বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

পরামর্শ, ঐক্য, স্বচ্ছ কারবার ও সুসামাজিকতা

 প্রকাশিত: ১০:৩২, ১৫ জানুয়ারি ২০২১

পরামর্শ, ঐক্য, স্বচ্ছ কারবার ও সুসামাজিকতা

উৎস:
ইসলাহী নেসাব: হায়াতুল মুসলিমীন
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র:)

পরামর্শযোগ্য বিষয়সমূহে সৎ ও হিতাকাংখী ব্যক্তিদের থেকে পরামর্শ নেওয়া এবং পরস্পরে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও ঐক্য পোষণ করা এবং মুয়ামালাত অর্থাৎ লেনদেন এবং মুয়াশারাত অর্থাৎ, সমাজ-জামাতে এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে, আমার আচরণে যেন কারো বাহ্যিক কষ্ট, মানসিক ও আত্মিক সংকীর্নতা বা অস্থিরতা ও বিচলতা সৃষ্টি না হয়। এর নামই সুসামাজিকতা। মোট এই তিনটি বিষয় অর্থাৎ, পরামর্শ ভিত্তিক ঐক্য, স্বচ্ছ কারবার ও সুসামাজিকতা, এর প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্রভাবে কাম্য ও লক্ষ্য। (অর্থাৎ, এর প্রত্যেকটির পৃথক পৃথক বিধান রয়েছে)। সম্মুখোস্থ আয়াত ও হাদীসসমূহ দ্বারা তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবার এগুলোর একটি অপরটির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্তও। যেমন, পরামর্শের উপর তখনই আস্থা হতে পারে, যখন পরামরর্শকারীদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও ঐক্য বিরাজ করবে। এবং ভালোবাসা ও ঐক্য তখনই বলবৎ থাকতে পারে, যখন একজনের দ্বারা অপরজনের বাহ্যিক বা আন্তরিক ক্ষতি বা কষ্ট না হবে। এ বিষয়টি বিপরীত দিক থেকে এভাবে বিশ্লেষণ করা যায় যে, কাউকে কষ্ট বা ক্ষতি থেকে বাঁচানোর পূর্ণ মানসিকতা তখনই হতে পারে, যখন তার সাথে ভালোবাসা ও সহমর্মিতা থাকবে, আর ঐক্য ও ভালোবাসা পূর্ণ উন্নতিতে পৌঁছায় একে অপরকে নিজ পরামর্শে অংশীদার করলে। এ বিশেষ সম্পর্কের কারণে এ বিষয় ত্রয়কে একই বস্ত্তরুপে ধরে নিয়ে একই সঙ্গে সবগুলোর আলোচনা করা হলো। এখন ক্রমানুসারে প্রত্যেকটির বর্ণনা দিচ্ছি।

পরামর্শ:

পরামর্শ করায় দুনিয়ারও লাভ রয়েছে, কারণ, এতে ভুল কম হয়।
হাদীস শরীফে এসেছে-
১. হযরত সাহল বিন সা’আদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘ধীরস্থিরভাবে কাজ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া করা শয়তানের পক্ষ থেকে।’
(তিরমিযী)
ফায়দা: বলা বাহুল্য যে, পরামর্শতে তাড়াহুড়ার প্রতিকার থাকে। এ নির্শেশ সে সমস্ত বিষয়ে প্রযোজ্য, যেগুলোতে বিলম্বের সুযোগ রয়েছে।
পরামর্শ করায় ধর্মীয় ফায়দাও রয়েছে। কারণ, শরীয়তে এর ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-

২. ‘(হে নবী!) আপনি এদের (সাহাবাদের) থেকে বিশেষ বিশেষ ব্যাপারে পরামর্শ নিতে থাকুন। (পরামর্শ গ্রহণের পর) আপনি যখন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন (তা তাদের পরামর্শের পক্ষে হোক বা বিপক্ষে) তখন আল্লাহ তাআলার ‍উপর ভরসা করুন (এবং ঐ কাজ সম্পাদন করুন) নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এমন ভরসাকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)

ফায়দা: বিশেষ বিষয়সমূহ দ্বারা ঐসব বিষয় বুঝানো হয়েছে, যেগুলোর ব্যাপারে ‘ওহী’ অবতীর্ণ হয়নি এবং অথচ তা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, যেগুলো সাধারণ ব্যাপার নয়। কারণ, ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর সে বিষয়ে পরামর্শের কোন সুযোগ থাকে না। আর সাধারণ বিষয়সমূহ- যেমন, দু’বেলার খাবার ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শের বর্ণনা পাওয়া যায় না।

৩. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘সাধারণ লোকদের অধিকাংশ গোপন সলা-পরামর্শের মধ্যে কল্যাণ (সওয়াব ও বরকত) নেই। তবে যারা এমন যে, দান-খয়রাত করতে, কিংবা সৎকাজ করতে কিংবা মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে। (এবং এ সমস্ত কাজের শিক্ষা ও উৎসাহ প্রদানের পূর্ণতা সাধন ও ব্যবস্থাপনার জন্য চেষ্টা-তদবীর ও সলা-পরামর্শ করে) তাদের গোপন সলা-পরামর্শে অবশ্য কল্যাণ (সওয়াব ও বরকত) রয়েছে। (সূরা নিসা-১১৪)

ফায়দা: এ আয়াত দ্বারা এ কথাও জানা গেলো যে, কোন কোন সময় গোপন সলা-পরামর্শই কল্যানের দাবী।

৪. আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন-
‘এবং তাদের (ঈমানদারদের পরামর্শযোগ্য) সমস্ত কাজ তাদের পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে হয়।’ (সূরা শুরা)

ফায়দা: পরামর্শ করে কাজ করার কারণে ঈমানদারদের প্রশংসা করা, পরামর্শ প্রশংসিত হওয়ার স্পষ্ট দলীল।

৫. হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিক আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বদরে যাওয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের সঙ্গে) পরামর্শ করেন।
(মুসলিম)
৬. হযরত মায়মুন বিন মিহরান (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, (কোন বিষয়ে যখন হযরত আবু বকর (রাযিঃ) কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ না পেতেন, তখন) বড় বড় ব্যক্তি এবং নেককার লোকদেরকে সমবেত করে তাদের থেকে পরামর্শ নিতেন এবং তাদের সর্বসম্মত মত অনুপাতে ফয়সালা দিতেন। (হিকমতে বালিগ, দারামী)

ফায়দা: সবার ঐক্যমত হওয়া আমলের জন্য শর্ত নয়। (কারণ, যাকাত বিরোধীদের বিরুদ্ধে একদলের মতবিরোধ সত্ত্বেও তিনি লড়াইয়ের সংকল্প গ্রহণ করেন।)

৭. হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত উমর (রাযিঃ) এর পরামর্শ সভার সদস্যগণ আলেম ছিলেন। তারা বয়স্ক হোক বা তরুণ। (বুখারী)

ফায়দা: শেষের হাদীসত্রয় দ্বারা জানা গেলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবু বকর (রাযিঃ) এবং হযরত উমর (রাযিঃ)-এর পরামর্শ গ্রহণের অভ্যাস ছিলো।

৮. হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন – যখন তোমাদের কেউ নিজ (মুসলমান) ভাই থেকে পরামর্শ নিতে চায় তখন তাকে পরামর্শ দেওয়া উচিত। (ইবনু মাজা)

এখন পরামর্শের কিছু আদব ও নীতি উল্লেখ করা হচ্ছেঃ

৯. হযরত কা’আব বিন মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন লড়াইয়ের ইচ্ছা করলে (সাধারণতঃ) অন্য কোন ঘটনা দ্বারা তা গোপন রাখতেন।…(বুখারী)

ফায়দা: এতে জানা গেলো, যে পরামর্শ প্রকাশ করা ক্ষতিকর তা প্রকাশ করা উচিত নয়।

১০. হযরত জাবের (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন –
‘মজলিসসমূহ আমানতের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ, কোন মজলিসে কোন বিষয়ে কথা হলে তা বাইরে আলোচনা করা উচিত নয়। (এর মধ্যে পরামর্শের মজলিসও এসে গেলো।) তবে তিনটি মজলিস ছাড়া…।’ (আবু দাউদ)

ফায়দা: সেই তিন মজলিসের সারকথা হলো, কারো জানমাল বা সম্মান হরণ করার পরামর্শ বা আলোচনা হলো, তা গোপন করা জায়েয নেই। যখন ব্যক্তি বিশেষের ক্ষতির সম্ভাবনার ক্ষেত্রে মজলিসের কথা প্রকাশ করা গুনাহ, তখন যা প্রকাশ করায় সাধারণ মুসলমানের ক্ষতি রয়েছে, তা প্রকাশ করা তো অধিকতর গুনাহের কাজ হবে। সুতরাং ইরশাদ হচ্ছে-

১১. হযরত হাতিব বিন আবি বুলতাআহ (রাযিঃ) অসৎ নিয়তে নয়, বরং ভুল বুঝে রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমনই একটি গোপন বিষয়ের কথা মক্কার কাফিরদের নিকট পৌঁছিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে ‘সূরায়ে মুমতাহিনার’ প্রথম কয়েক আয়াতে সতর্ক করা হয়েছে। (আইনে দুররে মানসূর ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ)

বরং যে বিষয়েরই সম্পর্ক সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে হবে, যদিও তা প্রকাশ করায় কোন ক্ষতি আছে বলেও জানা না যায়, তবুও বিবেকও শরীয়তের নিরীখে এসব বিষয়ের দায়িত্বশীল লোকদের নিকট ছাড়া সাধারণ লোকদের নিকট প্রকাশ করা উচিত নয়। কারণ, হতে পারে যে, এর ক্ষতির দিক পর্যন্ত তার দৃষ্টি পৌঁছায়নি।

১২. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন –
‘আর যখন তাদের কাছে পৌঁছে (নতুন) কোন বিষয়ের সংবাদ শান্তি সংক্রান্ত বা ভয়ের, তখন তারা সেগুলোকে (অবিলম্বে) রটিয়ে দেয়। (এর মধ্যে পরামর্শ সংক্রান্ত সংবাদ ও মজলিসের কথাও অন্তর্ভুক্ত। অথচ কখনো সেগুলো ভুল সংবাদ হয়ে থাকে, বা সেগুলো প্রচার করা অসঙ্গত হয়ে থাকে) আর ‍যদি (নিজেরা না রটিয়ে) তারা সেগুলো পৌঁছে দিতো রাসূল পর্যন্ত এবং যারা এসব বিষয় বুঝতে সক্ষম তাদের পর্যন্ত (অর্থাৎ বড় বড় সাহাবী পর্যন্ত এবং নিজেরা এতে কোন দখল না দিতো) তখন অনুসন্ধান করে দেখা যেতো সে সব বিষয়, যাতে রয়েছে অনুসন্ধান করার মত ব্যাপার। (তারপর এরা যেভাবে কাজ করতেন, রটনাকারীদেরও উচিত ছিলো সেভাবে কাজ করা।) (সুরা নিসা-৮৩)

ফায়দা: এ আয়াত দ্বারা অধিকাংশ পত্রপত্রিকার সীমা লংঘন করার বিষয় জানা গেলো। তবে যে সমস্ত পত্রিকা সীমার মধ্যে থাকে, সেগুলো উপকারী হওয়ার বিষয় নিম্নের হাদীস দ্বারা জানা যায়।

১৩. হযরত ইবনে আবি হালা (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সাহাবীদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন এবং (বিশেষ) ব্যক্তিদের থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন যে, (সাধারণ) লোকদের মধ্যে কী ঘটনা ঘটছে? (শামায়িলে তিরমিযী)

ঐক্য:

১৪. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে (আল্লাহর দেওয়া দ্বীনকে) একতাবদ্ধ হয়ে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)

১৫. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘এবং তাদের (মুসলমানদের) অন্তরের মধ্যে একতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’ (সূরা আল আনফাল-৬৩)

ফায়দা: আল্লাহর অনুগ্রহ ও নেয়ামতের উল্লেখ করতে গিয়ে একথা বলায় বোঝা গেলো যে, ‘ঐক্য অনেক বড় নেয়ামত।

১৬. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘এবং (সমস্ত ব্যাপারে) আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো (অর্থাৎ, শরীয়তবিরোধী কোন কাজ করো না) এবং পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। তা না হলে (পারস্পরিক অনৈক্যের কারণে) তোমরা হীনবল হয়ে পড়বে (কারণ, তখন জাতি শতধাবিভক্ত হয়ে যাবে। একের প্রতি অন্যের আস্থা থাকবে না, তখন একা মানুষ কিছুই করতে পারবে না।) এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে। কারণ, অন্যেরা যখন এই অনৈক্যের কথা জানবে, তখন এ পরিণতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে।’ (সূরা আনফাল-৪৬)

ফায়দা: এতে অনৈক্যের নিন্দা এবং আসল বিষয় আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য অর্থাৎ দ্বীন হওয়া –উল্লেখিত হয়েছে।

১৭. হযরত আবুদ দারদা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- আমি কি তোমাদের এমন জিনিসের সংবাদ দেবো না, যা (তার কতিপয় প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে) রোযা, সদকা (যাকাত) ও নামাযের মর্যাদার চেয়েও উত্তম। লোকেরা নিবেদন করলো- অবশ্যই বলুন। তিনি ইরশাদ করলেন-
‘তা হলো, পারস্পরিক সম্পর্ককে ঠিক রাখা আর পরস্পরে বিগড়ে যাওয়া (ধর্মকে) মুন্ডনকারী (ধ্বংসকারী) বস্ত্ত।’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)

যেসব বিষয় দ্বারা ঐক্য সৃষ্টি হয় বা ঐক্য বজায় থাকে অর্থাৎ, পরস্পরের হকসমূহের ব্যাপারে খেয়াল রাখা এবং যে সমস্ত বিষয় দ্বারা অনৈক্যের সৃষ্টি হয় অর্থাৎ, পরস্পরের হক আদায়ে ত্রুটি করা। সে সবের বর্ণনা নবম ‍রূহে করা হয়েছে।

স্বচ্ছ কারবার ও সুসামাজিকতা:

যারা দ্বীন সম্পর্কে সামান্যও সজাগ, তারা কায়-কারবারের স্বচ্ছতার ব্যাপারে কিছুটা হলেও লক্ষ্য রাখে এবং একে ধর্মের বিষয় বলে মনে করে। মাসআলা জানা না থাকার কারণে কোন ত্রুটি হয়ে গেলে সে ভিন্ন কথা। এর সহজ সমাধান হলো- আমার পুস্তিকা ‘সাফাইয়ে মুয়ামালাত’ এবং বেহেশতী যেওরের পঞ্চম খন্ড দেখে নিবে বা কারো দ্বারা পড়িয়ে শুনে নিবে বা যে বিষয় সামনে আসবে তার বিধান কোন আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করে নিবে। আর নিজে এ ব্যাপারে সজাগ না হলে পাওনাদার নিজেই তাগাদা দিয়ে তাকে সজাগ করে দেয়। তার কান খুলে দেয়। তাই এস্থলে এ ব্যাপারে লেখার প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্ত্ত সুসামাজিকতার বিষয়ে অনেক দ্বীনদার লোকও খেয়াল করে না। বরং মনে করে এগুলো পার্থিব ব্যবস্থাপনার বিষয় মাত্র। ধর্মের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। তাই এ ব্যাপারে কিছুমাত্র পরোয়া করে না। এ প্রসঙ্গে কিছু আয়াত এবং হাদীস লিখছি।

১৮. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ (অর্থাৎ, নিজেদের জন্য নির্ধারিত গৃহ বা কক্ষ, যার মধ্যে অন্য কারো থাকার সম্ভাবনা নাই) ব্যতীত অন্য গৃহে (যেগুলোতে অন্য লোক বসবাস করে-তারা পুরুষ হোক চাই নারী এবং মাহরাম হোক চাই গায়ের মাহরাম) প্রবেশ করো না। যতক্ষণ পর্যন্ত (তাদের থেকে) অনুমতি গ্রহণ না করো। (একটু পরে ইরশাদ করেন) আর যদি অনুমতি চাইলে তোমাদেরকে বলা হয় যে, (এ সময়) ফিরে যাও, তাহলে তোমরা ফিরে যাবে। (তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরও যদি অনুমতি পাওয়া না যায়, তাহলে এমতাবস্থায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসেও এসেছে।) (সূরা নূর-২৭)

ফায়দা: অনুমতি চাওয়ার এ বিষয়টি নারী ও পুরুষ উভয়ের ঘরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতে তিনটি উপকারিতা রয়েছে-

১. ঘরের অধিবাসীদের কোন অবৈধ অবস্থার উপর দৃষ্টি না পড়া।
২. এমন কোন বিষয়ে অবগত না হওয়া, যে বিষয়ে অবগত হওয়া তার অপছন্দ।
৩. অনেক সময় মনের উপর চাপ সৃষ্টি হয়, চাই বিশ্রামে বিঘ্ন ঘটার কারণে হোক বা কোন কাজে ক্ষতি হওয়ার কারণে হোক বা সাক্ষাত করতে মন না চাওয়ার কারণে হোক।

১৯. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘হে মুমিনগণ! যখন (মজলিসের প্রধান ব্যক্তি) তোমাদেরকে বলেন যে, মজলিসে স্থান প্রশস্ত করে দাও (যাতে করে অন্য আগন্ত্তকরা জায়গা পায়) তখন তোমরা স্থান প্রশস্ত করে দিও। আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে (জান্নাতের মধ্যে) স্থান প্রশস্ত করে দিবেন। আর যখন (কোন জরুরতে) বলা হয় যে, (মজলিস থেকে) উঠে যাও, তখন উঠে যেয়ো। (নির্জনতা লাভের প্রয়োজনে উঠে যেতে বলুক, বা অন্যত্র বসানোর জন্য উঠে যেতে বলুক।)’ (সূরা মুজাদালা-১১)

২০. হযরত আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার পালার রাতে (প্রথমে) বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তারপর এত সময় দেরী করলেন যে, তিনি বুঝলেন- আমি ঘুমিয়ে গেছি, তারপর নিজের চাদরটি আস্তে করে (সরিয়ে) নিলেন। পবিত্র পাদুকা নীরবে পরিধান করলেন। আস্তে দরজা খুললেন, এবং ‘জান্নাতুল বাকী’তে গমন করলেন। তারপর (ফিরে এসে এর কারণরুপে) ইরশাদ করলেন-‘আমি মনে করেছি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। আমি তোমাকে জাগানো পছন্দ করিনি এবং আমার আশংকা হয়েছে (যে, তুমি জেগে) একাকী ভয় করবে।’ (মুসলিম)

ফায়দা: হাদীসের মধ্যে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি সমস্ত কাজ এজন্য আস্তে করেছেন, যেন হযরত আয়েশার কষ্ট না হয়। জেগে যাওয়ার কষ্ট বা ভয় পাওয়ার কষ্ট।

২১. হযরত মিকদাদ (রাযিঃ) থেকে (দীর্ঘ একটি হাদীসে) বর্ণিত আছে যে, আমরা তিন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহমান ছিলাম এবং তার সেখানেই অবস্থান করছিলাম। ইশার নামাযের পর শুয়ে থাকতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেরীতে তাশরীফ আনলেন-মেহমানদের ঘুমিয়ে পড়ার এবং জেগে থাকার উভয়টার সম্ভাবনা ছিলো বিধায় আস্তে করে সালাম করতেন। যাতে করে জেগে থাকলে সালাম শুনতে পায়, আর ঘুমিয়ে থাকলে জেগে না যায়। (মুসলিম)

সুসামাজিকতার বিষয়টি এখানে সংক্ষেপে লিখলাম। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ‘আদাবুল মুয়াশারাত’ পুস্তিকা এবং বেহেশতী যেওরের দশম খন্ডের শুরু থেকে ‘পেশা ও কারিগরীর বর্ণনা’ পর্যন্ত অবশ্যই দেখবে বা পড়িয়ে শুনে নিবে।

এসব ক’টি হাদীস মেশকাত শরীফ থেকে সংগৃহীত, তবে অন্যান্য গ্রন্থ থেকে যেগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে তার নাম লিখে দেওয়া হয়েছে।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: