বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

এডিটর`স চয়েস

কোভিড-১৯: আমাদের প্রতিক্রিয়া যদি রাসূল সাঃ এর দেখানো পন্থায় হতো!

 প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ৯ জুলাই ২০২১

কোভিড-১৯: আমাদের প্রতিক্রিয়া যদি রাসূল সাঃ এর দেখানো পন্থায় হতো!

"তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর (চরিত্রের) মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।"
                     (সূরা আহযাব; আয়াত:২১)
কুরআন আরও বলেছে,
রাসূল (সা) কে মানবজাতির প্রতি রহমতস্বরূপ সৃষ্টি করা হয়েছে। 
         (সূরা আহযাব; আয়াত: ১০৭)
রহমতের নবী, যার জীবন মানবজাতির জন্য সবচেয়ে উত্তম দৃষ্টান্ত, তিনি কীভাবে এই বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস মহামারী সামাল দিতেন? 
রাসূল (সা) কোনো চিকিৎসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন না কোনো ফার্মাসিস্টও। তিনি ছিলেন একজন বার্তাবাহক যার প্রধান কাজ ছিল কথা এবং কাজের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি পর্যায় সম্পর্কে নির্দিষ্ট পথ প্রদর্শন করা, তাঁর সম্প্রদায় এবং তাঁর পরবর্তীতে যারা আসবে তাদের সবার কাছেই।

সংকটময় পরিস্থিতিতে রাসূল (সা) এর নেতৃত্বের ধরন কেমন ছিল সে ব্যাপারে পড়াশোনা করলে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পারবো। 

 পরামর্শ 
জনসম্পর্কিত কোনো বিষয়ে রাসূল (সা) সবসময় তাঁর সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন। 
যদিও কিছু কাজের ক্ষেত্রে কেবল সাধারণ জ্ঞান প্রয়োজন, তবুও নবী করিম (সা) বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন যাতে মহামারী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সতর্কতা সম্পর্কে লোকজনকে পরামর্শ দেওয়া যায়। 

   "...আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর তুমি কোন সংকল্প গ্রহণ করলে আল্লাহর প্রতি নির্ভর কর। নিশ্চয় আল্লাহ (তাঁর উপর) নির্ভরশীলদের ভালবাসেন।"
             (সূরা আল-ইমরান; আয়াত: ১৫৯)

মূলত এই আয়াতে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে যারা উহুদ যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। 

যদিও মুহাম্মদ (সা) কোনো মহামারী সরাসরি প্রত্যক্ষ করেননি তবুও অসুবিধাজনক পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে তার নেয়া তড়িৎ পদক্ষেপের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। 

১. এক বৃষ্টির দিনে তিনি মানুষদেরকে জুম্মার সালাত ঘরে আদায়ের নির্দেশ দেন। 

 ২. এক প্লেগের সময় তিনি মানুষকে কোয়ারেন্টাইন মানতে বলেন। 

 ৩. তিনি তাদেরকে ঐ এলাকায় যেতে বা এলাকা থেকে বের হতে নিষেধ করে সামাজিক দূরত্ব বজায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

 ৪. সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারটি তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। 

 ৫. এ কারণে তিনি বাইতুল মাল উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং অবস্থাপন্ন লোকদের দানের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছিলেন। 

 ৬. সামর্থ্যহীনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে তিনি একটি স্যুপ রান্নাকেন্দ্র খুলেছিলেন। 

 ৭. প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিতরণের জন্য তিনি একদল স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করেন। 

৮. সংকটকালীন সময়ে তিনি ব্যবসায়ী এবং বণিকদেরকে দ্রব্যমূল্য কমানোর নির্দেশ দিতেন। 

 ৯. তিনি মানুষদের চিকিৎসা নিতে বলতেন। না নিলে বকাঝকা করতেন। 

 ১০. তিনি সবসময় পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার নির্দেশ দিতেন। তা শুধু ওযু করার সময় দিনে পাঁচবার হাত ধোয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সবসময় শারীরিক পরিচ্ছন্নতার দিকে গুরুত্ব দিতেন। 

 ১১. তিনি সবসময় জনসম্মুখে আবর্জনা ফেলতে বাঁধা দিতেন, বরং সেগুলো নিরাপদে মাটিতে পুতে ফেলার ব্যবস্থা করতেন। 

 জীবনের পবিত্রতা
কুরআনে সকল বিশ্বাসীদের প্রতি মর্যাদার কথা উল্লেখ রয়েছে- 

“আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, স্থলে, জলে তার চলাচলের জন্য বাহন দিয়েছি, তাদের উত্তম রিজিক দিয়েছি এবং আমার অন্য সকল সৃষ্টি থেকে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।“ 
                      (সূরা বনী ইসরাঈল; আয়াত: ৭০) 

সংকটকালীন সময়ে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পবিত্রতা এবং নিজেকে পাপ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এসব বিষয়ে সাহাবাদের সাথে মতবিনিময় করতেন। 

মানবদেহের প্রতিটি রোগের নিরাময়ের জন্য নবী করিম (সাঃ) বিজ্ঞানীদের শরীরচর্চা, ভেষজবিজ্ঞান এবং জলবায়ু সম্পর্কে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাসুল (সাঃ) এর সময়ে কোনো ল্যাব কিংবা হাসপাতাল ছিল না। তখনকার সময়ের ডাক্তার বা হাকিমদের কাছে সাধারন জনগণকে পরামর্শ নিতে বলতেন। 

রাসুল (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহ তা’আলা রোগ-বালাই এবং এর প্রতিকার দুই-ই দিয়েছেন এবং প্রত্যেক রোগের জন্য তিনি নিরাময় বাবস্থা রেখেছেন। তাই কোনোকিছুই কারণ ব্যতীত তিনি দেননি।“ 
                    (সুনানে আবু-দাউদ) 

বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনি নিয়মিত অনুশীলন এবং শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সুষম খাদ্যতালিকা অনুসরণ করতে বলেছেন। 

ভীষণ অসুস্থতা বা সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে রাসুল (সাঃ) রোগীদের আলদা থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। 

কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার দাফনকার্জ দ্রুত সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছেন।

আর যদি মৃত ব্যক্তি যদি কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তবে তার লাশটি মসজিদ বা লোকালয় থেকে দূরে রাখবার জন্য বলা হয়েছে। 

 পূর্বে কোনো রোগে মারা যাওয়া বা যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর কাফন বা কোনোরূপ গোসল ব্যতীত তাদের সমাধিস্থ করা হতো।
আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ
পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে, প্রতিটি কাজের পূর্বে স্রষ্টা এবং তাঁর নিদর্শনসমূহকে স্মরণ করা কাজের অগ্রগতি আরও বাড়িয়ে দেয়। 

“যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও তাঁর নিদর্শনসমূহের প্রতি, নিঃসন্দেহে তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে প্রফুল্লিত হয়।“ 
             (সূরা রাদ; আয়াত: ২৮)

সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে আমাদের এই জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আল্লাহ তা’আলার দেয়া নি'য়ামত। আমাদের প্রত্যেককেই তাঁর নিকট ফিরে যেতে হবে।   

  “এই পৃথিবী এবং তার আকাশে বাতাসে যা বিচরণ করে তা একদিন নিঃশেষ হয়ে যেতে বাধ্য।“ 
          (সূরা আর রহমান; আয়াত:২৬)

তিনি বলেছেন - একদিন এই মানুষেরা আবার উত্থিত হবে এবং তখন নতুন একটি জগত তৈরি হবে। প্রত্যেকে তাদের সৃষ্টির মুল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারবে এবং যারা এই উদ্দেশ্য অনুধাবন করে জীবন পরিচালনা করেছিল তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। 

“আমি সেদিন মৃতকে জীবিত করব, তাদের প্রত্যেকের আমলনামা তাদের নিকট পেশ করব, যা আমার নিকট লিপিবদ্ধ করা আছে।“ 
               (সূরা ইয়াসীন; আয়াত:১২)

জীবিত থাকাবস্থায় তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। 

১. একটি দ্বীনি পরিবার গঠন যা সকলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। 

২. মানবতার জন্য সকলকে জ্ঞান বিতরণ করা।

৩. দুঃস্থ ও দরিদ্রদের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা রেখে যাওয়া। 

স্রষ্টা প্রদত্ত আইনে বিশ্বাস রাখা
রাসুল (সাঃ) তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার প্রতি বিশ্বাসের ভিত মজবুত করেছিলেন। 

“পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ ফেরানোতে তোমাদের কোনো কল্যাণ নেই; কল্যাণ আছে কেবল আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, সমস্ত কিতাব এবং নবীগণের উপর ঈমান আনয়নে এবং আল্লাহপ্রেমে। আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্থকে অর্থ দান করায়, সালাত আদায়ে, যাকাত আদায়ে, ওয়াদা পূরণে এবং খারাপ সময়ে ধৈর্য ধারণে। তারাই সত্যপরায়ণ এবং মুত্তাকী।“ 
            (সূরা বাকারা; আয়াত: ১৭৭) 

সংকটের সময় মানুষের সামাজিক, শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটি আশ্রয়ের দরকার হয়। তারা তখন এটিকে কাটিয়ে উঠার জন্য আশ্বাস চায়, ভরসা চায়। তাদের এই সাফল্য শুধুমাত্র তাদের সঠিক পথ অনুসরণের উপর নির্ভর করে। 

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সমগ্র জীবনকালে ঐশী আদেশ, সাধারণ বিচার বিবেচনা এবং বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে দৈহিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। 

করোনা ভাইরাস প্রথম কোনো মহামারী নয় যে এটি কখনই শেষ হবে না। ঐতিহাসিকভাবেই, কষ্ট কিংবা যন্ত্রণার সময়ে মানবজাতি বিশ্বাসের প্রেক্ষিতেই ঐশী আইন এবং নির্দেশে সাড়া দিয়েছে। আবেগ, খেয়াল খুশি এবং প্রবৃত্তির চাইতে সত্য অনুসরণের মাঝেই তারা নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে বারংবার। 

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: