শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৫ ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

বাসা-বাড়িতে ঈদের জামাত পড়া শরীয়তের মেজাজের সম্পূর্ণ খেলাফ

 প্রকাশিত: ১০:৩৪, ২৬ মে ২০২০

বাসা-বাড়িতে ঈদের জামাত পড়া শরীয়তের মেজাজের সম্পূর্ণ খেলাফ

ঈদগাহ বা মসজিদের পরিবর্তে বাসা- বাড়িতে ঈদের জামাত পড়া, অন্যকে পড়তে বলা এটা ইসলামী শরীয়তের মেজাজের সম্পূর্ণ খেলাফ। বাংলাদেশে এই করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে যারা ঈদের নামাজ বাসা-বাড়িতে পড়তে উদ্বুদ্ধ করছেন তারা ঈদ ও ঈদের জামাতের ব্যাপারে শরিয়তের যে মেজাজ, সেই মেজাজের বাইরে গিয়ে মানুষকে একটি ভুল পদ্ধতির প্রতি উৎসাহিত করছেন।এদেশের সরকার যেখানে মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত পড়ার অনুমোদন দিয়ে রেখেছে, সেখানে বাসা- বাড়িতে ঈদের নামাজের আয়োজন করার কথা বলা কোনোভাবেই উচিত হতে পারে না।

ঈদের জামাতের ব্যাপারে শরীয়তের মেজাজ বিশ্লেষণ করে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার রঈস মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইসলাম টাইমস- এর সঙ্গে আলাপচারিতায় সম্প্রতি এসব কথা বলেন।


তিনি বলেন, আজকাল প্রশ্ন উঠানো হচ্ছে, ঈদের জামাত ঘরে বা বাসা-বাড়িতে পড়া যাবে কিনা এবং বাসা বাড়িতে ঈদের জামাত পড়া নিয়ে কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ করছেন, মাসআলা বলে দিচ্ছেন এবং কেউ কেউ দলিল দেওয়ারও চেষ্টা করছেন। অথচ আমাদের এদেশে জুমার জন্য সরকার আগেই মসজিদগুলো উন্মুক্ত করে রেখেছে। মসজিদে ঈদের জামাত পড়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ঘোষণা করে দিয়েছে। সে রকম পরিস্থিতিতে এই দেশে বাসা-বাড়িতে ঈদের জামাত পড়ার প্রসঙ্গটিই তো অপ্রয়োজনীয়। যদি লকডাউন কঠোর- বাইরের দেশের এমন কোনো জায়গার ঈদের নামাজ নিয়ে এ কথা হতো, তাহলেও হয়তো প্রসঙ্গটি উঠতে পারতো। এদেশে এটি একদমই অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয়।

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আরো বলেন, ঈদের জামাত পড়ার সবচেয়ে উপযোগী ও উত্তম জায়গা হলো, ঈদগাহ, ঈদের জন্য খোলা মাঠ। এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যে মাঠে ঈদের জামাতের আয়োজন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও উপযোগী হওয়ার কথা। কারণ এতে ভিড় এবং গা ঘেঁষাঘেঁষির আশঙ্কাটা অনেক কমে যায়। তবুও বর্তমান পরিস্থিতিতে কমপক্ষে মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ পড়ার আয়োজন ও অনুমোদনের বিষয়টাকেও আমরা সাধুবাদ জানাতে চাই।

অনেকেই ঘরে এবং বাসা-বাড়িতে ঈদের জামাত পড়ার পক্ষে যেসব যুক্তি দিচ্ছেন, সে প্রেক্ষিতে বিশিষ্ট ফকীহ মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বলেন, শোনা যাচ্ছে, কেউ কেউ বিদেশে বসে আমাদের দেশের মুসলমানদেরকে বাসা- বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ করছেন এবং ‘মাসাআলা’ও বলে দিচ্ছেন। হতে পারে তিনি যে দেশে বসে এজাতীয় মাসালা বলছেন, সেখানে মাঠে অথবা মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি নেই, বাংলাদেশে তো মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি আছে। ওই দেশে বসে এদেশের মানুষদেরকে ঘরে-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ করা তাদের জন্য কোনোভাবেই সঙ্গত নয়। ঘরের মধ্যে ঈদের নামাজ পড়া যাবে কিনা প্রথমত এই প্রশ্নটিই সঠিক নয়। এখন শোনা যাচ্ছে, ঘরে বা বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ কিভাবে পড়তে হবে, সেই তরিকাটাও তারা বাতলে দিচ্ছেন!

মারকাযুদ দাওয়াহর ফিকহ বিভাগের প্রধান মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ঈদের নামাজ ঘরে পড়ার দলিল প্রসঙ্গে বলেন, আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, একবার সাহাবী হযরত আনাস রা.-এর ঈদের নামাজ ছুটে যায়, নামাজে শরিক হতে চেয়েও তিনি নামাজ পাননি। পরে ঘরে এসে পরিবার-পরিজনকে একত্রিত করে তিনি নামাজ পড়েন। সেই নামাজের পরে কোনো খুতবা দেননি। এ ঘটনাকে ভিত্তি করে কেউ কেউ বলছেন, ঘরে এসে তিনি ঈদের নামাজই পড়েছেন, কিন্তু খুতবা দেননি। কেউ কেউ বলছেন, ঘরে এসে তিনি ঈদের নামাজ পড়েননি, বরং ঈদের নামাজ ছুটে যাওয়ায় এশরাক বা এজাতীয় কোনো নফল নামাজ পড়েছেন, যে কারণে নামাজের পরে কোনো খুতবা দেননি।

তিনি বলেন, হযরত আনাস ঘরে এসে যে নামাজ পড়েছেন, যদি আমরা ধরেও নিই, তিনি ঈদের নামাজ পড়েছেন, তাহলেও তো লক্ষ করার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি ঘরে এসে নামাজ পড়েছেন ঈদগাহে নামাজ না পাওয়ার কারণে, মাঠে ঈদের নামাজ তাঁর ফওত হয়ে যাওয়ার কারণে। হযরত আনাসের ওই ঘটনা ব্যতীত কেউ কি এমন কোনো দলিল দেখাতে পারবে যে, কোনো সাহাবী ঈদের দিন ঈদগাহে না গিয়ে ঘরের মধ্যে বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়েছেন? তাহলে বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়া নিয়ে এইরকম বাড়াবাড়ি আচরণ তাঁরা কেন করছেন! মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং নতুন নতুন কথার জন্ম দেওয়া খুবই অন্যায় কাজ।


ঈদ ও জুমার ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের মেজাজ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, এদুটি নামাজের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো, জামাতের সঙ্গে পড়া। এটাই ইসলামী শরীয়তের মেজাজ। আল জুমআ হিয়াল জামাআহ। জুমার নামাজ জামাতের সঙ্গে মসজিদে হবে। আর ঈদের নামাজের জামাত হবে ঈদগাহে, খোলা ময়দানে। দুর্ভাগ্যবশত আগে থেকেই আমাদের দেশে ঈদের জামাতের পর্যাপ্ত মাঠ নেই, তাই অনেক সময় মসজিদেও ঈদের জামাত হয়। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সরকারও মসজিদে ঈদের জামাত পড়ার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। এমন অবস্থায় হযরত আনাসের ঈদের জামাত ফওত হওয়ার ঘটনাকে টেনে এনে ঈদ ও জুমাকে ঘরে বা বাসা-বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার এজাতীয় চেষ্টা শরিয়তের মেজাজের জঘন্য খেলাফ‌।

হানাফী মাযহাব অনুযায়ী বাসা-বাড়িতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠান সহিহ না হলেও অন্য কোনো কোনো মাযহাব অনুযায়ী বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়লে আদায় হয়ে যাওয়ার যে মাসআলা রয়েছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো মাযহাব অনুযায়ী কোনো কারণে বাসা বাড়িতে পড়লে ঈদের নামাজ আদায় হয়ে যাওয়া এটা এক ব্যাপার, আর বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ করা এটা আরেক ব্যাপার। কোনো কোনো মাযহাবের  যেসব ফকীহগণ বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ আদায় হয়ে যাওয়ার পক্ষে বলেছেন, তারাও বিভিন্ন রকম শর্ত, লোক সংখ্যার উপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে সযত্ন থাকতে বলেছেন। মাঠ বা মসজিদে না পড়ে বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়তে কাউকে উদ্বুদ্ধ করেন নি। এটা খুবই লক্ষণীয় একটি বিষয়। তাদেরকে উদ্ধৃত করে এখন যারা বাসা-বাড়িতে ঈদের নামাজ পড়ার কথা বলছেন, তারা করছেন উল্টোটা, মানুষকে মাঠ বা মসজিদের পরিবর্তে বাসায় এসে ঈদের নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ করছেন‌ ‌। অথচ হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ফকীহগণ এমনও বলেছেন যে, হযরত আনাস ছিলেন একজন বিত্তবান সাহাবী।

তার পরিবারের সদস্য, কর্মচারী, গোলাম এমন বিভিন্ন জন মিলিয়ে তার বাড়ির ওই জামাতটিও প্রায় ঈদের জামাতের (লোক সংখ্যার বিচারে) সমতুল্য হয়ে উঠেছিল। আবার কেউ কেউ এই হাদীসের সনদের দুর্বলতা নিয়েও কথা বলেছেন।

ঈদের জামাতে উপস্থিতির অপরিহার্যতা এবং অনুপস্থিতির অবকাশ তুলে ধরে বিশিষ্ট এই ফকীহ আরও বলেন, এদেশে যেহেতু মসজিদে উপস্থিত হয়ে ঈদের নামাজ পড়তে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, তাই যারা সুস্থ এবং যাদের উপর ঈদ-জুমার নামাজ পড়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তারা মসজিদে হাজির হবেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ও মনে রাখার মতো একটি ব্যাপার হচ্ছে, ঈদের নামাজ সকলের জন্য ফরজ কিংবা ওয়াজিব নয়। বরং জুমার নামাজ যাদের জন্য মাফ, ঈদের নামাজও তাদের জন্য মাফ। তারা চাইলে জামাতে অনুপস্থিত থাকতে পারেন। কোনো অসুস্থ ব্যক্তির ঈদের জামাতে উপস্থিত হওয়ার আবশ্যকতা নেই। তিনি উপস্থিত হতে না পারলে কোনো সমস্যা নেই। ঘরে অবস্থান করে চাইলে এশরাকের নামাজ পড়তে পারেন, অন্য কোনো নফল নামাজ পড়তে পারেন। একইভাবে এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কারো কারো মনে ভয়ভীতি কাজ করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নানাভাবে যেসব আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে সেগুলোর দ্বারা অনেকে প্রভাবিত হয়, এমন কেউ মসজিদে উপস্থিত হতে না চাইলে উপস্থিত হবেন না, ঘরে থাকবেন। ঘরে নফল নামাজ পড়বেন। আশা করা যায়, তাদের ঈদের জামাতে উপস্থিত হতে না পারার কারণে আল্লাহ তা’আলা তাদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু আমি অথবা আমার মতো কিছু মানুষ অসুস্থতা কিংবা ভীতির মধ্যে থাকার কারণে সবাইকে ঘরে ঈদের জামাত কায়েমে উদ্বুদ্ধ করব- নিজেরা একেকটা জুমা কিংবা ঈদ নিজেদের বাসায় কায়েম করে ফেলব, ইসলামী শরীয়তের মেজাজের সাথে এজাতীয় মনোভাব ও আচরণের কোনো মিল নাই। হযরত আনাস রা.- এর ঈদের জামাত ফওত হওয়ার ঘটনাকে টেনে এনে ঘরে ঘরে ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের পক্ষে দলিল পেশ করা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। শরীয়তের মেজাজ এবং মাসআলা-মাসায়েলের সঙ্গে এজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার কোন সামঞ্জস্য নেই।

‘আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হক বিষয়টিকে বোঝার এবং মাঠে- মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করার তৌফিক দান করুন।’

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: