিনি সা‘দ ইবনে উবাদা রা.-কে নিষেধ করলেন এবং বললেন

"اليوم يوم المرحمة"

 “আজ দয়া ও করুণার দিন।”

অন্য জাতির বিজয়-দিবস সাধারণত হয়ে থাকে ‘ইয়াওমুল মালহামাহ’ রক্তপাত দিবস আর মুসলিম জাতির বিজয়-দিবস হচ্ছে, ‘ইয়াওমুল মারহামাহ’ দয়া ও করুণার দিবস।

এই ক্ষমা ও করুণার ঘোষণাই তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছিলেন কাবার দরজায় দাঁড়িয়ে

"لا تثريب عليكم اليوم اذهبوا فأنتم الطلقاء

আজ তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত।

 

দুই. মক্কা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মভূমি। এখানেই তাঁর জন্ম, তাঁর শৈশব ও  কৈশোর। এখানেই উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজা রা.-এর সাথে তাঁর সুখী দাম্পত্য। তাঁর সঙ্গী শত শত মুহাজিরের এটিই জন্মভূমি। কিন্তু হিজরতের পর তাদের ভিটেমাটি পর্যন্ত লুণ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। আজ তাঁরা ফিরেছেন আপন জন্মভূমিতে বিজয়ীর বেশে। গোটা মক্কানগরী আজ তাদের করতলগত। কিন্তু তাঁরা কি তাঁদের ভিটেমাটিটুকুও ফেরৎ নিয়েছেন? নেননি। কারণ, মক্কার ভিটেমাটি তো তারা আল্লাহর দ্বীনের জন্য ত্যাগ করেছিলেন,  তাই তা আর ফেরৎ নেননি।

ইসলামের ‘জিহাদ’ ও ‘বিজয়’ যে রাজ্য বিস্তারের জন্য নয়, আদর্শ বিস্তারের জন্য এ তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।

 

তিন. বিজয়ীর বেশে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় প্রবেশ করছেন, তখন তাঁর সাথে ছিলেন হাজার হাজার জানবায মুজাহিদ। যাঁদের শৌর্য-বীর্য বহু রণাঙ্গনে প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর একটি মাত্র অঙ্গুলি হেলনে এদের প্রত্যেকে প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সেই মহান সিপাহসালারের অবস্থা এই যে, আল্লাহর প্রতি বিনয় ও শোকরগোযারীতে তাঁর শীর মোবারক আনত এবং পবিত্র যবানে কুরআন মাজীদের আয়াত জারি

اِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِیْنًا

নিশ্চয়ই আমি তোমাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়...।  সূরা ফাতহ (৪৮) : ১

 

শুধু কি এ-ই, সাথে একই সওয়ারীতে রয়েছেন উসামা ইবনে যায়েদ রা.। কে এই উসামা রা.? তৎকালীন আরবের জাতিভেদ কার অজানা? সেই সমাজে সবচেয়ে নি¤œ শ্রেণীর মানুষ ছিল তাঁরা যারা ‘দাস’। উসামা রা. হলেন সেই সমাজের বিচারে একজন ‘দাসপুত্র’। রাযিআল্লাহু আনহু। তিনি আজ আরোহী এক সওয়ারীতে। কার সাথে? আরবের শ্রেষ্ঠ অভিজাত এবং আজকের এই বিজয়-বাহিনীর সিপাহসালার হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে!

এরপর হারামে এসে যখন নামাযের সময় হল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আযানের জন্য মুয়াযযিন নির্বাচন করলেন; কাকে? হযরত বেলাল রা.-কে। তাঁকে আদেশ করলেন কাবার উপর উঠে আযান দেয়ার। হযরত বেলাল রা. হচ্ছেন একজন হাবাশী, কালো বর্ণের মানুষ, এবং একজন আযাদকৃত দাস। বিশ্বাস ও কর্মহীন আভিজাত্যের অহঙ্কার চুরমার করে সকল বর্ণবাদী জাহেলী চেতনা নস্যাৎ করে বিজয়ের দিনে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন সাম্য ও মানবতা। জন্মগত আভিজাত্যের মধ্যে নয়, চেহারা ও চামড়ার সৌন্দর্যের মধ্যেও নয়, কর্ম ও আদর্শের মাঝেই যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব  এ মহাসত্য তিনি আজ বিজয়ের দিনে প্রমাণ করেছেন।

এই হচ্ছে মুসলমানের বিজয়। এই বিজয় সত্য ও আদর্শের বিজয়, মানব ও মানবতার বিজয়। এই বিজয়ের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে আদর্শের প্রতি অবিচলতা এবং ক্ষমা, উদারতা, সাম্য ও মানবতা।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: