মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১০ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

সাহিত্য

মা তো মা-ই, তার তুলনা নাই

 প্রকাশিত: ১৮:৩৬, ১ অক্টোবর ২০২০

মা তো মা-ই, তার তুলনা নাই

স্ত্রীর অসুস্থতা, করোনার ঝঞ্ঝাট আর অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাড়িতে যাওয়া হয় না অনেকদিন। বিগত তিনটা ঈদের একটাও বাড়িতে করতে পারি নি; তিনটা ঈদ-ই কেটেছে শ্বশুরবাড়িতে। প্রথম দুটো গেছে স্ত্রীর সুশ্রুষায়, তৃতীয়টা গেছে করোনায় পড়ে। মাঝখানে বার দু-এক বাড়িতে গেলেও শেষ বিরতিটা বেশ দীর্ঘ হয়ে গেছে। ছেলে দীর্ঘদিন বাড়িতে যায় না বলে মায়ের মন খারাপ। প্রথম প্রথম ইতিউতি করে বুঝিয়েছেন, তারপর হয়েছে চরম অসন্তোষ। ফলে এক সকালে বেজায় অসন্তুষ্ট হয়ে ফোন বন্ধ করে দিলেন মা। এবং গোস্বাভরে জানিয়ে দিলেন, বাবা-মায়ের খবর আর ছেলেকে নিতে হবে না।

 

দু-এক দিন পর রাগ কিছুটা প্রশমিত হলেও কথা বলতেন গোস্বাভরা কণ্ঠেই। ছেলেবউয়ের সাথে দীর্ঘ কথা হলেও ছেলের সাথে হুঁ, হাঁ। মায়ের মুখে হাঁ, না শুনেও কিছুটা আত্মপ্রশান্তি লাভ করছিল ছেলে। অতি সামান্য হলেও কিছু কথা তো হচ্ছে। অবশ্য নৈমিত্তিকের মত এখন আর মায়ের ফোন পাওয়া যাচ্ছে না। মা রাগ করেছেন। ছেলে জানে মা আপাতত ফোন করবেন না।

 

এরই মধ্যে ছেলের ডাক পড়লো কর্মস্থলে।  বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে ছুটতে হলো তাকে একাই। কর্মস্থলে পৌঁছার একদিন যেতেই অসুখে পড়ল সে। জ্বর, সর্দি। নাক দিয়ে অঝোর বরিষধারা-পতন দেখে আতকে উঠল তার মন। সময়টা ভাল নয়। করোনা উজাড় করে দিচ্ছে পৃথিবীর বড় বড় শহর। মৃত্যুপুরী বানিয়ে দিচ্ছে উন্নত রাষ্ট্র। নিজেই বারকয়েক ঢোক গিলে দেখল সে গলা ব্যথা করছে কি না। তেমন কোনো আলামত না পেলেও শংকা যায় না মন থেকে। আবার জমে থাকা সর্দি-জলের কারণে মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না দেখে বাবাকে ফোন করতে হলো। সর্দিজল পতনের খবর দিয়ে ওষুধের নাম জিজ্ঞেস করতে হলো। এবং মুহূর্তেই এই খবর বাবার মাধ্যম হয়ে মায়ের কাছে পৌঁছে গেল।

 

মা তো রাগ করেছিলেন। রাগ করেছিলেন ছেলের অসচেতনতা ও অপরাধের কারণে। তথাপি ছেলের অসুস্থতার খবর তাকে বিচলিত করলো। রাগ-ক্ষোভ ছাইচাপা দিয়ে তৎক্ষণাৎ ফোন করলেন ছেলেকে। মায়ের ফোন দেখে ছেলের মনে আনন্দের অনুরণন। আহা, এমন সুখের অসুখ জীবনে কত বার আসে!

 

সেই যে শুরু হলো, সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত, ফোন করে মা জানতে চান, এখন কী অবস্থা? কী খাচ্ছি? লেবুর শরবত খাচ্ছি কি না? ওষুধ খেয়েছি কি না? ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছি কি না? 

কী আশ্চর্য অদ্ভুত সুন্দর এই মমতাধার নারীজীবন! সন্তানের অসুখের খবর সকল রাগ-ক্ষোভ-অভিমান নিমেষেই নির্মূল করে দেয় তার অপরিসীম মমতার জোরে। অথচ, প্রতিনিয়ত মমতার বিনিময়ে তাকে কেবল ব্যথা-বেদনাই সইতে হয়। যেন এক বেদনাকর অমোঘ নীতি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে মাতৃজীবনকে।

 

বাবার কথা না বললে অপূর্ণ থাকবে এই লেখা। বাবা নিজেই জোর অসুখ থেকে উঠেছেন কদিন আগে। তীব্র জ্বরে কেঁপে উঠেছিলেন আব্বা। বলেছিলেন, ‘মনে হয় যেন শরীরে ভুমিকম্প চলছে। চোখ দুটো রক্তজবার মত টকটকে লাল হয়ে আছে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যেতে হয়।’ সেই তীব্র জ্বর থেকে আল্লাহ তাকে সুস্থ করেছেন। ছেলের অসুখ শোনার পর থেকে যিনি সবচেয়ে বেশী ফোন করেছেন তিনি বাবা। এই লেখাটা যখন  লিখছি তখনও ফোন করে তিনি বললেন, ‘স্যালাইন খাও। পানি বেশী খাও। যেটা ভাল লাগে সেটা করো। শরীর মোছো। ডাক্তার কত দূরে থাকেন? সমস্যা হলে চলে আসো।’ 

 

বয়েস হলে ছেলের নাকি বাবার হাত ধরতে হয়। এটাই নাকি নিয়ম। আমার বাবা এখনও বেশ তরুণ। ছেলের হাত তিনি শক্ত করে ধরে আছেন। আল্লাহর দেওয়া প্রথম এই মনুষ্য-উপহারটি তাঁর জীবনে অনেক বড় সম্পদ; তিনি মনে করেন। সেই সম্পদের পরিচর্যায় তার সামান্য কসুর নেই। স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন বৃষ্টিস্নাত এক বুধবারে পাওয়া এই ‘অপদার্থ সম্পদ’।

رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: