বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১১ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আন্তর্জাতিক

তালেবান বনাম পশ্চিমা সভ্যতা

 প্রকাশিত: ০৮:২০, ১৪ অক্টোবর ২০২১

তালেবান বনাম পশ্চিমা সভ্যতা

দীর্ঘদিন মার্কিন শাসন শোষণে নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েও হার না মানা এক জাতির নাম হচ্ছে তালেবান। দেড় যুগেরও অধিক সময় ধরে তারা নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তুর ন্যায় বসবাস করে আসছিল। যাদের ঘুম ভেঙ্গেছে বোমার আওয়াজে, প্রহর গড়িয়েছে নিকটজনের ক্ষত-বিক্ষত মৃত শরীরের ভার বহন করে। শেষমেশ নানা চড়াই-উৎরাই, রক্ত পিচ্ছিল পথ পারি দিয়ে মহান আল্লাহর রহমতে তারা স্বাধীনতা লাভ করেছে।

তালেবানের কাবুল জয়ের পর থেকে উদ্বেগ ছিল যে, তারা মেয়েদের শিক্ষার অধিকার রুদ্ধ করে দেয় কি না। কিন্তু না, তারা পর্দাসাপেক্ষে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বহাল রাখার নীতি নিয়েছে। তারা সহশিক্ষা অনুমোদন করেনি; ছেলে ও মেয়েদের আলাদা প্রতিষ্ঠানে পড়ার নির্দেশ জারি করেছে। বলেছে, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা অর্জনে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এর আগে কাবুলে একটি সংবাদ সম্মেলনেও তারা বলেছিল, শরিয়াহ মোতাবেক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন খাতে নারীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। নারীদের ব্যাপারে তালেবানের বর্তমান অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবমুখী বলে মনে হচ্ছে।

২০১০ সালে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডস আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নিলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট হোঁচট খায়। এর ফলে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রও নেদারল্যান্ডসকে অনুসরণ করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে সিআইএ ফেমিনিজম তত্ত্ব ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয়। উদ্দেশ্য হলো আফগানিস্তানের মেয়েরা অরক্ষিত এবং তালেবান ক্ষমতায় এলে তারা আবারো নির্যাতনের শিকার হবে- এমন মানবিক আবেদন ন্যাটোর অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা, যাতে তাদের আর কেউ আফগান যুদ্ধ থেকে সরে না পড়ে। উইকিলিক্সে ফাঁস হওয়া সিআইএর ক্লাসিফায়েড নথি থেকে সংস্থাটির এ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায়। এ বিষয়ে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে-
A leaked CIA document suggests recruiting Afghan women to help drum up support for the war in Afghanistan. The intelligence agency is concerned about waning enthusiasm for the NATO effort, especially in Europe. (27 March 2010).
প্রধানত নারী ইস্যুতে পাশ্চাত্য মিডিয়া যারপরনাই প্রপাগান্ডা চালিয়ে তালেবানকে অমানবিক ও নিন্দনীয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে গেছে। সেই নিরবচ্ছিন্ন প্রপাগান্ডায় অনেকেই প্রভাবিত। কিন্তু তালেবান তাদের বিগত শাসনামলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া এবং ঘর থেকে বেরোনোর ক্ষেত্রে কেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেটি অনেকেই খতিয়ে চিন্তা করেনি; বরং পাশ্চাত্য মিডিয়া যেভাবে প্রচার করেছে, অনেকেই সেভাবে সোজাসাপ্টা গ্রহণ করেছে।

দখলদার সোভিয়েতরা পরাজিত হয়ে ভেগে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে শুরু হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। তালেবান দেশের ৮৫ শতাংশ ভ‚মির নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং সেখানে ইসলামিক আমিরাত গঠন করে। আর বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ থাকে তালেবানের প্রতিপক্ষ নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের হাতে। নর্দার্ন অ্যালায়েন্স তালেবানের বিরুদ্ধে তখন সশস্ত্র যুদ্ধ করছিল। এরকম অস্থির গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে মেয়েদের সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাদের স্কুলে যাওয়া ও ঘর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তালেবানের ইসলামিক আমিরাত। অথচ পাশ্চাত্য মিডিয়া এটিকে পুঁজি করে অব্যাহত প্রচারণার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তালেবানকে বর্বররূপে উপস্থাপন করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক আগ্রাসনকে জায়েজ করতে থাকল।

আমেরিকা তালেবানকে ‘নারীবিদ্বেষী’ হিসেবে তুলে ধরার শত চেষ্টা করলেও নারীর প্রতি খোদ আমেরিকার আচরণ কেমন, তা অবশ্যই দেখার বিষয়। কারণ আমেরিকার হাতে বন্দী একজন মুসলিম নারী স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. আফিয়া সিদ্দিকী জেলে মার্কিন সেনাদের হাতে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে (১৯ জুন ২০১৮, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন)। অথচ ইভান রিডলে নামে এক নারী ব্রিটিশ সাংবাদিক তালেবানের হাতে বন্দী অবস্থায় কেমন আচরণ পেয়েছিলেন, তা আমরা জানি। শত্রুর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক হওয়ার পরও তালেবানের সম্মানজনক সদাচারে মুগ্ধ হয়ে তিনি পরে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নতুন নাম মরিয়ম রিডলে। মুক্তির পর বন্দিদশা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘They (the Taliban) treated me with respect and courtesy’ (8 Oct. 2001, CNN)। এ ছাড়া মুক্তির পর তাকে বিধ্বস্ত নয়, বরং বেশ খোশমেজাজেই দেখা গিয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। তবুও পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচারণায় তাড়িত হয়ে অবলীলায় তালেবানকে সাব-হিউম্যান বা হাফ-হিউম্যান বলে অবজ্ঞা করতে অনেকের দ্বিধা হয় না। তর্কের খাতিরে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই অযৌক্তি হবে না যে, আফগান ভ‚মিতে সামরিক আগ্রাসনের দুই দশক ধরে নৃশংস হত্যালীলা চালানো আমেরিকানদের চেয়েও কি তালেবান বেশি বর্বর?

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: