বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, চৈত্র ১৪ ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইসলাম

একজন পদার্থবিজ্ঞানীর ইসলাম গ্রহণের গল্প

 প্রকাশিত: ১২:২১, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

একজন পদার্থবিজ্ঞানীর ইসলাম গ্রহণের গল্প

ডেভিড রবার্ট ম্যাথুজ ১৯৩৮ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যাটারহামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ২৭ জুলাই। চার্চের একজন নিয়মিত সদস্য হিসেবে তিনি বেড়ে ওঠেন। তিনি অ্যাপ্লায়েড ফিজিকসের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন।

শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞান-গরিমায় তিনি ছিলেন খুব অগ্রসর। তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ। তাই অনেক সংস্থা ও সংগঠনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

ডেভিড রবার্ট ম্যাথুজ যেসব সংগঠন বা সংস্থার সদস্য ছিলেন সেগুলো হলো : ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার্স (১৯৭০), অ্যাসোসিয়েশন অব কম্পিউটার মেশিনারি (১৯৮২), ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (১৯৮৩), নিউ ইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্সেস (১৯৯৩), মেনসা (Mensa-১৯৯৪)। তা ছাড়া তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানের ফেলো ছিলেন সেগুলো হলো : ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (১৯৮৩), ব্রিটিশ কম্পিউটার সোসাইটি (১৯৮৪), চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার (১৯৯৪)।

ম্যাথুজ অসাধারণ যোগ্যতা, দক্ষতা ও অপূর্ব চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। স্বীয় যোগ্যতা বলে তিনি Dictionary of International Biography (১৯৯৪) Who's Who in the world (১৯৮৩)-এ তাঁর নাম সংযুক্ত করতে সক্ষম হন। তখন ১৯৬৮ সাল। ম্যাথুজের বয়স মাত্র ৩০ বছর। এই বয়সে তিনি একটি উচ্চতর পদার্থ ল্যাবরেটরিতে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি সৌদি আরবস্থ দাহরানে পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছর অবস্থান করেন। ম্যাথুজ ১৯৮৬ সালে রিয়াদে বাদশাহ সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেক্টরে কাজ শুরু করেন। এই সময়কালে তিনি ধীরে ধীরে ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ডেভিড রবার্ট ম্যাথুজ ১৯৭০ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে ইসলাম ধর্ম কবুল করেন।

ডেভিড রবার্ট বলেন, “আমি খ্রিস্টানদের প্রভুত্বের ধারণার সঙ্গে একমত হতে পারিনি। তেমনি যিশুর দেবত্বের (ঈশ্বরত্বের) বিষয়টিও আমার কাছে দুর্ভেদ্য বলে মনে হয়েছে। খ্রিস্টানদের ‘বংশানুক্রমে পাপ’-এর ধারণা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। কেউ এসব বিষয়ে আমাকে স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারেনি। খ্রিস্টান চার্চের কাছে এসব বিষয়ের কোনো জবাব নেই। আমার এই সংশয়-সন্দেহ আমার অতৃপ্তিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। আমার মধ্যে জিজ্ঞাসা আরো বিস্তৃতি লাভ করে।’

ম্যাথুজ আরো বলেন, ‘আমার প্রশ্নের কোনো সমাধান খ্রিস্টানদের কাছে খুঁজে পাইনি। অতঃপর আমি এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে আমি যদি গির্জায় যাওয়া অব্যাহত রাখি, তাহলে আমি একজন কপট হিসেবে বিবেচিত হব। তা ছাড়া চার্চে ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমি চার্চের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি এবং চার্চে যাতায়াত বন্ধ করে দিই। তখন আমি ভয়ানক অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম। কেননা চার্চের পক্ষ থেকে আমার প্রতি হুমকি আসছিল। চার্চে যাতায়াত বন্ধ রাখলে আমার পরিণাম খুব ভয়াবহ হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হলো। চার্চ আমাকে প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী বলে সাব্যস্ত করল।

তারপর ভাবলাম, আমি তো জানি না যে সত্যিই ঈশ্বর বলতে কেউ আছে কি না। আমি আমার কাজকর্ম সম্পর্কে দায়িত্বশীল হওয়ার চেষ্টা করলাম এবং আমার চেয়ে দুর্বল ও হতভাগা মানুষের সাহায্যে এগিয়ে গেলাম। আর এটাই আমার নিয়মিত জীবনধারা হয়ে উঠল। এভাবে প্রায় আট বছর আমি ধর্মকর্মের বাইরে থেকে গেলাম। আমি বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বললাম, যারা তাদের ধর্মের বিভিন্ন মূল্যবোধে বিশ্বাসী। আমি কিছু বইও পড়লাম। এ সময় আমি রোমান ক্যাথলিজম, ইহুদি ধর্মমত, বৌদ্ধ ধর্মমত, হিন্দু, কনফুসিয়াস মতবাদ ও জাপানের ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। পরিশেষে আমি ইসলামের সংস্পর্শে এলাম। কিন্তু আমি যা চাইছিলাম তা কোথাও  পেলাম না।’

১৯৬৮ সালের কথা। রবার্টের বয়স তখন ৩০ বছর। তিনি সে সময় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবরেটরিতে কর্মরত। তাঁর হোটেলে থাকতেন পাকিস্তান, ভারত ও ইরানের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। রাতের খাবারের পর তাঁরা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনায় মিলিত হতেন। ইসলাম সম্পর্কে কেউ কথা বললে রবার্ট উৎসাহ বোধ করতেন। একদিন তিনি অক্সফোর্ড গিয়ে সেখানে কোনো মসজিদ আছে কি না, তার খোঁজ নিলেন। কেউ কেউ তাঁকে কয়েকজনের নাম দিলেন, যারা তার সন্ধান দিতে পারবে। তিনি একজন ইংরেজের সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি প্রায় ২০ বছর আগে ইসলাম কবুল করেছেন। ডেভিড বললেন, ‘আমি জানি না আমি মুসলিম হতে পারব কি না। তবে তথ্য ছাড়া আমি জানব কী করে?’

ডেভিড ম্যাথুজ ইংরেজ মুসলিম লোকটির সঙ্গে সপ্তাহে দুইবার বিকেলে একত্রিত হয়ে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করতে শুরু করলেন। এভাবে প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হলো। এর পর থেকে ডেভিড তাঁর সঙ্গে নামাজ পড়া শুরু করলেন। ডেভিড রোজা রাখলেন এবং জাকাতও প্রদান করলেন। তিনি মসজিদে যেতে শুরু করলেন। ডেভিড বলেন, ‘এক রাতে আমার ঘুম হয়নি। আমার মনের মধ্যে এই ধারণা জন্মাল যে তুমি সঠিক পথে আছ। এই পথই তোমাকে তোমার স্রষ্টা এক প্রভুর দিকে নিয়ে যাবে। আমি সকালে বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা করলাম। তখন আমার সব সংশয় দূর হয়ে গেল। আমি মনে প্রশান্তি লাভ করলাম। আমার মনের মধ্যে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছিল তা নিমেষেই দূর হয়ে গেল। তার পর থেকে আমি ইসলামের পথে চলা শুরু করলাম। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামে আমার বিশ্বাস স্থাপন করলাম। সেটা ১৯৭০ সালের মার্চ মাসের কথা।

ডেভিডের সঙ্গে এক মেয়ের পরিচয় ঘটল। তিনি যখন ইসলাম সম্পর্কে হোটেলে আলোচনা করতেন, তখন সেই মেয়েও অংশ নিতেন। মেয়েটি এমফিল করে ফিরে গেলেন পাকিস্তানে। ডেভিড একদিন তাঁকে চিঠি দিয়ে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা ও তাঁদের বন্ধুত্বের কথা জানালেন। এক বছর পর মেয়েটি ডেভিডকে দাওয়াত দিলে তিনি পাকিস্তানে গেলেন। তিনি মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলেন। তখন ডেভিড তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এরপর তাঁদের বিয়ে হলো। ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের দাহরানে পেট্রোলিয়াম ও মিনারেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভিডের চাকরি হলো। তিনি সস্ত্রীক সৌদি আরবে চলে গেলেন।

ডেভিড বলেন, ‘আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে আমার মতো করেই গ্রহণ করেছে। ধর্ম নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ। আমার মায়ের বয়স ৯০ বছর। কিন্তু মা ও ভাই-বোনের কেউ ইসলাম গ্রহণ করেননি। তার পরও আমি তাঁদের সঙ্গে ভালোই আছি।’

অনলাইন নিউজ পোর্টাল

মন্তব্য করুন: