শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ৬ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

কোনো সংস্থাকে যাকাত দেওয়া যাবে কি ?

 আপডেট: ১৭:৫৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১

কোনো সংস্থাকে যাকাত দেওয়া যাবে কি ?

যাকাত ইসলামের একটি ফরজ আর্থিক ইবাদত। এ ইবাদত পালন করার ব্যাপারে পূর্ণ সতর্কতা ও সচেতনতা রক্ষা করা জরুরি। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, ইসলামী অঙ্গনে পরিচিত নয় এমন কিছু কিছু সংস্থা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যাকাত উত্তোলন করছেন। এক্ষেত্রে যাকাতদাতাদের পূর্ণ সতর্কতা বজায় রাখা জরুরি। এ জাতীয় কোনো সংস্থাকে যাকাত দিতে চাইলে দাতাদের দেখতে হবে, ওই সংস্থার আর্থিক সততা আছে কিনা এবং যাকাতের অর্থ প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান তারা অনুসরণ করে কিনা। এবং এসব বিষয়ে যাকাত দাতাকে নিশ্চিত হতে হবে।

ইসলামী নীতি ও প্রচারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন বিভিন্ন সংস্থাকে যাকাত দেওয়ার ব্যাপারে এসব সতর্কতার কথা বললেন মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার রঈস, বিশিষ্ট ফকীহ মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ। ইসলাম টাইমসের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় যাকাত দেওয়ার বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা রক্ষার ওপর জোর দিয়ে সম্প্রতি তিনি এসব কথা বলেন।


মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহকে আলোচিত কোনো কোনো সংস্থার হাতে যাকাতের অর্থ দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতার বিষয়টি খোলাসা করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, এ জাতীয় কোনো সংস্থার ফান্ডে যাকাত দিতে চাইলে দুটি বিষয়ে পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে। এক হলো, আমানত, অর্থাৎ যাকাতদাতাদের কাছ থেকে উত্তোলিত অর্থ যাকাতের প্রাপকদের কাছে যথাযথভাবে তারা পৌঁছে দেয় কিনা। দুই, যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে ইসলামের যে অনুশাসন রয়েছে, সেটা তারা যথাযথভাবে মান্য করে কিনা।

তিনি বলেন, যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হলো, যাকাতের মাসরাফ (শরীয়তের দৃষ্টিতে যিনি যাকাতের গ্রহীতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন) এবং যাকাতের অর্থ বা সম্পদ গ্রহীতাকে তামলীক (পরিপূর্ণভাবে মালিক বানিয়ে দেওয়া) করে দেওয়া। যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয়ে কোনো খামখেয়ালির সুযোগ নেই।

মাসিক আলকাউসার সম্পাদক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, সম্প্রতি এমন বিভিন্ন সংস্থাকে জনসেবা মূলক কাজের জন্য যাকাত আদায় করতে দেখা যাচ্ছে যাদেরকে ইসলামের অন্য বিধি-বিধান লালন-পালনের ব্যাপারে মনোযোগী দেখা যায় না। যাকাত ইসলামের বুনিয়াদি ফরজ আমলগুলোর একটি। কিন্তু এই যাকাত আদায়ের ব্যাপারে তাদেরকে আগ্রহী দেখা যায়। সঙ্গত কারণেই সামগ্রিকভাবে ইসলামের অনুশাসন মান্য করা ও পরিপালন করার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই, উত্তোলিত যাকাতের অর্থ ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী প্রাপকদের কাছে যথাযথ শরিয়া সম্মত উপায়ে তারা কতোটা পৌঁছে দিতে পারবেন এটা পর্যালোচনার দাবি রাখে। এসব সংস্থাকে চাইলে কেউ সাধারণ দানের টাকা দিতে পারেন, কিন্তু যাকাতের অর্থ তাদের হাতে দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ সতর্কতা বজায় রাখতে হবে।

যাকাতের মূল দর্শন তুলে ধরতে গিয়ে এই ফকীহ আলেম বলেন, যাকাতের অন্যতম মূল দর্শন হলো, তাৎক্ষণিক দারিদ্র্য বিমোচন। শরিয়া নীতি অনুযায়ী যাকাতের প্রাপক দরিদ্র মুসলিম হলেই তাকে যাকাত দেওয়া যাবে। এবং যাকাতের অর্থের পূর্ণ মালিক তাকে বানিয়ে দিতে হবে। অনেকেই যাকাতের অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো দরিদ্র মানুষের হাতে না দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় তাদেরকে সচ্ছল ও প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগের কথা বলে থাকেন। যাকাতের যে দর্শন তার সঙ্গে এ জাতীয় চিন্তার কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। প্রথমত, যাকাতের প্রাপককে পূর্ণ মালিক বানিয়ে না দিলে যাকাত আদায় হবে না।

দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর যাকাত আদায়ের যে বাধ্যবাধকতা, এ থেকে বোঝা যায়, এজাতীয় চিন্তা বা উদ্যোগ যাকাতের দর্শনের সঙ্গে মিলে না। তৃতীয়ত, তাৎক্ষণিক দারিদ্র্য দূর করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ১০০ জনের মাঝে দেওয়া যায় এবং তাদের তাৎক্ষণিক জীবনে স্বচ্ছলতা আনা যায়, সে পরিমাণ অর্থ সক্ষম ও প্রতিষ্ঠিত বানানোর কোনো উদ্যোগ নিয়ে বিতরণ করলে সেটা পাঁচ/দশ জনের চেয়ে বেশি মানুষকে দেওয়া যাবে না। অন্যদের হাতে তখন কিছুই পৌঁছবে না। কিছু মানুষকে ‘সক্ষম’ করতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষকে বঞ্চিত করা হবে।

যাকাতের মাসরাফ, তামলীক, প্রতিবছর যাকাত আদায়ের বাধ্যবাধকতা এবং যাকাত আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কিত বিধি- বিধান বিশ্লেষণ করে দেখলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

তাহলে কি দরিদ্র মানুষদের সচ্ছল ও সক্ষম বানানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে না ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এজাতীয় উদ্যোগ অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং গ্রহণ করা উচিত। তবে সেটা যাকাতের অর্থে করতে হবে এমন নয়। যাকাত ছাড়াও গরিবের প্রতি সচ্ছল মুসলমানের অনেক রকম দানের সুযোগ এবং নীতি রয়েছে। প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর যে সযত্ন খেয়াল রাখার নির্দেশনা রয়েছে, এটা যাকাতের অর্থে নয়।

তিনি বলেন, সূরা মাআরিজ একটি মক্কী সূরা। এ সূরার ২৪ ও ২৫ নাম্বার আয়াতে ‘সচ্ছল মুসলমানদের সম্পদে দরিদ্র বঞ্চিত ও প্রার্থী মুসলমানদের অধিকার রয়েছে’ এমন নির্দেশনা এসেছে। তখনো যাকাতের বিধান আসেনি। এজন্যই অনেক মুফাসসির বলেন, এই দুই আয়াতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, যাকাত ছাড়াও বিত্তবানদের অন্যান্য সম্পদেও গরীব মুসলমানের হক রয়েছে, সেখান থেকেও গরিবদের মাঝে তাদের দান করতে হবে। এছাড়াও তিরমিজি শরিফে ‘বিত্তবানদের সম্পদে যাকাত ছাড়াও গরীবের হক রয়েছে’ এমন একটি অধ্যায়ে রয়েছে। সেখানেও এ বিষয়ক হাদিসের সংগ্রহ রয়েছে। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় গরীবকে সচ্ছল ও সক্ষম বানানোর উদ্যোগ নিতে বিত্তবান মুসলমানদের সামনে কোনো বাধা নেই। নফল দান থেকেই এ জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সফল করার চেষ্টা করা যেতে পারে।

মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার ফিকহ বিভাগের প্রধান আরো বলেন, যাকাত একটি আর্থিক ইবাদত। ইবাদত কীভাবে পালন করতে হবে, কাকে কাকে এ অর্থ দেওয়া যাবে এবং এর অর্থ দেওয়ার পদ্ধতি কী হবে, পবিত্র কোরআন, হাদিস শরীফ এবং ইসলামী ফিকহে তার বিস্তারিত বিধি-বিধান রয়েছে। এসব বিধি-বিধানের বাইরে গিয়ে যাকাত উসুল করার অন্য কোনো প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: