শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, বৈশাখ ১২ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

কওমী মাদরাসা খুলতে আর দেরি করা উচিত নয়, ক্ষতি হয়েছে অনেক

 প্রকাশিত: ১৮:১৫, ২৮ মে ২০২০

কওমী মাদরাসা খুলতে আর দেরি করা উচিত নয়, ক্ষতি হয়েছে অনেক

করোনা ভাইরাসের কারণে রমজানের আগে কওমী মাদরাসাগুলোর যখন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন ছিল ফাইনাল পরীক্ষার সময়। পরীক্ষার কোনো কাজই কোথাও আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে ঈদুল ফিতরের পর যে নতুন শিক্ষা-বছর  শুরু, সেখানে এমনিতেই ছাত্রদের নতুন করে পরীক্ষাসহ নানারকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। এরমধ্যে কওমী মাদরাসাগুলো খুলতে আরও দেরি হলে লাখো ছাত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। এ জন্য অনতিবিলম্বে কওমী মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

ঈদুল ফিতরের পর দেশের হাজার হাজার কওমী মাদরাসার নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রাক্কালে মাদরাসার লাখ লাখ ছাত্রের শিক্ষাজীবন রক্ষার আহ্বান জানিয়ে এসব কথা বলেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার রঈস মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ।

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বলেন, ২৭ মে বুধবারের খবরে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে চলমান সাধারণ ছুটি আর বাড়ানো হচ্ছে না। মানুষ সতর্কতার সঙ্গে হলেও স্বাভাবিক জীবন-যাপনে প্রবেশের সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এজন্য এ খবরটিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই গ্রহণ করতে চাই। তবে, খবরে এ-ও জানা গেছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। আমরা মনে করি, জীবনের অন্যসব অঙ্গনের মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত খুলে দেওয়া উচিত। বিশেষত স্কুল কিংবা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ এতে শিশুদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।

উচ্চতর গবেষণামূলক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই প্রধান বলেন, পুঁজিবাদের নানামাত্রিক আগ্রাসন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা ও মুক্ত থাকতে পারছে না। অথচ কোনো সংকটের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অর্জন থেকে পিছিয়ে রাখা দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের লকডাউন এবং ইউরোপের দেশ সুইডেনে চর্চিত স্বাভাবিক জীবনের তুলনা দিয়ে মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, বৈশ্বিক পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ১৯ বছরের নিচে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা খুব কম। সুইডেনে ৯ বছরের নিচে একজন রোগী পাওয়া গেছে। শিশু-কিশোরদের মাঝে এ ভাইরাসের বিস্তারের হার শূন্যের কাছাকাছি। এ পরিস্থিতিতে শিশু ও মাধ্যমিক শ্রেণীর লেখাপড়া বিশেষ ব্যবস্থায় চালু রাখা দরকার।

করোনা সঙ্কটকালে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের প্রস্তাব প্রসঙ্গে এই শিক্ষাবিদ বলেন, যারা গোটা শিক্ষাকার্যক্রম অনলাইনে চালানোর কথা প্রস্তাব করছেন, প্রথমত তারা বাংলাদেশের মতো দেশে অনলাইন ব্যবস্থাপনার আওতায় কতজন শিক্ষার্থী আসার সামর্থ্য রাখেন এটা বিবেচনা করছেন না। দ্বিতীয়ত স্কুল বা মাধ্যমিক পর্যায়ে, যেখানকার শিক্ষার্থীরা শিশু-কিশোর, অনলাইন কার্যক্রম তাদের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে, এটাও অনেকে ভেবে দেখছেন না। তৃতীয়ত, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের নামে ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দিলে তারা যে ভুল জায়গায় যাবে না, ভুল কৌতূহলে প্রবেশ করবে না এরকম নিশ্চয়তার বিষয়টি নিয়েও সংশ্লিষ্টরা ভাবছেন বলে মনে হয় না। অনলাইন ব্যবস্থাপনায় এদেশে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিরাপদ ও কার্যকর শিক্ষাদান চালু রাখা যাবে এটা আশা করা কঠিন। সুতরাং আমরা মনে করি, অন্তত শিশু ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম সরাসরি চলতে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

আরো পড়ুন: ১৫ জুন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, মাদরাসা খুলতে শিগগিরই সরকারের সাথে বসছেন আলেমরা।

দেশের কওমী মাদরাসাগুলো খুলে দিতে আর দেরি না করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, রমজানের আগে কওমী মাদরাসাগুলোতে যখন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়, তখন ছাত্রদের সামনে ছিল বার্ষিক পরীক্ষাসহ বোর্ডসমূহের পরীক্ষা। ছিল দাওরায়ে হাদিস সমাপনী ছাত্রদের পরীক্ষার জন্য সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ড-হাইয়াতুল উলইয়া লিল মাদারিসিল কওমীয়ারও পরীক্ষা। এসব পরীক্ষাই মুলতবি করে দেওয়া হয় এবং করোনা পরিস্থিতির কারণে মাদ্রাসাগুলো ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। এতে লাখো ছাত্রের ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম পিছিয়ে যায়। সাধারনত কওমী মাদ্রাসায় যেটা প্রায় কখনো ঘটে না, সেই সেশনজটের একটি পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষে এসব ছাত্রের অনেককেই প্রয়োজনে নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষার পর ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অন্যান্য অনেকের নেসাব বা সিলেবাস পিছিয়ে পড়বে। এতে এক ধরনের অবধারিত সেশনজটের সৃষ্টি হবে। আমাদের চরম ব্যর্থতা, ছুটি দেওয়ার প্রস্তুতি যখন নেওয়া হচ্ছিল তখন আর অল্প কয়েকদিন মাদরাসাগুলো খোলা রেখে পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সরকারের দায়িত্বশীলদেরকে সম্মত করাতে পারিনি। কওমী মাদরাসাগুলোর প্রায় সবকটিই আবাসিক। ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে মাদরাসা থেকে বের হয় না। ছুটি ঘোষণার সময় প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের কঠোরভাবে মাদরাসায় কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা যেত। এরপরও পরীক্ষা সম্পন্ন করে ছুটি দেওয়া যেত। কিন্তু এই সহজ বিষয়টি আমরা সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি, অথবা তারা বুঝতেই চাননি। এসব কারণে শিক্ষা ধারাবাহিকতা রক্ষার বিষয়টিতে কওমি মাদরাসার ছাত্র ও সংশ্লিষ্টদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। তারপরও আমরা বলতে চাই, মাদরাসা খুলে দিতে এখন আর দেরি করার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, মাদরাসা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এমন হতে পারে, করোনা ভাইরাস জনিত আতঙ্কের কারণে কোনো কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে এখনই মাদরাসায় যেতে দেবেন না। এক্ষেত্রে তাদেরকে বাধ্য করার কিছু নেই। বরং সুবিধামতো সময়ে নিজ দায়িত্বে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত। কিন্তু একজন, দুজন অথবা অল্প কিছু মানুষের আতঙ্কের কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এবং সকল কওমী মাদরাসা বন্ধ রাখা উচিত হবে না। বরং আগ্রহীদের বেশিরভাগ মানুষের জন্য দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণের দুয়ার খুলে দেওয়া উচিত। সকল স্বাস্থ্য সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার নীতি আরোপ করে হলেও অনতিবিলম্বে মাদরাসা খুলে দেওয়া দরকার।

করোনা ভাইরাস সংকটকালে কওমী মাদরাসাগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আরো বলেন, কওমী মাদরাসাগুলো হঠাৎ করে রমজানের বেশ আগে বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকেই আমরা নিজস্ব পরিসরে মাদরাসা খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছি। নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনাকালে আবারও আহ্বানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি। মাদ্রাসাগুলো হঠাৎ ছুটি হয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় রমজানুল মোবারকে মাদরাসাগুলোর সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মানুষের সহযোগিতামূলক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ ছিল। কওমী মাদ্রাসার প্রতি মুসলমান জনসাধারণের আর্থিক সহযোগিতার একটি বিশেষ সময় হলো রমজানুল মোবারক। এবার এক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজন ও মাদরাসা-দরদী মানুষেরা অনুভব করছেন, এর ফলে মাদরাসাগুলোর শিক্ষক- কর্মচারী ও খাদেমদের জীবনে কী কঠিন প্রভাব পড়েছে। মাদরাসাগুলোর স্বাভাবিক ধারা বজায় রাখা এবং চলমান নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা অনেক জায়গাতেই কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দ্বীনি ইলমের শিক্ষা ও চর্চা চালু করে মাদ্রাসা এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষার বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা সকল কওমী মাদরাসাকে হেফাজত করুন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পথচলা সহজ করুন।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: