বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

কিবলা- বদলে যাওয়ার গল্প এবং মুসলিম জাতির ঐক্য

 প্রকাশিত: ২০:২৫, ৩১ জুলাই ২০২১

কিবলা- বদলে যাওয়ার গল্প এবং মুসলিম জাতির ঐক্য

মানুষের সহজাত স্বভাব হচ্ছে তাঁরা ঐক্যের মাঝে শক্তি খুঁজে পায়।

মানবজাতির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তবে আমাদেরকে অবশ্যই এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন যা কিনা মাত্র কয়েকটি বিষয়ে শান্তি এনে দেয় বরং সবার জন্য সেটা স্বস্তির এবং শান্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। এবং আমরা এমন শান্তি এবং ন্যায় বিচার চাই যা কিনা সময় স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তন হবে না, বরং স্থির থাকবে।   

মানবজাতি সাধারণত খুব কমই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে। কেননা সবার মাঝে বেশির ভাগ সময় একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব বিদ্যমান থাকে। যখন একজন মানুষের জীবনে তাঁর অহংবোধ প্রাধান্য পায় তখন সমাজে ধ্বংস অনিবার্য। একটি আধ্যাত্মিক বন্ধন এবং দৈবিক নিয়মনীতি ছাড়া মানুষ নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।  

কেবলমাত্র একটি জিনিস মানবজাতির মঙ্গল ও ধৈর্যকে একত্রিত করতে পারে, যেটা কিনা তাঁর গর্বের থেকেও বড় কিছু। তা হচ্ছে সকলের স্রষ্টা ও পালনকর্তার  প্রতি ভক্তি এবং তাঁর সৃষ্টির যত্ন নেওয়া।

পার্থিব আকাঙ্ক্ষাকে অতিক্রম করে এমন উচ্চতর অবস্থা অর্জন করা সহজ নয়।  এটির জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট আচরণবিধি, জীবনযাত্রার একটি আধ্যাত্মিক পন্থা  এবং শারীরিক দিক নির্দেশনা যাকিনা একই সাথে কাজ করে যাবে। ইসলামে, এর উৎকৃষ্ট উদাহরন হচ্ছে আমাদের প্রিয় কিবলা “ কা’বা” । 

নবী কারীম (সা) বলেছেন ঃ

“পৃথিবীতে সকল জিনিসের একজন তৈরিকারক বা প্রভু থাকে, এবং সেই সকল প্রভু তাকিয়ে থাকে কিবলাহর দিকে” ( আত -তাবরানী)


কিবলা- বদলে যাওয়ার গল্পঃ 

ইসলামের শুরুতে মুসলিমরা “বায়তুল মুকাদ্দিস”কে কিবলা মেনে সেদিকে মুখ করে নামায আদায় করতো। বায়তুল মুকাদ্দিস জেরুজালেম এ অবসস্থিত। তাই বায়তুল মুকাদ্দিস ছিল মুসলিম এবং ইহুদী উভয়ের জন্য সম্মানিত স্থান, প্রার্থনার স্থান। মদীনায় হিজরতের কিছুদিন পরেই আল্লাহর রাসূল (সা) কিবলা বায়তুল মুকাদ্দিস থেকে পরিবর্তন করে আল-মসজিদ- আল-হারামের দিকে করার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশনা পান। 

একদিন দুপুরের নামাযরত অবস্থায় নবী কারীম (সা) এর কাছে হযরত জিব্রাইল (আ) আল্লাহর নির্দেশনা নিয়ে এলেন যে এই মুহুর্তে যেন তিনি সকল নামাযরত মুসল্লিদের নিয়ে কিবলাহ পরিবর্তন করেন । বায়তুল মুকাদ্দিস থেকে ফিরে মসজিদ  আল হারামের দিকে মুখ করেন। নবী কারীম (সা) এবং তাঁর সাথীরা সাথে সাথে সেই আদেশ পালন করলেন। সুবহানাল্লাহ!

 মূলত এটা আল্লাহর নিকট থেকে একটা পরীক্ষাও বটে। বিশ্বাসীদের বিশ্বাস আল্লাহর উপর কতখানি নির্ভিরশীল এটা ছিল তাঁর একটি পরীক্ষা।  

কিবলা পরিবর্তন হয়ে গেল। সুবহানাআল্লাহ! আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং রাসূলে কারীম (সা) এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই কিবলা পরিবর্তন। 

আপনি কল্পনা করতে পারেন! 

কি পরিমান আনুগত্যের উদাহরন এটি। রাসুলে কারীম (সা) নির্দেশ পাবার সাথে সাথে তাঁর কিবলা পরিবর্তন করে ফেললেন এবং একটি মুহুর্তও দেরি করেননি। এবং তাঁর সাথীরা বিনা বাক্য ব্যায়ে কোন প্রশ্ন ছাড়া আল্লাহর রাসূলকে অনুসরণ করলেন। 

নবী কারীম (সা) মুসলিম উম্মাহকে এক দেহ এক প্রান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক মুসলিম ভাই যদি কষ্টে থাকে তাহলে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে থাকা অন্য মুসলিম সেটা অনুভব করতে পারবে। এটাই মুসলিম উম্মাহর বৈশিষ্ট্য। মুসলমানদের সাথে তাদের পালনকর্তার সাথে যে একতাবদ্ধতা এবং সাদৃশ্য রয়েছে তা স্পষ্টভাবে এই অর্থটি প্রকাশ করে।

“কা’বা” তৈরি প্রস্তুতিঃ 

“কা’বা” ঘর তৈরির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে হলে আমাদেরকে সবার আগে স্মরণ করতে হবে হযরত ইব্রাহীম (আ) এবং তাঁর সম্মানিত পরিবারকে। তাঁর সম্মানিতা স্ত্রী হাজেরা এবং সন্তান ইসমাইলকেও স্মরণ করতে হবে। ইব্রাহীম (আ) সমগ্র পৃথিবীতে তাঁর চারিত্রিক দৃড়তা এবং এবং একেশ্বরবাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের জন্য পরিচিত। তিনি তাঁর এই চারিত্রিক বলিষ্ঠতার জন্যই তাঁর সময়ের সেই মিথ্যা অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজের সামনে রুখে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। তাঁর এই আন্তরিকতা, চরিত্র এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কা'বা নির্মিত হয়েছিল।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:

“প্রকৃতপক্ষে ইব্রাহীম নিজেই ছিল একটি পরিপূর্ন উম্মত। আল্লাহর হুকুমের অনুগত এবং একনিষ্ঠ। সে কখনো মুশরিক ছিল না। “(সূরা নহল, আয়াত – ১২০)

ইব্রাহীম (আ) ব্যবিলনের রাজা নমরুদ এর সামনে বিতর্কে দাঁড়িয়ে গেলেন যখন তিনি নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) তাঁর মুশরিক লোকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে তারা যে সমস্ত গ্রহ, সূর্য এবং চাঁদকে উপাসনা করেছিল তারাও আল্লাহর একত্ব ঘোষণা করে এবং সময়মত অদৃশ্য হয়ে যায়। ইব্রাহিম (আ) মাত্র একজন ব্যাক্তি ছিলেন যে কিনা তাঁর লোকদের মাঝে একেশ্বরবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি একাই একটি  জাতি ছিলেন!  

তবে হযরত ইব্রাহিম (আ) কেবল প্রতিমা পূজার বিরোধিতা করেননি, বরং তিনি তাঁর লোকদের প্রতিমাগুলিও ভেঙে ফেলেছিলেন । তাঁর প্রভুর প্রতি তাঁর সাহস ও বিশ্বাসের কারণে তাকে যে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তাও শীতল হয়ে যায় এবং ইব্রাহীমের বিশ্বাস কে আবারো সঠিক বলেই প্রমানিত করে।  ইব্রাহীম (আ) কখনও তাঁর দ্বীনকে দ্বিধা বা সন্দেহ করেনি এবং তাঁর এই দৃড় বিশ্বাসের কারণে তিনি যে পুরষ্কার পেয়েছিলেন তা ছিল অপরিসীম। আলহামদুলিল্লাহ!

হাজেরার সাহসিকতা -

“তিনি আমাদেরকে কখনোই হতাশ করবেন না”ঃ 

হাজেরা ইসমাইল এর মা! এক বিষ্ময়কর রমনী। যিনি কিনা শুধুমাত্র একজন সাহসী নারীই ছিলেন না, সেইসাথে একজন নবীর স্ত্রী এবং একজন নবীর গর্ভধারিনী মা’ও ছিলেন। তিনি যেসকল প্রতিকূল অবস্থায় ঈমানে দৃঢ় ছিলেন তা আমাদের সকলেরই জানা। তিনি তাঁর ছোট বাচ্চা ইসমাইল কে নিয়ে যেসকল প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং সাহসিকতার সাথে পার করেছিলেন তা তাঁর বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে।  

স্ত্রী এবং পুত্রকে রেখে আসার পর এবং তাদেরকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করার পরে ইব্রাহিম (আ) নীচের দু'আ করেছেন:

رَّبَّنَا إِنِّي أَسْكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِندَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ
হে আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামায কায়েম রাখে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফলাদি দ্বারা রুযী দান করুন, সম্ভবতঃ তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত -৩৭)

ইব্রাহিম (আ) মক্কায় ফিরে এসে তাঁর পুত্র ইসমাইলের সাথে কাবাঘর নির্মান করলেন। এরপর সেখানে  প্রার্থনা করলেন যেন তাঁর বংশধররা আল্লাহকে বিশ্বাস করে। তাঁর আবেদনের জবাব দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবী কারীম (সা)কে মক্কায় প্রেরণ করলেন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে শুরু থেকে, কা'বা একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ছিল।

এবার ইব্রাহীম (আ) এর ডাক ঃ

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে কা’বা ঘরে হজ্জ্ব এর প্রচলন করার জন্য নির্দেশ পেয়েছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ)। তাকে বলা হয়েছিলে পৃথিবীর সকল মানুষকে আহ্বান করতে যাদের হৃদয় আল্লাহর ভালোবাসায় শিক্ত, যারা আল্লাহর আনুগত্য, যারা এক আল্লাহর সাথে কারো শরিক করে না তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহর এই ঘরে হজ্জ্ব পালন করবে।  

হযরত মোহাম্মদ (সা) কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছিলেন ইব্রাহীম এর প্রচারিত ধর্মের ভেতর যে দূষন শুরু হয়েগিয়েছিল তা বিশুদ্ধ করতে। নবী কারীম (সা) বলেন –

“সত্যই আমি আমার পিতা ইব্রাহীম এবং ভাই ইসা (আ) এর দোয়ার প্রাপ্তি ।“ 

আজ অবধি, মুসলমানরা ইব্রাহিমের আহ্বানে সাড়া দেয় প্রতিবছর হজ্জ্ব করেন এবং দিনে কমপক্ষে পাঁচবার, মুসলমানরা তাদের  মক্কার দিকে মুখ করে নামায আদায় করেন। পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যে একত্রিত হয় মুসলমানরা ।

কিবলা কিভাবে আমাদের এক করে?

আলহামদুলিল্লাহ আমাদেরএকটি কিবলা আছে। এই কিবলা  থাকার ফলশ্রুতিতে মুসলমানরা শুধু নামাজে মুখোমুখি হওয়ার জন্য শারীরিক দিকনির্দেশনা পায় এমন না, বরং এটি আমাদের হৃদয়কে একত্রিত করে, ইবাদতের জন্য আমাদের আচার আচরন কেমন হবে সেই স্পষ্ট সংজ্ঞাও দেয় । আমাদেরকে নিবিড় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। 

নবী মুহাম্মদ (সা) বলেছেন:

“ পৃথিবীতে আমি শুধু তোমাদেরকে ভালো চরিত্র শেখাতে এসেছি। “

সমস্ত কিছু যা একটি শালীন চরিত্র এবং সম্ভ্রান্ত শিষ্টাচার গঠন করে তা মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং এটিই আমাদেরকে একত্রিত করে। এবং এর ভেতর আরো রয়েছে সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা এবং আরও অনেক কিছু। 

একটি কিবলা, একটি সরল পথ, একটি আচরণবিধি এবং দিনে পাঁচবার মানুষের তাঁর মহান রবের মুখোমুখি হচ্ছে , এটাই মানুষের আধ্যাত্মিকতা এবং ভক্তির একটি দর্শন!

এটাই আমাদের কিবলা! যা আমাদেরকে সহস্র মাইল দূরে থেকেও এক করে রাখে। তাই আসুন আমরা আমাদের এই বিশ্বকে পরকালের জন্য আমাদের উত্তম স্থানের চরনভূমিরুপে তৈরি করি। সমস্ত সৃষ্টি যেমন তার পালনকর্তার উপাসনা করে, আসুন আমরাও তার ব্যতিক্রম হই না এবং সমস্ত মন দিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হই। 

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: