বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১১ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

কোভিড-১৯: দায়িত্ব ও ঐক্যবদ্ধ শক্তির অনুপম অনুভূতি

 প্রকাশিত: ১০:৫১, ১০ জুলাই ২০২১

কোভিড-১৯:  দায়িত্ব ও ঐক্যবদ্ধ শক্তির অনুপম অনুভূতি

নিঃসন্দেহে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক নজীর বিহীন সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এখনো কোভিড-১৯ বিভিন্ন স্থানে তার ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। সেইসাথে এর ফলে জনসাধারণের সব স্তরের জীবনযাপন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 

ক্রমবর্ধমান দুশ্চিন্তা, আতংক, ভয় এবং দুঃখ বয়ে আনার সাথে সাথে এই মহামারী যেন অভূতপূর্ব প্রক্রিয়ায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র এক অণুজীব যেন সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। 

পুরো বিশ্ব এখনো এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। মাসব্যাপী দীর্ঘ লকডাউন প্রক্রিয়া থেকে সামান্য সময় কিংবা সব পুনরায় খুলে দেয়ার মাধ্যমে আমরা পরিস্থিতির সাথে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াচ্ছি। কোনো কোনো দেশ ভাইরাসকে সাথে নিয়েই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

 এটি মাথায় রেখেই দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত আর তা হলো - দায়িত্ববোধ এবং একতাবদ্ধ হওয়া। 

 এই মহামারী মোকাবেলা এবং এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য এই দুটো বিষয়েরই খুব প্রয়োজন। 

দায়িত্ববোধ 
ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগিয়ে, করোনা ভাইরাস যেন আমাদের মধ্যকার দায়িত্ববোধকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সবাই এখন দায়িত্বশীল হওয়ার গুরুত্ব অনুভব করছে। সেই দায়িত্বের পরিধি যেমন শুরু হয়েছে নিজের প্রতি দায়িত্বের ভিত্তিতে, তেমনি জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছুর প্রতিই ব্যক্তি দায়িত্বশীল। তার অধীনে যা আছে; পরিবারের প্রতি দায়িত্ব থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিও সে দায়িত্ববান হওয়ার চেষ্টা করছে। অবশ্য রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের উত্তম গুণাবলী থাকা প্রয়োজন। 

  ইসলামের অন্যতম সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো দায়িত্ব। এটি শিষ্টাচার, আচরণ এবং মানুষকে উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হবে তার নির্দেশিকা প্রদান করে। সেইসাথে এটি ইসলামি বিশ্ব দর্শনের মূলনীতি, যার মাধ্যমে অধিকার এবং সম্পত্তি রক্ষার জন্য  যথাযথ একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। 

 এই বিষয়টি দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা - উভয়ের সমন্বয়ে সৃষ্ট। একজন সত্যিকার মুসলিম কীভাবে চিন্তা করে তা জানার পেছনে এই দুটো দিকই পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। সেইসাথে একজন মুসলিম কীভাবে ঐশী গ্রন্থের আলোকে মহাবিশ্বের সাথে একাত্ম হন তা জানতেও দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার ভূমিকা-ই সবচেয়ে বেশি। দায়বদ্ধতা নিশ্চিতভাবেই এই ধারণাগুলোর মাঝে একটি। 

দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রবিশেষ
ইসলামে দায়িত্ববোধের মূল কেন্দ্র ব্যক্তি নিজে। সেইসাথে প্রত্যেকেরই কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই অর্থে যে, শরীয়াহ'র দৃষ্টিতে প্রত্যেক ব্যক্তির আইনী অধিকার গঠনের জন্য যা যা লাগে তা এভাবেই তাকে দায়িত্ববান ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করে। কিংবা কুরআন যেমন বলেছে, তেমন বিশ্বাসী ও যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করে - 

 " আমি আকাশ পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এই আমানত পেশ করেছিলাম, অতঃপর তারা একে বহন করতে অস্বীকার করল এবং এতে ভীত হল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয় সে জালেম-অজ্ঞ। "
           (সূরা আল আহযাব ; ৭২)

উপরোক্ত আয়াতটি যা নির্দেশ করে তা হলো - মানুষকে যেমন নির্দিষ্ট কিছু সম্ভাবনা ও বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করা হয়েছে যার মাধ্যমে সে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ উপাধি পেয়েছে ; তেমনি সেই সম্ভাবনাগুলো বিকশিত করে তোলার জন্য তার নিজেরও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। মানুষের প্রতি এটাই আশা করা হয়েছে যে সে যা বহনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা সে রাখতে সফলকাম হবে। 

নৈতিকতা ও আইনি বাধ্যবাধকতা
সমাজের প্রতিটি মানুষকেই কিছু না কিছু বাধ্যবাধকতা মেনে কাজ করতে হয়। যদি সেটা সীমালঙ্ঘনের কাতারে পড়ে যায় তখন সেটা দণ্ডনীয় হয়ে উঠে। 

তাই, এ সকল দায়বদ্ধতা মেনে চলা আপনার অধিকারভুক্ত। এগুলো আপনার ব্যক্তিগত অধিকারের পর্যায়েই পড়ে যা আপনার দেহ ও আত্মার সাথে সম্পর্কিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

 " তোমার দেহের উপর রয়েছে তোমার অধিকার, তোমার দৃষ্টির উপর রয়েছে তোমার অধিকার। "
                           (বুখারী) 

যদি বর্তমান করোনা সংকটের সাথে মিল খুঁজতে যাই তো আমরা সহজেই অবগত হতে পারি যে ব্যক্তিগত অধিকার ও শারীরিক সুরক্ষার বিষয়ে এ সকল নির্দেশনাবলী আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যিনি দায়িত্ববান, তিনি প্রথম থেকেই এগুলোর উপর সজাগ দৃষ্টি রাখছেন।

কোভিড-১৯ এর ব্যাপারে সতর্কতা 
বর্তমানে করোনা ভাইরাস আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য সবাইকে সাহস জোগাতে এ সংকট মোকাবিলায় আরও নিত্যনতুন পন্থা বের করতে হবে। 

তাই, এ সংকটময় পরিস্থিতি আমাদের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। তিনি এ পরীক্ষার দ্বারা আমাদের বিশ্বাস, দক্ষতা, অর্জিত জ্ঞান, ধৈর্য্য সবকিছুরই পরীক্ষা নেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান সময়ে মানুষ তার অল্পকিছু প্রযুক্তিগত বিদ্যার দ্বারা দম্ভ প্রকাশ করছে। 

কিন্তু হঠাৎ আপতিত এ পরীক্ষা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে যে আমাদের এতো এতো বছরের প্রযুক্তি, সাফল্য এ সকলই যেন বৃথা। 

এটিও লক্ষণীয় যে বর্তমানে এ ভাইরাসটি তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতে এমনভাবেই হানা দিয়েছে যে এখন পর্যন্ত সেই ধকল তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। 

প্রকৃতির এ রূঢ়চিত্রের মাঝেও মানুষ কখনও আত্মসমর্পণ করতে শিখেনি, মানুষ সর্বদা সব প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জের সাথে লড়াই করে মোকাবিলা করতে শিখেছে। এ কারণেই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে, বিশ্বে টিকে থাকা সমস্ত জাতিই তাদের সম্ভাব্য উপায়গুলো ব্যবহার করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবং এটিই মানবজাতির আসল প্রতিচ্ছবি; মানুষ বিশ্বাস করে যে আল্লাহ তা'আলা তাকে এজন্যই সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে এই যুদ্ধে জিততেই হবে। 

কীভাবে এ পরীক্ষায় পাস করবেন
হ্যা, মানুষ যদি তার দায়িত্ববোধ থেকে বিচলিত হয়ে না পড়ে তাহলে তার এ যুদ্ধে জয়লাভের সুযোগ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তাকে ভরসা দিয়েছেন এই সত্যটি মেনে নিয়ে মানুষ জয়লাভ করতে পারে। সুতরাং মানুষকে দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথে আন্তরিকভাবে তা বিশ্বাস করতে হবে।

এই পরিস্থিতিতে বিপর্যয়, সংঘাত ইত্যাদির স্মরণ খুবই কষ্টদায়ক। পুরুষরা যদি দায়িত্বশীলতার সাথে এ অবস্থা মোকাবিলা করার মানসিকতা অর্জন করতো তবে সহজেই এটি দূর করা যেত। 

মহান আল্লাহ বলেন,
" যে কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎ পথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথ ভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। "
          (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত ১৫) 

একিলিসের দূর্বলতার মতো অসতর্কতা আমাদের সমস্ত কাজের অন্তরায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কোভিড-১৯ এর প্রতি অসতর্কতা বর্তমানে মৃত্যুর হার কীভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজের প্রতি দায়বদ্ধতা, অসচেতনতা এই ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ। 

দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে মানুষ ভুল পথেই অগ্রসর হয় বেশি এবং সত্যকে উপহাস করে তারা দূরে ঠেলে দেয়। তারা এমনকিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করে যার কোনো পরিপূর্ণ নির্দেশনা নেই। যার ফলে তারা নিজেদের ধ্বংস ঢেকে আনে। পবিত্র কুরআনে রয়েছে, 

" যদি আমি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তাতে ওরা দিনভর আরোহণ ও করতে থাকে ; তবুও ওরা একথাই বলবে যে, আমাদের দৃষ্টির বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে না বরং আমরা যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। "
                (সূরা আল-হিজর, আয়াত ১৪-১৫)

 একতা 
সুসংবাদ হচ্ছে এই যে মানুষ একটি সামাজিক জীব। একে অপরের পাশে থাকা এবং একে অপরের কেয়ার করার মত ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক। 

 এটি ইসলামিক গুণাবলীর মাঝেও অন্যতম। কোভিড-১৯ এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যের জীবনরক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সাহসী এবং সুন্দর ছবিগুলো বারংবার আমাদের সামনে আসছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং দাতা সংস্থাগুলো অন্যের প্রয়োজনে নিজেদের সর্বোচ্চ বিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

ইসলামে শুধুমাত্র শাহাদাহ কিংবা বিশ্বাসের ঘোষণা দেয়াই যথেষ্ট নয় ; বরং এই সাক্ষ্য অনুযায়ী কাজেও শামিল হতে হবে। এই কাজ করার জন্য শর্ত রয়েছে। একটি হলো - ইখলাস বা বিশুদ্ধ নিয়্যাত এবং আরেকটি হলো 'শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য' এই মনোভাব। 

একজন সত্যিকার মুসলিম অন্যকে খুশি করা কিংবা লোক দেখানোর জন্য কোনো কাজ করবে না: 

(তারা বলে,) ‘শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে অন্নদান করি, আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।' 
        (সূরা আল-ইনসান; ৯)
অতএব, অন্যকে সাহায্য করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের পূর্বে অবশ্যই নিজের নিয়্যাতকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। 

কোভিড-১৯ কে 'ইহসান' বা শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে মোকাবেলা
এটি আপনাকে শ্রেষ্ঠত্ব বা উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে ;  যেটি বিশ্বাসের সর্বোচ্চ চূড়া এবং আল্লাহর সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তিত্ব। 

রাসূল (সা) এর কথা অনুযায়ী 'ইহসান' বলতে আল্লাহর জন্যই কাজ করা বোঝায়। আল্লাহকে না দেখেও আপনি তার জন্যই সবকিছু করবেন যেহেতু তিনি আপনাকে দেখছেন। 

এক্ষেত্রে অবশ্য একতাবদ্ধ হয়ে থাকা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ এর এই মহামারীর ক্রান্তিকালে বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং সব বিশ্বাসের মানুষের এগিয়ে আসছে। মানবতার কল্যাণে ভ্রাতৃত্বের এই অনুপম সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।  

একে অপরের খোঁজ নেয়ার এই প্রথাটি আমাদের চালিয়ে যাওয়া উচিত। যে কারো প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে শারীরিক কিংবা মানসিক সহায়তা করতে হবে। এই একত্রে বাঁচার মতো দারুণ ব্যাপারটিই দূর্যোগপূর্ণ সময়ের নেতিবাচক দিক থেকে আমাদের দূরে রাখবে। সেইসাথে অদ্ভুত এক ভালো লাগা এবং আশায় অন্তর ভরে উঠবে। 

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: